‘ব্যর্থ রাষ্ট্র ঠেকাতে সংলাপে বসুন’

বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে দ্রুত সংলাপ অনুষ্ঠানের তাগিদ দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর ড. এমাজউদ্দিন আহমেদ। বলেছেন, যারা ক্ষমতায় আর যারা বিরোধী জোটে আছে তাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানের জন্য। যদি দলগুলো এই আলোচনায় না বসে, আর এভাবে চলতে থাকলে খুব শিগগিরই এই দেশ ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবে। এতে কোন সন্দেহ নেই। শুক্রবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে সেন্টার ফর ন্যাশনালিজম স্টাডিজ আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিয়ে তিনি এসব কথা বলেন। বৈঠকের মূল বিষয় ছিল ‘জাতি গঠনে বাধা এবং সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ’। বৈঠকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে সংলাপের গুরুত্ব তুলে ধরে ড. এমাজউদ্দিন বলেন, বিশ্বে শতাধিক রাষ্ট্রে সংসদ চালু রয়েছে। তারা বিরোধী দলকে সঙ্গে নিয়েই সরকার পরিচালনা করে। রাজনীতির দায়িত্ব সমস্যার সমাধান করা। সমস্যা সৃষ্টি করা নয়। ঐক্য সৃষ্টি করা। বিভক্তি নয়। ক্ষমতাসীন ও বিরোধীদের একত্রিত হয়ে রাষ্ট্রপরিচালনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। এটাই গণতন্ত্র। মুক্তিযোদ্ধারা এই স্বপ্নই দেখেছিল। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হয়ে থাকে তবে সে চেতনাকে জীবন্ত করতে হলে একসঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। রাষ্ট্র ব্যর্থ হওয়ার পেছনে রাজনীতিবিদদের গায়ের জোরে ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা দায়ী উল্লেখ করে এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেন, সামপ্রতিক সময়ে নিম্ন আদালতের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বিচার বিভাগের ওপর থেকে মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। বাংলাদেশ এখনও ব্যর্থ রাষ্ট্র হয়নি। তবে এভাবে চলতে থাকলে এটা ব্যর্থ রাষ্ট্র হয়ে যাবে। সবকিছু হচ্ছে অব্যবস্থাপনার কারণে। সংলাপের মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আলোচনার লক্ষ্য হবে সুষ্ঠু একটি নির্বাচন। জনগণের ম্যান্ডেট হচ্ছে ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতার নৈতিক ভিত্তি। ২০১৪ সালে যে প্রহসনের নির্বাচন হয়েছে তাতে জনগণের ম্যান্ডেট ছিল না। ১৫৩ আসনে ক্ষমতাসীনরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছে। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য অবিলম্বে দুই দলকে একসঙ্গে বসতে হবে। প্রতিষ্ঠানগুলো সঠিক পথে চালানোর জন্য পরামর্শ দিতে হবে। দেশ এখন চরম সঙ্কটময় সময় অতিক্রম করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এত খারাপ সময় এর আগে আসেনি। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশে বিষাক্ত রাজনীতি চলছে। দেশের প্রতিটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিকৃতভাবে কাজ করছে। দুর্নীতিগ্রস্থ হয়ে পড়েছে। যে উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠানগুলো তৈরি সেই উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করছে না। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারীরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার পরিবর্তে বিরোধী দল দমনে কাজ করছে। গুম-খুন-অপহরণের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। র‌্যাব ভাড়াটে খুনি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। নারায়ণগঞ্জে এটা আমরা দেখতে পেয়েছি।
বিরোধী জোটের আন্দোলন দমনে বিজিবি মহাপরিচালকের অবস্থানের সমালোচনা করে এমাজউদ্দিন বলেন, বিজিবি প্রধানের বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। অন্যায় কেউ করলে তার দায়িত্ব হচ্ছে শাস্তি বিধান করা। এই পর্যায়ের ব্যক্তির কাছে কেউ এটা আশা করে না।
‘বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের দেখলে পায়ে গুলি করার নির্দেশ দেয় যে সংসদ সদস্য, সংসদে তার স্থান হয় কিভাবে’ প্রশ্ন রেখে এমাজউদ্দীন বলেন, অনির্বাচিত সরকার গঠনের কারণেই তারা আজ সংসদ সদস্য হতে পেরেছেন। আর অনির্বাচিত প্রতিনিধিরাই এমন নির্দেশ দিতে পারেন। বৈঠকে অংশ নিয়ে সাংবাদিক ও কলামিস্ট সাদেক খান বলেন, দেশের গণতন্ত্র আজ অকেজো হয়ে গেছে। সংবিধানে এতটা কাটাছেঁড়া করা হয়েছে যে সেটার অবস্থাও একই। এখন গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তিনি বলেন, সংলাপের জন্য বাধ্য করতে হয়। এর জন্য যে আন্দোলন চলছে তাতে আমি ঐক্যমত পোষণ করছি। এটা চলতে থাক। গণতন্ত্রে ফিরে আসার সমাধান হলো- আরেকটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি। তবে দুই বা তিনটি দলের জন্য করলে হবে না, সকলের জন্য করতে হবে। সরকারকে উদ্দেশ্য করে সাদেক খান বলেন, মনে রাখতে হবে পৃথিবীর সব পরাশক্তি মনে করতো তাদের শক্তি দিয়ে পার পেয়ে যেতে পারবে। কিন্তু তারা আজীবন টিকে থাকতে পারেনি। তাদের পরাজয় হয়েছে। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি শওকত মাহমুদ বলেন, বিএনপি ৭ দফা আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছিল সরকারকে। কিন্তু সরকার তা মেনে না নিয়ে বিএনপিকে ইচ্ছে করে রাজপথে আন্দোলনে ঠেলে দিচ্ছে। আমরা চাই শান্তি। আর এ জন্য সংলাপের বিকল্প নেই। সংলাপের মাধ্যমেই সরকার এ সঙ্কট দূর করতে পারে।
তিনি বলেন, স্বৈরতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদ দিয়ে জাতিগঠন হয় না। সুন্দর জাতি গঠন করতে চাই গণতন্ত্র। আর গণতন্ত্র রক্ষার একটাই পথ- সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। শওকত মাহমুদ আরও বলেন, বিজিবির কাজ সীমান্ত পাহারা দেয়া। সেখানে বিএসএফ বাংলাদেশীদের হত্যা করছে বিজিবি পদক্ষেপ না নিয়ে নিজের দেশের মানুষকে হত্যার ঘোষণা দিয়েছে। বিজিবিকে গুলি চালানোর ঘোষণা দেয়ার অধিকার দিয়েছে কে -এমন প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, বিজিবি জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা  করেছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. দিলারা চৌধুরী বলেন, আজ এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে নির্বাচন চাইলে তাকে ‘বিএনপি’ বলা হচ্ছে। সংগঠনের সভাপতি ব্যারিস্টার ফাতেমা আনোয়ারের সভাপতিত্বে বৈঠকে আরও অংশ নেন উন্নয়ন পরামর্শক মেহবুবুর রহমান, রুবি আমাতুল্লাহ প্রমুখ। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক কর্ণেল (অব.) জেআরএম আশরাফ উদ্দিন।

No comments

Powered by Blogger.