‘এক ঘাটে রান্ধে অন্য ঘাটে খায়’

‘মোরা এক ঘাটেতে রান্ধি বাড়ি আরেক ঘাটে খাই,  মোদের সুখের সীমা নাই’- গানের এই লিরিক বেদে সমপ্রদায়ের কাছে অতি পরিচিত। নাটক ও সিনেমাতেও বেদে সমপ্রদায়ের জীবন-জীবিকার চিত্র ফুটে উঠেছে। ফুটে উঠেছে তাদের বিচিত্র সংগ্রাম। এছাড়া বর্তমানে ‘সিঙ্গা লাগাই, দাঁতের পোক ফালাই’- বেদেনীর জোরালো এই আবেদন এখন আর কারও মনে সাড়া দেয় না। তাই অসহায় হয়ে পড়েছেন এই সমপ্রদায়ের লোকজন। নদীর ঘাটে তাদের কাছে এখন আর কেউ মাছ কিনতে যায় না। বেদেরা স্থলে আর নদীর জলে সংসার হলেও দুঃখ যেন তাদের পিছু ছাড়ছে না। তাই এই যান্ত্রিক সভ্যতার যুগে আগের মতো তারা এখন আর ভাল নেই। নিজ ভূখণ্ডে বাস করেও তারা যেন পরবাসী। উপকূলীয় পটুয়াখালী জেলার বিছিন্ন জনপদ রাঙ্গাবালী উপজেলায় শীতের শুরুতেই এই সমপ্রদায়ের লোকজন আসে। দেখা গেছে, বিষধর সাপ নিয়ে খেলা, বিষাক্ত জীব সঙ্গে নিয়েই তাদের বসবাস। এক সময় নৌকা নিয়ে নৌ-পথে চলাচল করতো বেদে সমপ্রদায়। শীত শুরু হলে এসব অঞ্চলে ধান কাটার ধুম লেগে যায়। কৃষিনির্ভর পরিবারগুলোয় আসে সচ্ছলতা। কর্মব্যস্ত সময়ে কৃষক-কৃষাণীর শীর্ণ দেহের কোমর-পায়ের গোড়ালিতে বাত নামক ব্যথা শুরু হয়। আর্থিক সচ্ছলতা, রোগ-বালাই তাড়ানোসহ বিভিন্ন সুবিধার সমাহার নিয়ে বেদেরাও চলে আসে পথ থেকে প্রান্তরের জনগুরুত্বপূর্ণ হাট-বাজারের সংলগ্নে। ছোট ছোট ঝুপড়ি ঘর তুলে অস্থায়ীভাবে বসবাস করে। সাপ খেলার পাশাপাশি বেদেনীরা তাবিজ-কবজ নিয়ে ঘুরে বেড়ায় গাঁয়ের মেঠো পথে। জন্ম থেকেই নদীর জলে খেলা করতে করতে ওরা বড় হয়। উপজেলার বিভিন্ন খালে রয়েছে এরকম প্রায় ৩-৪ হাজার লোকের বসবাস। জন্ম নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে নেই কোন ধারণা। আর থাকবেই বা কী করে? ওরা তো নদীর জলে বসবাস করে, মাছ ধরে বিক্রি করে, চাল, ডাল কিনে খায়। পুঁজি যোগানোসহ এ সমপ্রদায়ের মানুষের সাহায্য-সহায়তায় নেই সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ। এরা সব ধরনের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। এদের জন্য ভোটের রাজনীতি নেই। কে জিতলো আর কে হারলো সে খবর তারা রাখে না। অথচ কয়েক শ’ বছর ধরে মানতা সমপ্রদায়ের মানুষকে যাযাবর চরিত্র নিয়ে সমাজ-সভ্যতায় এদের অংশগ্রহণ। মানতা সমপ্রদায় মূলত বড়শি ও ছোট ছোট জাল দিয়ে মাছ ধরে। পেটের ক্ষুধা মিটিয়ে সঞ্চিত অর্থের ওপর বড়শি, জাল কেনা আর নৌকা মেরামত নির্ভর করে। শিক্ষা কী, এরা জানে না। ভোটাধিকার নেই এদের। এ রকম সমাজ সভ্যতার অনেক কিছুই অজানা এই মানুষেরা নদীর কয়েক ফুট উঁচু ঢেউ কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে শক্ত হাতে নৌকা চালাতে পারে, নদী আর সাগর জলের আচার-আচরণ এদের নখদর্পণে। জলের মতি-গতির সঙ্গে সখ্য এদের জন্মাধিকার। সরজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, উপজেলার রাঙ্গাবালী, ছোটবাইশদিয়া, বড়বাইশদিয়া, চরমোন্তাজ ও চালিতাবুনিয়ার বেশকিছু নদীতে নৌকায় ছোট ছেলে-মেয়েদের নিয়ে বেদেদের দেখা যায়। এরা দল বেঁধে বহর নিয়ে বঙ্গোপসাগরের গভীর থেকে শুরু করে জনমানবহীন দ্বীপাঞ্চল সোনারচর, রুপারচর, জাহাজমারায় এদের অনেক সময় দেখা যায়। প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় এদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। চরমোন্তাজ বেদে পল্লীর এলমেছ সর্দার বলেন, ‘আজ এখানে, কাল ওখানে, এভাবেই চলতে হয় আমাদের। আমরা যাযাবর, সরকার আসে সরকার যায়, আমাদের মিলছে না কোন ঠিকানা! প্রতিটি বেদেবহরকে এক একটি রাজ্যের মতো কল্পনা করে এরা। সর্দার এদের রাজা। তার নিয়ন্ত্রণে চলতে হয় বহরের সবাইকে। বেদে বহরের মেয়েরাই আয়-রোজগার করে। মেয়েরাই সকালে জীবিকার জন্য দল বেঁধে বের হয়।’ একই পল্লীর জবু সর্দার বলেন, ‘গ্রাম থেকে গ্রামে ছুটে সন্ধ্যার দিকে নৌকায় ফিরে আসে। পুরুষেরা সারাদিন বাচ্চাদের দেখাশোনা করে। সর্দাররা বংশক্রমেই সরদার হয়। জবু আরও বলেন, সাপ খেলায় এখন আর পেট বাঁচে না। মেয়েদের পাশাপাশি পুরুষেরাও ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে এই অভাব- অনটনের সংসারে। কেউ কেউ পুকুর-ডোবায় তলিয়ে যাওয়া সোনা-রুপার গহনা তুলে দেয়ার কাজ করে। কেউ দিচ্ছে বিভিন্ন রোগের ঝাড়-ফুঁক ও তাবিজ-কবচ। বিক্রি করছে শাড়ি, চুড়ি। কেউ কেউ জাদুমন্ত্র নিয়ে হাজির হচ্ছে।’

No comments

Powered by Blogger.