গাজার এতিম শিশুরা

ফিলিস্তিনের গাজার আট বছরের শিশু আয়শা আল শিনবারির মতো অসংখ্য শিশু বিমানের গর্জন শুনলেই ভয় পায়। এ শব্দ তাদের কাছে খুব বেশি পরিচিত। তারা ভাবে, মৃত্যুদূতের আওয়াজবোধ হয় এমনই। বলছিলাম গাজায় অবস্থিত আল আমাল ইনস্টিটিউট ফর অরফানস-এর শিশুদের কথা। তারা হয়তো ডোনাল্ড ডাক কার্টুনের চরিত্র নিয়ে কল্পনা করতে পারতো। নিজের রুমের দেয়ালে আঁকতে পারতো রূপকথার গল্পগুলোর চরিত্র। কিংবা হয়তো ঘুমোতে যেতে পারতো টেডি বিয়ার বুকে নিয়ে। কিন্তু তারা আঁকে যুদ্ধ। রকেট আর ইসরাইলি যুদ্ধবিমানের ছবিই তাদের মনে গেঁথে আছে বেশি। তারা নিজ চোখে সহ্য করেছে মানুষের দেশ ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ার দৃশ্য। পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র আর শুদ্ধ চিন্তা যে জায়গায় থাকার কথা, সেটি যেন এখন অন্ধকারাচ্ছন্ন এক জগতের দখলে। এ শিশুরা সম্প্রতি বিশ্বে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনাগুলোর একটির সাক্ষী। এ শিশুদের নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আল জাজিরা। আট বছরের শিশু আয়শা আল শিনবারি বলছিল, আমি যখনই বিমানের গর্জন শুনি, আমি ভয় পাই। যুদ্ধের সময় আমি আমার ঘর হারিয়েছি। আমি সেসব মনে করতে চাই না। আমি চাই, আমি মরে যাই, যাতে আমার মায়ের কাছে পৌঁছতে পারি। আয়শা আমাল ইনস্টিটিউটে এসেছে বেশ কয়েক বছর আগে, যখন তার বাবা স্বাভাবিকভাবে ও তার ভাই ইসরাইলি বিমান হামলায় মারা যায়। তার মায়ের পক্ষে সব শিশুর দায়িত্ব সামলানো সম্ভব ছিল না। ২০১৪ সালের যুদ্ধের সময় সব শিশুকে পাঠিয়ে দেয়া হয় তাদের আত্মীয়দের কাছে। তখন আমাল হয়ে উঠেছিল শ’ শ’ বাস্তুচ্যুত গাজাবাসীর আশ্রয়। আয়শাকেও তখন তার মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এর কিছুদিন পরই, তার মাও তাকে ছেড়ে চলে যান। এক ইসরাইলি বিমান হামলায় নিহত হয়েছিলেন তার মা। মাকে এখন কেবল স্বপ্নেই দেখতে পায় আয়শা। তার মা স্বপ্নে আসে, নিজের ছোট্ট মেয়েকে চুম্বন দিয়ে জড়িয়ে ধরে, এরপরই হারিয়ে যায়। এরপর আয়শা জেগে ওঠে। আমাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আয়শা রকেটের ছবি আঁকে। দখলকৃত গাজা উপত্যকায় আয়শার গল্পটি একদমই অস্বাভাবিক নয়। এখানেই ৫১ দিন ধরে ধ্বংসলীলা চালিয়েছিল ইসরাইলি সামরিক বাহিনী, যার ফলে নিহত হয় ২২০০-এরও বেশি ফিলিস্তিনি। নিহতের চেয়েও আহতের সংখ্যা আরও বেশি। এ যুদ্ধের ফলে এতিম হয়েছে ১৫০০-এরও বেশি শিশু। গাজায় আগে থেকেই বাস করছে হাজারো এতিম শিশু। এ কথা বলছেন, আমাল ইনস্টিটিউটের বোর্ড অব ডিরেক্টরিজের চেয়ারম্যান আলমাজেদ আলখোদারি। আমাল ইনস্টিটিউট নামের এতিমখানাটি প্রায় ৬ দশক আগে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এখনও প্রতিষ্ঠানটি গাজা শহরের এতিমদের একমাত্র এতিমখানা হিসেবে টিকে রয়েছে। শহরের এতিমদের দায়িত্ব নেয়া এ সংস্থার পক্ষে সম্ভব হয় না। সবচেয়ে গরিব শিশুদের দায়িত্ব নেয় আমাল ইনস্টিটিউট কর্তৃপক্ষ। ২০১৪ যুদ্ধের পর, এখানে বাস করা এতিমদের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে ১৫০-এ দাঁড়ায়, যা প্রতিষ্ঠানটির ইতিহাসের সর্বোচ্চ। সামনের বছরগুলোতে এ সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। এজন্যই ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এ সংস্থার সামর্থ্য বৃদ্ধি করা হয়েছে, যাতে আরও শিশুকে আশ্রয় দেয়া যায়। প্রতিষ্ঠানটির আরেক বোর্ড সদস্য মেকবিন বলেন, যেসব শিশুর পরিবারই নিঃশেষ হয়ে গেছে, তাদের মানসিক পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ। তাদের মধ্যে এমনও হয়েছে, হয়তো বাজারে গিয়েছিল কিছু কিনতে, কিন্তু এসে দেখে পুরো পরিবারের সবাই নিহত। তারা ঘুমায় না। সব সময় ভয়ে থাকে। আমরা তাদের পাশে যত বেশি সম্ভব থাকার চেষ্টা করি, যাতে তারা আশা ফিরে পায়। নাওয়াল ইয়াসিন নামের এক শিশু আমালে গত অক্টোবর থেকে থাকছে। নাওয়াল জানায়, তার এক চাচা হামাস সদস্য ছিলেন। তার বাবার মৃত্যুর আগে ওই চাচাকে ফোন দিয়েছিল ইসরাইলিরা। তার চাচা ফোনটি তার বাবার কাছে দেয়। তার বাবা বলেছিল, তোমরা আমার ভাইয়ের কাছে কি চাও? ফোনের অপর পাশ থেকে উত্তর দেয়া হয়েছিল, তুমি যেখানেই তোমার ভাইকে লুকিয়ে রাখো না কেন, আমরা অনুসরণ করবো ও হত্যা করবো। তখন তার বাবা ইসরাইলির মুখের ওপর বলেছিল, আমরা তেল আবিব আসবো ও তোমার মোকাবিলা করবো। এ কথা বলার সময় নাওয়ালের মুখ থেকে যেন গর্বের উজ্জ্বল আলোকরেখা বিচ্ছুরিত হচ্ছিল। অথচ, অন্য সময় সে সব সময় গম্ভীর হয়ে থাকে। এতিমদের দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা রেওয়াদা কাসাব খুব ভদ্রভাবে কথোপকথনে হস্তক্ষেপ করেন। তিনি ব্যখ্যা করে বলেন, এ রকমটা আসলে ঘটেনি। তার মা তাদের এ কথা বলেছিল, যাতে নিজেদের বাবাকে তারা একজন নায়ক হিসেবে সারাজীবন মনে রাখে। ইসরাইলি মিশাইলের স্রাপনেল বুকে বিদ্ধ হয়ে মারা গিয়েছিল নাওয়ালের বাবা। তাকে চেনার কোন উপায়ই অবশিষ্ট ছিল না। পরে তার গায়ে পরিহিত জালাবিয়া পোশাক দেখে তাকে শনাক্ত করা হয়। খান ইউনুস থেকে আসা ১১ বছর বয়সী মানাল আবু তাইয়েমা তার বাবার মৃত্যুর ঘটনাটি স্পষ্টভাবে মনে করতে পারে। তার বাবা তাদের বলছিল, জানালার ধারে যেও না। এ কথা বলার কয়েক মুহূর্ত পরই দুটি মিশাইল আঘাত করে তাদের ঘরে। কাঁপাকাঁপা গলায় মানাল তাইয়েমা বলছিল, একটি মিশাইল আমার কাজিনের ওপর পড়েছিল। মুহূর্তেই তার দেশ ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে। অপর মিশাইলটি পড়েছিল আমার বাবার ওপর। বাবার মাথার খুলি উড়ে যায়। কাঁপা গলায় বলে যেতে থাকে মানাল। আমি যখনই অ্যাম্বুল্যান্সের সাইরেন শুনি, আমি কাঁদতে থাকি। কেননা, আমি যুদ্ধের সময় এমন শব্দ অনেক শুনেছি। আমি এই এতিমখানায় নিরাপদ বোধ করি, কিন্তু গাজা শহরে নয়। আমার সব সময় মনে হয়, নতুন করে আবার যুদ্ধ হবে। ১৪ বছরের ইউসেফ আল শিনবারি নিজের প্যান্ট ওপরে তুলে পায়ের ক্ষতচিহ্ন দেখায়। তার পায়ের গোড়ালিতে আঘাত করেছিল স্রাপনেলের তপ্ত লোহা। তার পরিবারের সঙ্গে তখন সে আশ্রয় নিয়েছিল জাতিসংঘ পরিচালিত একটি বিদ্যালয়ে। কিন্তু সেখানেও রক্ষা হয়নি তাদের। তার বোন হামলায় উভয় পা হারিয়েছে। পরে তাকে তুরস্কে পাঠানো হয়েছিল চিকিৎসার জন্য। থেমে থেমে তোতলাতে তোতলাতে ইউসুফ বলে, আমি যখনই তাকে দেখি, তখনই ভয় পাই। আমি মনে করতে পারি, কি ঘটেছিল। আমাল ইনস্টিটিউটের বোর্ড সদস্য মেকবিন বললেন, কেউ এসব ভুলবে না, বিশেষ করে শিশুরা। নিজেদের পরিবারকে কখনোই ভুলবে না শিশুরা। সব ফিলিস্তিনির এখনও ১৯৪৮ সালের ঘটনাগুলো মনে আছে, যখন আমাদের ভূমি জোর করে নিয়ে নেয়া হয়েছিল। ইসরাইলিরা চায়, আমরা যাতে সেসব ভুলে যাই। কিন্তু আমরা কখনোই ভুলবো না।

No comments

Powered by Blogger.