অটোগ্রাফ by মাসউদ আহমাদ

মাসটা ছিল আষাঢ়ের, অথচ বৃষ্টির কোনো নামগন্ধ ছিল না। বিকেলের নরম আলোর দীর্ঘ ছায়া পড়েছে পল্টনের বড় দালানের গায়ে। তিন দিন পর কোরবানির ঈদ, ঢাকা শহর প্রায় ফাঁকা হয়ে আসছে। পল্টন মোড়ে বাস-রিকশা-সিএনজি আর মানুষের কোলাহলে চলা যায় না, আজ ওসব নেই। কিন্তু এমন নয় যে হাঁটতে গিয়ে পথচারীর ছায়াও গায়ে পড়বে না, কিংবা পাশ কাটাতে নিতে হবে না সামান্য কৌশলও। বায়তুল মোকাররমের বিপরীতে আজাদ প্রোডাক্সের গলিতে একটু কাজ আছে জামিলের। পান্থ দেবনাথ আজই চলে যাবে কুমিল্লা। সে বলেছিল, সম্ভব হলে জামিল যেন একবার দেখা করে। দরকারি কথা আছে। জামিলের পৌঁছানোর কথা বিকেল পাঁচটায়। পল্টন মোড় পেরিয়ে সে পূর্ব দিকে পা চালায়। এমন সময় বলা নেই কওয়া নেই শুরু হলো তুমুল বৃষ্টি। ছোট ছোট ফোঁটা হলে নির্দ্বিধায় হেঁটে যাওয়া যেত। কিন্তু বৃষ্টির ফোঁটাগুলো বেশ বড়সড়। তেজী। অনিচ্ছুক বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর-মাথাব্যথা বাধিয়ে কাজ নেই—ভাবে সে। নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে মানুষ প্রায় দৌড়াচ্ছে। জামিল নিজেও আশ্রয় নিল ফুটপাতের এক পুরোনো বইয়ের দোকানে। ইদানীং এসব দোকানে তেমন ঢোকা হয় না, কিন্তু একসময় অভ্যেস ছিল। ঢাকায় আসার পর প্রথম প্রথম এই পথ বড় প্রিয় ছিল তার। কাঙ্ক্ষিত একটি বই কম দামে পাওয়ার লোভে আঠার মতো লেগে থাকত। কলকাতার লেখকের অরজিনাল কোনো বই, বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত দুর্লভ বইয়ের প্রথম সংস্করণ, হোক তা নিউজপ্রিন্টে ছাপা কিংবা উইপোকায় খাওয়া; বইয়ের গন্ধে প্রায়ই আসা হতো। এখন সময় হয় না। বদলে গেছে বইয়ের খোঁজে আকুল হওয়ার সেই ভালোলাগাটুকুও।
ঘড়িতে সময় দেখে একবার আকাশে চোখ রাখে জামিল। বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণ নেই। অনেকক্ষণ চেপে রাখা দীর্ঘশ্বাসটা নিঃশব্দে বেরিয়ে যায়। বাস থেকে নামার আগে থেকেই মাথায় খোঁচা দিচ্ছিল ব্যাপারটা। পল্টনে চৌরাস্তা পেরোনোর সময়ও ভাবনাটা ফুরিয়ে যায়নি, শেষ হয়ে যাওয়া পারফিউমের মতো রেশ রেখে গিয়েছিল। ঈদে জামিল এবার বাড়ি যাচ্ছে না। ঢাকায় থাকবে। দেশের বাইরেও যেতে পারে। সিদ্ধান্ত ফাইনাল। এটা নিয়েই হয়তো কথা বলতে চায় পান্থ। বলবে, বাড়ি যাও। ঈদে কেন একা ঢাকায় থাকবা? গ্রামের বাড়িতে সবাই পথ চেয়ে থাকে... ইত্যাদি। অথবা অন্য কোনো কাজের কথাও হতে পারে। বন্ধু হিসেবে পান্থ খারাপ না ভালো, সেটা বড় কথা নয়। সে এই শহরে জামিলের প্রথম বন্ধু। পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মোছে জামিল। ভাবনাটুকু প্রতিপক্ষ হয়ে আবার সামনে এসে পড়ে—কয়েকটি মুখ আর মানুষ নিয়ে যে সংসার, সুখের বিংবা বঞ্চনার, একটা সময়ে ধীরে ধীরে তাতে অদৃশ্য দেয়াল তৈরি হয়। সংসার বড়ই বিচিত্র। অথবা সংসার মানে হয়তো পুরো পৃথিবীই—যেখানে প্রত্যেকেই আমরা নীরব জিঘাংসু। এখানে একজনকে লাথি মেরে আরেকজন বড় হতে চায়। জামিল এমন করে ভাবে। আবার ভাবেও না। অত ভেবে কী লাভ!
অনেকের সাঙ্গেই মেলে না তার। বাস্তবের চেয়ে স্বপ্ন-কল্পনাকে নিয়েই আছে জামিল। তাই সে উন্মাদ হয়ে গেছে; অনেকের অভিযোগ। কারও মতো হতে পারেনি সে। নিজের মতো হওয়ার চেষ্টাটুকুও যে তার আছে, হলফ করে এমনও বলতে পারে না। তার মনে হয়, গ্রামের বাড়িটা জীবনের চূর্ণ-বিচূর্ণ আশা ও স্বপ্নের একটা ভগ্নস্তূপ। বরং বসবাসের প্রায় অযোগ্য ঢাকা শহরের ভয়াল পথঘাট, রমনা পার্কের নিঃসঙ্গ গাছের ছায়া, শাহবাগের ব্যস্ত-ক্লান্ত-বারোয়ারি বাতাস কিংবা আজিজ মার্কেটের থমকে থাকা আড্ডাটুকুই জীবনের কাছে ঢের প্রসন্ন। দোকানের পলিথিনের ছাদ ফুঁড়ে এক ফোঁটা বৃষ্টির পানি পড়ল জামিলের মাথায়। বিরক্তি নিয়ে মাথায় হাত রাখতে গিয়ে হঠাৎ চোখ আটকে গেল সাজানো বইয়ের পুটে। রবীন্দ্রনাথ-হুমায়ূন-ইকবাল-আনিসুল হকের বইয়ের পাশে হঠাৎ সে দেখে তার নিজেরই লেখা উপন্যাস—তোমার বসন্ত দিনে। অস্বস্তিময় পরিবেশেও একঝলক আনন্দময় অনুভূতি খেলে যায় জামিলের বুকের ভেতর। বাহ্, মজার ব্যাপার তো! থমধরা সব ভাবনা সটকে পড়ে নিমেষে। পকেটমারের মতো সতর্ক-লাজুক চোখে সে একবার বইয়ের দিকে, একবার আকাশে চোখ রাখে। ভাবে, বইটা হাতে নিয়ে দেখবে। এ যে কুড়িয়ে পাওয়া নিজের সন্তান! কৌতূহল বড় সংক্রামক জিনিস। জামিল হার মানে। মন ভালো নেই—অজুহাতে ইদানীং কোনো কিছুই লেখা হয় না। কিন্তু একটা সময়ে, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষ পর্যায়ে এবং ঢাকায় এসেও, লেখকই হব—এমনই ছিল পণ। একটি প্রার্থিত বাক্য ও কাঙ্ক্ষিত আখ্যানকে মাথার ভেতর ধারণ করতে, কোনো এক মোহনীয় সংলাপের গর্ভে জীবনের বীজ রোপণ করার জন্য একদা অজস্র বেদনার কণা বুকে গেঁথেছে সে। প্রিয় মানুষের স্নিগ্ধ মুখ দেখতে, এতটুকু স্পর্শ পেতে মন যেমন অধীর হয়, লেখার অনুভূতিও তেমনই গাঢ় ও সংবেদী। বুকের তোরণে সেসব হয়তো আজও তোলা আছে। কিন্তু হয় না। কোনো লেখাপত্র এখন আর ভূমিষ্ঠ হয় না।
তাতে হয় কী—লেখার ভাবনা ও অভিপ্রায় মাথায় গুনগুন করতে করতে একসময় হারিয়ে যায়। এই শহরে ওসব শিল্পরসিকতা কোনো কাজে লাগে না। ঢাকা এক মনোহর স্বপ্নের শহর। স্বপ্ন-ভঙ্গেরও কি নয়? ভাবে জামিল। কর্পোরেট জীবনে প্রতিষ্ঠা পেতে গেলে শিল্পপ্রেম, আরাধনা-প্রচেষ্টা এক দুষ্টু প্রতিবন্ধকই বটে। প্রতিষ্ঠা জামিল ঠিকই পেয়েছে। বিদেশি এনজিওতে কাজ করছে ভালো পদে। এখন বরং লেখালেখির জগৎ থেকে আড়ালে গিয়ে, পালিয়ে থেকে সে নির্ভার, দায়মুক্ত বোধ করে। অজান্তেই হাত চলে যায় বইয়ের দিকে। ততক্ষণে কমে এসেছে বৃষ্টি। নিজের বইটা হাতে নিয়ে সে প্রচ্ছদটি দেখে, পাতা ওল্টায়। উৎসর্গ পাতায় পোঁছার আগেই, রমণীয় হস্তাক্ষরে চোখ আটকে যায় তার। সুন্দর হাতের গোটা গোটা কাঁচা কালো অটোগ্রাফ বদলে দেয় জামিলের বিকেলটাকেই: ‘প্রিয় রাহুল, ভালো ও সুন্দর থেকো। আমি আজও প্রতীক্ষা করি তোমার পদশব্দের।—নীলিমা’। বইয়ের দোকানে পলিথিনের নিচে আটকে পড়া, বৃষ্টিভেজা পথ, বন্ধুর সঙ্গে দেখা, গম্ভীর ভাবনার কচকচানি—মুহূর্তে সব ভুলে যায় সে। কাঁচের মার্বেলের ভেতরের রঙিন ফুলের মতো নীলিমা নামটি গেঁথে যায় মনের ভেতর। জামিলের মন ভরে ওঠে এক নীলাভ শুভ্রতায়। মনে হয়, তার উপন্যাসের চেয়েও অনেক সুন্দর, স্বপ্নময় ও সার্থক নীলিমার শুভকামনা। তাঁর প্রার্থনার কাছে উপন্যাসের আখ্যানটি খুবই সামান্য। আটপৌরে। পুষ্পিত সৌরভ হয়ে নীলিমা উড়তে থাকে জামিলের অনুভবের জানালায়।
হার্টবিটও কী একটু বেড়ে যায় জামিলের?
বই উপহার-পাওয়া তরুণ বড় ভাগ্যবান, ভাবে সে। পরমুহূর্তেই মনে হয়, এই বই পুরোনো বইয়ের দোকানে এল কী করে? এল কেন? হতভাগা তরুণ বুঝি এর মূল্য বুঝল না। এমন কী হতে পারে, এ বই তাদের বিচ্ছেদের স্মৃতি? অথবা এটা কি ছিল ভালোবেসে দেওয়া নীলিমার শেষ উপহার! ভাবনাগুলো ধারণাপ্রসূত, নির্মম ও একপেশে।
‘মামা, বইটা কি লইবেন?’
জামিল ধাতস্থ হয়। দোকানির চোখে তাকায়, ‘কত ভাই?’
‘একদাম ৪০ টাকা।’ দাম মিটিয়ে বন্ধুর খোঁজে ছুটে বেরিয়ে পড়ে সে। কিন্তু নীলাভ অস্তিত্ব হয়ে নীলিমা চলতে থাকে তার সঙ্গে। মনে হয়, এখন আকাশ গাঢ় নীল। মতিঝিলগামী ৮ নম্বর লোকাল বাসের রংটাও নীল, পিচঢালা পথ নীল গালিচায় মসৃণ। এই ঘনায়মান গোধূলিতে বুক পকেটের কলমের মাথায় নীল জোনাকি বসে আছে। বৃষ্টিভেজা মুহূর্তটুকু কেমন অলৌকিক হয়ে ওঠে। নীলিমার প্রার্থিত পুরুষ মনে হতে থাকে নিজেকে। নতুন জায়গায় বেড়াতে গেলে, সেখানকার আলো-বাতাস-গন্ধ-মানুষের স্বভাব, খাদ্য যেমন অভিনব ও আনকোরা ঠেকে, তেমনি বিচিত্র অনুভবে ডুবতে থাকে জামিল, ডুবে যায়।
২.  নওয়াব আলি টাওয়ারের পাঁচতলায় সিঁড়ি ভেঙে ওঠে সে। বিদ্যুৎ নেই। লিফট বন্ধ। পান্থকেও পাওয়া যায় না। অফিসের পিওন জানায়, দুপুরের বাসে চেপে সে বাড়ি চলে গেছে। রাতে বাসায় ফেরার পর কেমন অস্থির লাগে জামিলের। অকারণে নাক ঘামে। পিপাসা পায়। বারুমে ঢুকে চোখেমুখে পানির ঝাপটা দেয়। ফ্রেশ হয়। অস্বস্তি কাটে না। আবার যায় বাথরুমে। শাওয়ার ছেড়ে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকে ঝরনার নিচে। তারপর শরীরে কাঁপন দিয়ে উঠলে ঘরে আসে। এরপরের ঘটনা বেশ কৌতুকময়, কিন্তু খুবই সংক্ষিপ্ত। নীলিমার অটোগ্রাফ দেওয়া পাতাটি স্ক্যান করে জামিল। কিছু কথা লিখে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়: ‘তুমি জানবে না, জানবে না অন্য কেউ, তবু খুঁজে ফিরি তোমাকেই, হে অচেনা সুহাসিনী!’ সে নিজে যদিও পছন্দ করে না, তবু ঝোঁকের মাথায় করে বসে কাজটি—দুজন বন্ধুকে ট্যাগ করে পোস্টটি। পরের তিন দিন জামিল ঢাকার বাইরে থাকে, অফিসের কাজে। ফেসবুকে বসার ফুরসত হয় না। ছুটির দিনে বেশ বেলা করে ঘুম ভাঙে তার। ফেসবুক খোলে সে। ইনবক্সে বন্ধু নয় এমন আইডি থেকে একটি টেক্সট পায়, সঙ্গে ফোন নম্বর।
৩. মিরপুর সাড়ে এগারো থেকে বেশ ভেতরে, রিকশায় কিছুক্ষণ গেলে একটা মোড়। সেখানে নেমে পায়ে হেঁটে পাক্কা সাত মিনিটের পথ। জামিল যখন ঠিকানা খুঁজে পেল, দিনের আলো ফুরিয়ে এসেছে। বাড়ির ভেতরে বেহালা বাজছে। সে আন্দাজ করার চেষ্টা করে, কে হতে পারে শিল্পী? নীলিমা! দরজায় দাঁড়িয়ে কলবেলে হাত রাখে জামিল। দরজা খুলে যায়। বেরিয়ে আসে শাড়িপরা দীর্ঘাঙ্গী এক শ্যামলা মেয়ে। ‘ও আপনি জামিল? আসুন। আমিই নীলিমা সেন।’
‘নীলিমা হিন্দু? জুতা খুলতে গিয়ে জামিলের ভ্রু কেঁপে ওঠে সামান্য।’
পরিচয়পর্ব শেষ। লজ্জিতভাবে নীলিমাকে দেখতে থাকে জামিল, ‘নিতান্ত কৌতূহলে ছেলেমানুষী করে ফেলেছি আসলে। এটা আমার উচিত হয়নি।’ জামিলের কথায় লাজুকচোখে হাসে নীলিমা। বলে না কিছুই। কেবল পূর্বাপর ঘটনা-পরম্পরাটুকু সংক্ষেপে বলে জামিল। এক বৃদ্ধার কাশির শব্দ শোনা যায়। জামিলকে চা-নাশতা দেয় নীলিমা, ‘শুধু চা নিলেন? আমার মা। একটু অসুস্থ। বয়স হয়েছে তো!’
মেয়েটির কথা বলার ভঙ্গিটি সুন্দর। জামিল মুগ্ধ হয়ে শোনে। কিন্নর কণ্ঠ সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই, সেটি যদি মিষ্টি ও মনোরম হয়, তবে তা নীলিমার কণ্ঠের মতোই হবে মনে হয়।
মুখোমুখি সোফায় বসা নীলিমা, ‘প্লিজ একটু মুখে দিন!’
জামিল মুখটিপে হাসে।
দেয়ালে ঝোলানো একটানে আঁকা রবীন্দ্রনাথের দিকে একপলক তাকায় নীলিমা। মোক্ষম কথাটুকু তখনই বের হয় হয় তার মুখ থেকে, ‘একজনের প্রেমে পড়েছিলাম একসময়। বয়সে একটু জুনিয়র। সেই প্রেম ছুটেও গেছে। ছুটে যায়। এখন প্রেমের সেই আকর্ষণ আর নেই। প্রেমের আকর্ষণ আসলে থাকেও না সারা জীবন। আকর্ষণটা মন থেকে খসে সংসারের চাহিদাপত্রের মধ্যে ঢুকে যায়।’
জামিল টের পায়, কোনো কোনো নারী
থাকে যার সঙ্গে কথা বলা, চুপ করে থাকা দুই-ই সমান আনন্দের। নীলিমা তেমনই একজন। কিন্তু তার চোখ দেখে আলাদা কিছু ভাবছে না তো সে? বোকা লেবেনডিস প্রেমিকপ্রবর লেখক? কারও কারও অনুভবশক্তি খুব প্রখর। দৌড়বাজ ঘোড়াকে যেমন চেনা যায় দাগামার্কা দেখে, তেমনি প্রেমিক যুবককেও চেনা যায় তার ভাবাকুল চোখ দেখে।
হাতের উল্টো পিঠে নাকটা ঘষে নীলিমা, ‘ওই আর কী। এখন নিজের মতো স্বাধীনভাবে থাকি। একা। ভালো আছি।’
চায়ে চুমুক দেয় জামিল। চিনি একটু বেশি হয়েছে। সবকিছু সে একটু কম কম পছন্দ করে।
‘...একসময় খুব বই পড়ার নেশা ছিল। একটু গানও করতাম। এখন আর হয়ে ওঠে না। বই উপহার পেলে খুব আনন্দ হতো।’
আপনি বিয়ে করেছেন?—কোনো মেয়েকে সরাসরি কি এমন কথা জিজ্ঞেস করা সম্ভব, নাকি উচিত? নীলিমার সঙ্গে তার নির্মল বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে পারে, জামিল ভাবে। একবার হাত বাড়িয়ে দেবে নাকি? কিন্তু কী ভেবে অন্য প্রসঙ্গ তোলে, ‘আপনার বসার ঘরটি সুন্দর।’
পুলিশের ট্রাকে বিয়ের শাড়ি কি মানানসই? নীলিমার চোখের রং যেন নির্মম এক স্থিরচিত্র। শুকনো। অনুভূতিশূন্যও কি?
আর দাঁড়ায় না জামিল, ‘আজ তাহলে চলি। আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে ভালো লাগল।’
সে মুহূর্তে ঝড়ের বেগে ছুটে এল চঞ্চল এক বালক, ‘আম্মু, দেখো কী সুন্দর পিস্তল! বাবা এসে দিয়ে গেল। বাবা এমন কেন? বাসায় আসে না। আবার যদি আমার কাছে আসে বাবার বুকে গুলি করে দেব। ফুটুস!’
জামিল থমকায়।
নীলিমা কৈফিয়ত দেবার ভঙ্গিতে বলে, ‘আসলে আমি একবার ফাঁদে পা দিয়েছিলাম। রাহুলের কাছে। স্বেচ্ছায়। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। জীবনের কিছু ক্ষেত্রে কম্প্রোমাইজ করতে হয়। ছাড় দিতে হয়। আমি পারিনি। রিফাত আমারই সন্তান। আমাদের বিয়ে হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু রাহুল অস্বীকার করেছিল রিফাতকে। এই সন্তান নাকি তার নয়!’
‘তোমার বসন্ত দিনে কখন গিফট করলেন তাঁকে?’
‘বিয়ের আগে, ওর জন্মদিনে। আসলে ফেসবুকে তেমন বসা হয় না। কাছের মানুষকেই বুঝে উঠতে পারি না, দূরের মানুষকে কেমন করে বুঝি, বলুন। একদিন আমার এক বন্ধুর ওয়ালে আপনার পোস্টটা দেখলাম। অবাকই হয়েছিলাম, জীবন কী অদ্ভুতভাবে মানুষকে মুখোমুখি দাঁড় করায়!’
রিফাতকে কাছে টেনে ওর মাথায় হাত রাখে নীলিমা, ‘এখন আর স্বপ্নটপ্ন দেখি না। দুঃস্বপ্নের ঘোরে আকুল হই কখনো কখনো। নিজের ভেতরেই ঢেকে রাখি। এসব নিয়েই আছি।’ খানিক ধরে এসেছে নীলিমার গলা, ‘এখন স্কুলে পড়াই আর সংসার সামলাই, সময় ও মনের মর্জি থাকলে রেওয়াজ করি, আর একটু সেলাইয়ের কাজ—এভাবেই আছি। সময় চলে যায়। সময় চলে গেলে জীবনের আর কী থাকে বলুন! এখনো ৪০ পেরোইনি, তবু জীবনের সব রং ও অনুভূতি কেমন যেন ধূসর-বিবর্ণ মনে হয়। অনেক কথা বললাম। কিছু মনে রাখবেন না।’ নীলিমার মধ্যে একটি দীর্ঘশ্বাস আড়াল করার প্রবল চেষ্টা। বিদায় নিয়ে জামিল নেমে পড়ে রাস্তায়। ঘড়িতে সময় দেখতে গিয়েও দেখতে ভালো লাগছে না এখন। অচেনা একটা অস্বস্তি ঘিরে ধরেছে। নীলিমার ঠিকানা খুঁজে ফেরার আদৌ কোনো দরকার ছিল? জামিল ভাবে। ভেবে চলে—একা, একাই তো!

No comments

Powered by Blogger.