দ্বিতীয় পর্বের বিশ্ব ইজতেমা শুরু by ইকবাল আহাম্মদ সরকার ও এম এ হায়দার সরকার

বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব গতকাল বাদ ফজর আম বয়ানের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে। টঙ্গীর তুরাগতীরে বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বের প্রথম দিন ছিল গতকাল। প্রথম দিন অনুষ্ঠিত হয় দেশের বৃহত্তম জুমার জামাত। ইজতেমায় অংশগ্রহণকারী লাখ লাখ মুসল্লি ছাড়াও রাজধানীসহ পার্শ্ববর্তী এলাকার হাজার হাজার মানুষ এ বৃহত্তম জুমার জামাতে শরিক হন। এ পর্বেও বিশ্বের অর্ধশত দেশের প্রায় ১০ হাজার মুসল্লি অংশ নিয়েছেন। গতকাল এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত অনুকূল আবহাওয়া ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রয়েছে। ইজতেমায় আসা মুসল্লিরা স্বাচ্ছন্দ্যে তাবলীগ জামাতের শীর্ষ মুরব্বিদের বয়ান শুনছেন এবং এবাদত-বন্দেগিতে মশগুল রয়েছেন। আজ ইজতেমার দ্বিতীয় দিন। আগামীকাল দুপুরের আগে আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে এবারের বিশ্ব ইজতেমার দুই পর্বের সমাপ্তি ঘটবে। টঙ্গী, উত্তরা, কামারপাড়া, মিরপুর, আবদুল্লাহপুর প্রভৃতি এলাকার মসজিদে গতকালের জুমার জামাতে মুসল্লি সংখ্যা ছিল খুবই কম। ইজতেমা মাঠে প্রথম পর্বের মতো দ্বিতীয় পর্বেও জুমার জামাত সুবিশাল প্যান্ডেলের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিস্তৃতি লাভ করে চার পাশে। জুমার এ জামাতে ইমামতি করেন ঢাকার কাকরাইল মসজিদের খতিব হাফেজ মাওলানা যোবায়ের।
বিশ্ব ইজতেমায় যোগ দিতে দেশ-বিদেশ থেকে মুসল্লিদের টঙ্গীমুখী স্রোত অব্যাহত রয়েছে। বহুল কাঙ্ক্ষিত আখেরি মোনাজাত পর্যন্ত এ স্রোত আরও বাড়বে। তুরাগতীরবর্তী বিশাল প্রান্তরে নির্মিত পাটের চট ও লাইলন কাপড়ের প্যান্ডেল ইতিমধ্যেই কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেছে। ফলে নতুন করে যারা আসছেন তাদের নিজ উদ্যোগে তাঁবু টানিয়ে অবস্থান নিতে হচ্ছে। গত দু’দিনে শীতের তীব্রতা কম থাকায় মুসল্লিদের ভোগান্তি কিছুটা কম হলেও ধুলায় ধূসরিত গোটা ইজতেমা এলাকায় চলাচল কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। ওয়াসা ও ফায়ার সার্ভিসের উদ্যোগে প্রধান প্রধান সড়ক ও বিদেশী মুসল্লিদের চলাচলের পথে পানি ছিটানো হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। একদিকে পানি ছিটিয়ে যাচ্ছে ওয়াসার গাড়ি, অন্যদিকে মুহূর্তেই আবার ধুলায় ভরে যাচ্ছে রাস্তাগুলো। ফলে চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোতে ভিড় করছে সর্দি, কাশি ও পেটের পীড়া নিয়ে শ’ শ’ মুসল্লি।
প্রথম দিনে যারা বয়ান করলেন: বাদ ফজর পাকিস্তানের মাওলানা এহসানের আম বয়ানের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে এবারের বিশ্ব ইজতেমা। বাদ জুমা বয়ান করেন মাওলানা শওকত আলী। বাদ আসর স্বাগতিক বাংলাদেশের কাকরাইল মসজিদের খতিব মাওলানা যোবায়ের। বাদ মাগরিব বয়ান করেন ভারতের মাওলানা সা’দ।
বয়ানে যা বলা হলো: বয়ানে বলা হয় গরিরেব জন্য ঈদের নামাজের পর অতি উত্তম ইবাদত হলো শুক্রবারের জুমার নামাজ। এদিনে আল্লাহর কাছে যে যা চাইবে, আল্লাহ তা তাকে দেবেন। এ নামাজ আদায় করার তৌফিক আল্লাহ আমাদের দান করুন। জুমার নামাজ আদায়ের লক্ষ্যে অজু-গোসল করে মসজিদের উদ্দেশে রওনা হওয়ার পর থেকে তার আমলনামায় নেকি লেখা শুরু হয়ে যায়। আমরা যা করবো আল্লাহকে রাজি-খুশি করার জন্যই করবো। আল্লাহপাকের হুকুমমতো আমরা যেন সারাজীবন চলতে পারি সে চেষ্টা করতে হবে। এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশে ও সারা দুনিয়ায় মানুষের মধ্যে দ্বীন কায়েম করার জন্য ছড়িয়ে পড়তে হবে। ইমান, আমল ও দাওয়াতের মেহনত সম্পর্কে বাদ জুমার বয়ানে মাওলানা শওকত আলী বলেন, ‘একজন ইমানদার বান্দাও পৃথিবীতে বেঁচে থাকলে এবং আল্লাহকে ডাকলে আল্লাহ পৃথিবীকে ধ্বংস করবেন না। পৃথিবীতে যেদিন থেকে ইমানদারি চলে যাবে সেদিন থেকে পর্যায়ক্রমে পৃথিবীর নানা স্তর ধ্বংস করে দেবেন। গাছপালা, পশুপাখি, মানুষ এমনি করে সবকিছুকে ধ্বংস করে দেবেন। একমাত্র আল্লাহই পৃথিবীতে থাকবেন। তিনি আরও বলেন, ‘পৃথিবীতে ইমানের মূল্য অনেক বেশি। ইমানকে মজবুত করতে হলে আমাদের দাওয়াতি কাজে সময় লাগাতে হবে।’
বয়ানের তাৎক্ষণিক অনুবাদ: বিশ্ব ইজতেমায় বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের তাবলীগ মারকাজের ১০-১৫ জন শূরা সদস্য ও বুজুর্গ বয়ান পেশ করবেন। মূল বয়ান উর্দুতে হলেও বাংলা, ইংরেজি, আরবি, তামিল, মালয়, তুর্কি ও ফরাসি ভাষায় তাৎক্ষণিক অনুবাদ করা হচ্ছে। বিদেশী মেহমানরা মূল বয়ান মঞ্চের উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্বপাশে হোগলা পাটিতে বসেন। বিভিন্ন ভাষাভাষীর মুসল্লিরা আলাদা আলাদা বসেন এবং তাদের মধ্যে একজন মুরব্বি মূল বয়ানকে তাৎক্ষণিক অনুবাদ করে শোনান।
ইজতেমায় দ্বিতীয় পর্বে খিত্তাওয়ারি মুসল্লিদের অবস্থান: খিত্তা নং-১ (নারায়ণগঞ্জ-১), খিত্তা নং-২ (নারায়ণগঞ্জ-২), খিত্তা নং-৩ (ঢাকা-১, হালকা-৩০১-৩২৫), খিত্তা নং-৪ (ঢাকা-২, হালকা-৬০১-৬৩৯), খিত্তা নং-৫ (কক্সবাজার), খিত্তা নং-৬ (মানিকগঞ্জ), খিত্তা নং-৭ (পিরোজপুর), খিত্তা নং-৮ (পটুয়াখালী), খিত্তা নং ৯(১) (টাঙ্গাইল-ক), খিত্তা নং ৯(২) (টাঙ্গাইল-খ), খিত্তা নং-১০ (১) (জামালপুর-ক), খিত্তা নং-১০(২) (জামালপুর-খ), খিত্তা নং-১১ (বরিশাল), খিত্তা নং ১২ (নেত্রকোনা), খিত্তা নং-১৩ (কুমিল্লা), খিত্তা নং-১৪ (মেহেরপুর), খিত্তা নং-১৫ (ঝিনাইদহ), খিত্তা নং-১৬ (ময়মনসিংহ-১), খিত্তা নং-১৭ (ময়মনসিংহ-২), খিত্তা নং-১৮ (ময়মনসিংহ-৩), খিত্তা নং-১৯ (লক্ষ্মীপুর), খিত্তা নং-২০ (বি.বাড়িয়া), খিত্তা নং-২১ (কুড়িগ্রাম), খিত্তা নং-২২ (নোয়াখালী), খিত্তা নং-২৩ (নীলফামারী), খিত্তা নং-২৪ (ঠাকুরগাঁও), খিত্তা নং-২৫ (পঞ্চগড়), খিত্তা নং-২৬ (চাঁপাই নবাবগঞ্জ), খিত্তা নং-২৭ (বগুড়া), খিত্তা নং-২৮ (পাবনা), খিত্তা নং-২৯ (নওগাঁ), খিত্তা নং-৩০ (মুন্সীগঞ্জ-১), খিত্তা নং-৩১ (মুন্সীগঞ্জ-২), খিত্তা নং-৩২ (মাদারীপুর), খিত্তা নং-৩৩ (গোপালগঞ্জ), খিত্তা নং-৩৪ (সাতক্ষীরা), খিত্তা নং-৩৫ (মাগুরা), খিত্তা নং-৩৬ (খুলনা), খিত্তা নং-৩৭ (সুনামগঞ্জ), খিত্তা নং-৩৮ (মৌলভীবাজার) ও ৩৯ (কুষ্টিয়া)।
বিদেশী মেহমানদের আপ্যায়ন: বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে আসা হাজারো মেহমানদের জন্য মাঠের পশ্চিম-উত্তর কোণে নির্মাণ করা হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের আপ্যায়ন ব্যবস্থা। ইংলিশ ও আরবিদের জন্য রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন তাঁবু। যেখানে টেলিফোন ইন্টারনেট থেকে শুরু করে রয়েছে সব ধরনের আধুনিক ব্যবস্থা। খাবারের ক্ষেত্রেও করা হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন আয়োজন। সকালের নাশতায় রয়েছে স্যুপ, ডিম-রুটির পাশাপাশি দুপুর ও রাতের জন্য বিরিয়ানি। এসব রান্নার জন্য দুই শতাধিক জিম্মাদার রয়েছেন বলে জানান মেহমানখানার জিম্মাদার মো. আজিজুল হক।
৪ মুসল্লির মৃত্যু: গতকাল সকাল পর্যন্ত চার মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে তিনজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। (১) পটুয়াখালী জেলার মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন (৩০), (২) লক্ষ্মীপুর সদরের দীঘলিয়া এলাকার মোহাম্মদ আবদুল কুদ্দুস (৬০) (৩)এবং বগুড়ার শাহজাহানপুরের আবদুর রহমান (৬৫)। আরেকজনের পরিচয় এখনও জানা যায়নি। বয়স আনুমানিক ৬৫ বছর। লাশের জিম্মাদার আদম আলী জানান, বৃহস্পতিবার রাত ৩টায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পটুয়াখালী জেলার বিল্লাল হোসেন মারা যান। টঙ্গী হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক (আরএমও) মো. মাহবুবুর রহমান চৌধুরী জানান, ইজতেমা ময়দানের টয়লেটে এক মুসল্লি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে যান। রাত পৌনে ৩টায় তাকে টঙ্গী হাসপাতালে আনলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তার পরিচয় পাওয়া যায়নি।
মাইকের স্বল্পতা: মাইকের স্বল্পতার কারণে ইজতেমা মাঠের বাইরে যারা নামাজে অংশগ্রহণ করেছেন তাদের অনেকেই নামাজের তাকবির ও বয়ান শুনতে পাননি বলে অভিযোগ করেছেন। মুসল্লিদের দাবি, সামনের দিনগুলোতে ইজতেমা কর্তৃপক্ষ যেন ময়দানের চতুর্পাশের এক কিলোমিটার পর্যন্ত মাইকের ব্যবস্থা করা হয়।
যৌতুকবিহীন বিয়ে: বিশ্ব ইজতেমার রেওয়াজ অনুযায়ী আজ বাদ আসর বিশ্ব ইজতেমা মাঠের বয়ানমঞ্চে যৌতুকবিহীন বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে। হজরত ফাতেমা (রা.) ও হজরত আলী (রা.)-এর বিয়ের দেনমোহর অনুসারে বিনা যৌতুকে সম্পন্ন হবে বিয়ে। বর, তাদের অভিবাবক এবং কনের অভিভাবকদের উপস্থিতিতে এসব বিয়ে পড়ানো হবে। বিয়ের পর রেওয়াজ অনুযায়ী উপস্থিত দম্পতিদের স্বজন ও মুসল্লিদের মধ্যে খোরমা খেজুর বিতরণের কথা রয়েছে।
কন্ট্রোল রুম: ইজতেমা মাঠ এলাকায় যে কোন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে এবং নানামুখী কার্যক্রম পরিচালনা করা র‌্যাব, পুলিশ ছাড়া ও জেলা প্রশাসন ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কয়েকটি কন্ট্রোল রুম বসানো হয়েছে। যার মধ্যে নিউ মুন্নু ফাইন কটন মিল ক্যাম্পাসে রয়েছে গাজীপুর সিটি করপোরেশেন ও র‌্যাবের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ। শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার স্টেডিয়ামে রয়েছে জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ। গাজীপুর জেলা প্রশাসক মো. নুরুল ইসলাম জানান, জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে একটি নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র খোলা হয়েছে। যেখানে সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করছেন ২০ জন ম্যাজিস্টেট। যারা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাসহ নানা ধরনের দায়িত্বে রয়েছেন।
ফ্রি মেডিক্যাল টিম: প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় চট আর পলিথিনে টানানো ছাউনির নিচে অবস্থান নিয়ে আর নোংরা পরিবেশে খাবার-পানি গ্রহণ করে মুসল্লিরা নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন। ইজতেমায় আসা মুসল্লির সেবাদানের জন্য নিউ মুন্নু ফাইন কটন মিলের অভ্যন্তরে ফ্রি মেডিক্যাল টিম দিন-রাত কাজ করছে। এর মধ্যে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরের একটি, হামদর্দ, ইবনে সিনা, আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম, আয়ুর্বেদিক ফার্মেসি, জনস্বাস্থ্য, জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের একটি মেডিক্যাল ক্যাম্প রয়েছে। রোগবালাই থেকে রক্ষা করতে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে সেবা গ্রহণ করছেন নানা বয়সী মুসল্লি।
ভ্রাম্যমাণ আদালত: গাজীপুরের জেলা প্রশাসক মো. নুরুল ইসলাম জানান, অবৈধ স্থাপনা ও ফুটপাথের দোকানপাট উচ্ছেদ, বিশুদ্ধ খাবার নিশ্চিতকরণসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালনে ইজতেমা এলাকা ও আশপাশের এলাকাকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করে এসব ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। এসব অঞ্চলে প্রতিদিন দুই সিফটে পাঁচটি করে ১০টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছেন গাজীপুর জেলা প্রশাসনের অধীনে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা।
অজুর পানির সঙ্কট: গাজীপুর জনস্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী জানান, মুসল্লিদের সুবিধার্থে এ বছর ইজতেমা ময়দানে প্রতিদিন নয় কোটি গ্যালন পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। এর পরও গতকাল অজু-গোসলের এমনকি পানির সঙ্কট দেখা দিয়েছে বলে জানান অনেক মুসল্লি। এ প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানান, গতকাল জুমার নামাজে মুসল্লি বেড়ে যাওয়ায় সাময়িক সঙ্কট হয়েছে। বিশুদ্ধ পানির সঙ্কটকে পুঁজি করে সুযোগ-সন্ধানীরা ব্যবসা ফেঁদে বসেছে। প্রতি বদনা অজুর পানি বিক্রি হয়েছে দুই টাকা করে।

No comments

Powered by Blogger.