ঋণখেলাপি হওয়ার কারণগুলো দূর করা দরকার by মোঃ খলিলুর রহমান চৌধুরী

গণমাধ্যমে প্রায়ই ব্যাংকিং খাতের ওপর নানা নেতিবাচক সংবাদ থাকে। এ খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে সুনাম পুনরুদ্ধার করতে হলে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো দূর করা প্রয়োজন। যেমন- খেলাপি ঋণ ব্যাংকিং খাতের অন্যতম সমস্যা। ঋণ প্রদান করা হয় সাধারণত ভূমি, ভবন, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি সম্পদ বন্ধক রেখে। সাধারণত এক-দেড়গুণ (ব্যাংকের মূল্যায়ন অনুযায়ী) সম্পদ জামানত হিসেবে বন্ধক নিয়ে ঋণ প্রদান করা হয়। কিন্তু ঋণ শ্রেণীবিন্যাসের নীতিমালা অনুসারে মঞ্জুরিকৃত ঋণের যোগ্য জামানত বিবেচনাকালে ভূমি ও ভবনের ৫০ শতাংশ মাত্র বিবেচনা করা হয়, যন্ত্রপাতি বিবেচনাই করা হয় না। আবার ঋণের জামানতের ১৫ শতাংশের বেশি মূল্য বিবেচনা করা যায় না। ফলে ঋণ শ্রেণীবিন্যাসের সময় জামানতের ঘাটতি সৃষ্টি হয়, যার কারণে ঋণ সঞ্চিতি সৃষ্টি করতে হয়।
ব্যাংক ঋণগ্রহীতাদের ঝুঁকি ও দায়িত্বে ঋণ প্রস্তাব মূল্যায়ন করে ঋণ প্রদান করে থাকে। ব্যাংকগুলো কেবল বন্ধককৃত জামানত থেকেই ঋণ আদায় করতে আইনগতভাবে বাধ্য নয়। ঋণ গ্রহীতারা ঋণ নিয়েছেন ঋণ ফেরত দেয়ার জন্য। এ ধরনের সংস্কৃতি ও আইনানুগ পরিবেশ যদি বিরাজমান থাকে, আইন-কানুন ও তার প্রয়োগ যদি যথাযথ থাকে, তাহলে আদায়-সন্দেহজনক ঋণের বিষয়ে হিসাবের সঞ্চিতি গড়ে তোলাই ভালো। একসময় এভাবেই সন্দেহজনক ঋণের সঞ্চিতি গড়ে তোলা হতো। কিন্তু বর্তমানে বিদ্যমান ঋণ শ্রেণীবিন্যাসের স্থান, কাল, পাত্র, প্রেক্ষাপট নির্বিশেষে সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য গতানুগতিক গাণিতিক নীতিমালার বিষয়টি বিবেচনায় রাখা কতটুকু যুক্তিযুক্ত, তা খতিয়ে দেখা দরকার। তাই ঋণ মঞ্জুরকালে পর্যাপ্ত জামানত থাকারও বিধান থাকা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিধান অনুসারে কোনো ঋণ তিনবারের বেশি পুনঃতফসিলিকরণ করা যায় না। ঋণের শ্রেণীবিন্যাসের ধরন অর্থাৎ সাবস্ট্যান্ডার্ড, ডাউটফুল, ব্যাড অ্যান্ড লস এবং কতবার ঋণ পুনঃতফসিলি করা হয়েছে ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে ঋণের মেয়াদ ক্ষেত্রভেদে ১২ মাস থেকে ৩৬ মাস পর্যন্ত বৃদ্ধি করার বিধান করা হয়েছে। তাছাড়া ঋণ পুনঃতফসিলিকরণকালে কতবার ঋণ পুনঃতফসিলিকরণ করা হচ্ছে তার ওপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হারে ডাউন পেমেন্ট প্রদান করতে হয়। সাধারণত সমস্যাগ্রস্ত প্রকল্পের ঋণ পুনঃতফসিলিকরণ করার প্রয়োজন হয়। ঋণ পুনঃতফসিলিকরণকালে পেশাগতভাবে দেখার বিষয় হচ্ছে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা যথাযথ আছে কি-না, প্রকল্পের যন্ত্রপাতির উৎপাদন যথাযথ আছে কি-না, ঋণের জামানত সঠিক আছে কি-না, প্রকল্প সম্পদের আয়ুষ্কাল কত, প্রকল্পের প্রাক্কলিত আয় প্রবাহের ভিত্তিতে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে কত সময় লাগবে ইত্যাদি। এসব বিবেচনা না করে সব ক্ষেত্রে গতানুগতিকভাবে ঋণের কিস্তি ও পরিমাণ নির্ণয়পূর্বক ঋণ পুনঃতফসিলিকরণের ফলে কিস্তির পরিমাণ অযৌক্তিক হয়, যা ঋণগ্রহীতারা পরিশোধে ব্যর্থ হয়। এর পরিণতিতে শ্রেণীকৃত ঋণ বৃদ্ধি পায়, প্রভিশনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। ফলে সার্বিকভাবে ব্যাংকের মুনাফায় বিরূপ প্রভাব পড়ে।
যেসব ঋণ আদায়ের কোনোই সম্ভাবনা নেই এবং আদায়ের সব প্রচেষ্টাই নিঃশেষ হয়েছে, সেক্ষেত্রেই কেবল ঋণ অবলোপন করা যায়। অথচ দেখা যাচ্ছে, মামলার নিষ্পত্তি হয়নি, আদায়ের সব প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়নি, আদায়ের সম্ভাবনাও শেষ হয়নি- এমন ঋণও অবলোপন করতে হচ্ছে গতানুগতিক নিয়মনীতির বাধ্যবাধকতার কারণে। অবলোপনকৃত ঋণ ব্যালেন্স শিটের বাইরে থাকছে। ফলে ঋণগুলোর ওপর ব্যাংকের থ্রেড অব ওয়ার্ক শিথিল হচ্ছে। তাছাড়া ঋণগুলো আদায়ের ব্যাপারে ব্যাংকের নৈতিক অধিকারও দুর্বল হচ্ছে। এভাবে একপর্যায়ে অবলোপনকৃত ঋণের সুদও শতভাগ মওকুফ হচ্ছে। তবে ওই ধরনের মওকুফের ক্ষেত্রে ঋণের জামানত বিক্রি এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও আর্থিক অবস্থা যথাযথভাবে বিবেচনায় নিয়েই মওকুফ করা দরকার। ওই ঋণগুলো থেকে আদায়কৃত অর্থ ব্যাংকের হিসাবের খাতায়ই থাকছে। ফলে অবলোপন সংক্রান্ত ঋণ হিসাবগুলোর ক্ষেত্রে ব্যাংকের আর্থিক বিবরণীতে সত্য ও সঠিক চিন্তা প্রতিফলিত হয় না। মন্দ ঋণের ক্ষেত্রে আদায়ের সব প্রচেষ্টা ও সম্ভাবনা নিঃশেষ না হওয়া পর্যন্ত ঋণের সন্দেহজনক সঞ্চিতি গড়ে তুলতেই হয়। এতে অন্তত পাওনার ওপর নৈতিক অধিকার সবল থাকে।
দীর্ঘমেয়াদি ঋণ পুনঃতফসিলি করতে হলে ন্যূনতম ডাউন পেমেন্ট প্রয়োজন হয় ১০ শতাংশ অথচ স্বল্পমেয়াদি ঋণ পুনঃতফসিলি করতে ডাউন পেমেন্ট লাগে ৫ শতাংশ। স্বল্পমেয়াদি ঋণকে পুনঃতফসিলি করে দীর্ঘমেয়াদি করতে হলে সেক্ষেত্রে স্থায়ী জামানত বন্ধক নিয়ে ঋণকে জামানত সমৃদ্ধ করতে হবে কি-না সে ব্যাপারে কোনো স্পষ্ট নির্দেশনা নেই। স্বল্পমেয়াদি ঋণকে যদি দীর্ঘমেয়াদি ঋণেই রূপান্তর করার সুযোগ দেয়া হবে, তাহলে তা এক বছরের জন্যই বা কেন এবং কিস্তিই বা মাসিক হবে কেন? পুরো বিষয়টি প্রকল্পের আয়ুষ্কাল ও আয় প্রবাহের ভিত্তিতেই করা দরকার।
ব্যাংকের মূল কাজ জনগণের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয় সংগ্রহ করে মূলধন সৃষ্টির মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পে বিনিয়োগ করা। তাতে সঞ্চয়কারীরা সঞ্চয় করতে উদ্বুদ্ধ হয়, মুনাফা পায়। অন্যদিকে ব্যবসা-বাণিজ্যের, শিল্পের মালিকরা মূলধনের চাহিদা মেটাতে পারে। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য-শিল্পের সম্প্রসারণ ঘটে এবং জিডিপি ও প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পায়। প্রতিযোগিতামূলক বাজারে যে কম সুদে আমানত সংগ্রহ করে ন্যূনতম মার্জিন রেখে ঋণ প্রদান করতে পারে সে তত দক্ষ ব্যাংকার। এ ধরনের প্রতিযোগিতা সুস্থ অর্থনীতি বিকাশের জন্যই প্রয়োজন। কিন্তু ঋণ প্রদানের প্রবৃদ্ধির ব্যাপারে যদি সিলিং নির্ধারণ করে দেয়া থাকে, অন্যদিকে আমানত সংগ্রহের জন্য যদি কোনো সিলিং না থাকে, তাহলে আমানত সংগ্রহের পর সেগুলো বিনিয়োগ করা সম্ভব হয় না। অনেক সময় সঞ্চয়ের খরচের হারের চেয়ে কম হারে যেনতেনভাবে যেখানে সেখানে বিনিয়োগ করে ব্যাংককে লোকসান দিতে হয়। আবার আমানতকে নিরুৎসাহিত করা ব্যাংকের মৌলিক নীতির পরিপন্থী এবং তা দেশের মূলধন গঠন করার নীতিরও পরিপন্থী।
ঋণ শ্রেণীবিন্যাসের কারণে অনেক ব্যাংককে নেট লোকসান গুনতে হচ্ছে। অনেক ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। প্রভিশন ঘাটতি পূরণ করতে হলে ব্যাংকের লাভ করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। তা করতে হলে প্রথমেই আমানত সংগ্রহ বৃদ্ধির পাশাপাশি ঋণ দান বৃদ্ধি করতে হবে। প্রশ্ন উঠতে পারে, দেশে বর্তমান খেলাপি সংস্কৃতির পরিবেশে সমাজে ঋণ দান করলেই খেলাপি হবে, অতএব কোনো ঋণ দেয়া ঠিক হবে না। তাই বলে ব্যাংক ঋণদান বন্ধ করে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। কাকে ঋণ দেয়া হলে খেলাপি হবে না, তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এজন্য যা করা দরকার তা-ই করা উচিত।
ব্যাংকিং খাত পরিচালনার জন্য কিছু মৌলিক নীতিমালা থাকা উচিত, যেমন- সার্ভিস রুল, অর্গানোগ্রাম, নিয়োগ ও পদোন্নতি নীতিমালা ইত্যাদি। বাংলাদেশ ব্যাংকেরও নির্দেশনা এ রকম। অর্থাৎ পরিচালনা পর্ষদ ব্যাংকের জন্য প্রয়োজনীয় নীতিমালা অনুমোদন করবে এবং সিইও সেই নীতিমালা অনুসারে ব্যাংক পরিচালনা করবে। ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য নীতিমালাগুলো অনুমোদিত, জারিকৃত ও পরিপালিত হওয়া উচিত। এ নিয়মের ব্যত্যয় কাম্য নয়। ব্যাংক পরিচালনা করতে হলে কর্মকর্তাদের মধ্যে সচেতনতা জাগ্রত রাখতে হবে। এজন্য প্রত্যেক কর্মকর্তা তথা ব্যাংকের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সর্বনিু পর্যন্ত পদোন্নতি, ইনক্রিমেন্ট, ভালো কাজের পুরস্কার, মন্দ কাজের শাস্তির বিধান থাকতে হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, সিইওর নিচে বিভিন্ন স্তরে অনেক কর্মকর্তা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগকৃত এবং লাইন ম্যানেজমেন্টে কর্মরত, যাদের ক্ষেত্রে ব্যাংকের সার্ভিস রুল প্রযোজ্য নয়। তাই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগকৃত কর্মকর্তারা কাজকর্মে ব্যাংকের নিয়মনীতির প্রতি থাকেন উদাসীন ও অমনোযোগী।
মোঃ খলিলুর রহমান চৌধুরী : ব্যাংকার

No comments

Powered by Blogger.