দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতি হবে বন ও পরিবেশের by ফররুখ মাহমুদ

সুন্দরবনের শেলা নদীতে তেলবাহী ট্যাঙ্কার ডুবিতে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শহীদুল ইসলাম। তিনি বলেছেন, ২০০২ সালে বনবিভাগ জাপানের সহায়তায় বিআইডব্লিউটিকে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌযান চলাচলে কিছু সুপারিশ দেয়। কিন্তু কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটে। এ কারণে যে ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ করা সম্ভব নয়। মানবজমিন-এর সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, বাংলাদেশ দুর্যোগপ্রবণ দেশ। এখানে ঘূর্ণিঝড়, সিডর, জলোচ্ছ্বাসের মতো দুর্যোগ হয়। তেলবাহী ট্যাঙ্কার ডুবিও একটি দুর্যোগ। বাংলাদেশের দু’টি জায়গা পরিবেশগতভাবে স্পর্শকাতর। একটি সেন্ট মার্টিন, অপরটি সুন্দরবন। সেন্ট মার্টিন পর্যটকদের কারণে ধীরে ধীরে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। সুন্দরবন সিডরের সময়ে প্রচুর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু তারপরও নিজস্ব শক্তি দিয়ে পুনরায় এই বন ঘুরে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এবারের বিপর্যয় সম্পূর্ণ ভিন্ন। সুন্দরবনের যে ক্ষতি হয়েছে তা নির্ণয় করা সম্ভব নয় উল্লেখ করে ড. শহীদুল ইসলাম বলেন, তিন বছর আগে মেক্সিকো উপসাগরে এ ধরনের বিপর্যয় ঘটে। তিন বছর পর আমেরিকার বিশেষজ্ঞরা একটি রিপোর্ট দেয় যে, ওই অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশ এখনও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসেনি। মেক্সিকো উপসাগর টুনা মাছের জন্য বিখ্যাত। তেল বিপর্যয়ের কারণে টুনা মাছের প্রজননে সমস্যা দেখা দিয়েছে। সুন্দরবনে তেল সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে বনের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে দাবি করে অধ্যাপক শহীদুল ইসলাম বলেন, ঘের, লবণ চাষ, ফারাক্কা বাঁধ, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রের পানির স্তর উপরে উঠে যাওয়ার কারণে সুন্দরবনের অস্তিত্ব নিয়ে সবসময়ই শঙ্কা কাজ করে। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো এই তেল বিপর্যয়। এর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি কি হবে তা আন্দাজ করা কষ্টসাধ্য। তেল বিপর্যয়ের কারণে জীববৈচিত্র্যের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তেলবাহী ট্যাঙ্কার ডুবির কারণে তেল সুন্দরবনের সব দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে জীববৈচিত্র্যের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। পানির নিচে যেমন ক্ষতি হচ্ছে উপরেও হচ্ছে। সুন্দরবনের ওই অঞ্চলে ডলফিনের অভয়ারণ্য রয়েছে। তাছাড়া, কুমিরসহ অন্যান্য জলজ প্রাণীও রয়েছে। সেগুলো আর থাকবে না। ইতিমধ্যে খবর এসেছে ডলফিন মরে ভেসে উঠেছে। এটা আমাদের জন্য হুমকি। তেলের আস্তরণ পানির উপর থাকায় সূর্যের আলো পানির নিচে পৌঁছায় না। ফলে জলজ প্রাণী মারা যাওয়ার আশঙ্কা বেশি। তিনি বলেন, জোয়ারের সময় পানির সঙ্গে তেলও বনের ভিতর ঢুকে যায়। ভাটায় সে পানি চলে এলেও তেল থেকে যায়। যে সব স্থানে তেল রয়েছে সে সব স্থানে কোন গাছপালা জন্মাবে না। সুন্দরবনের বেশির ভাগ গাছ শ্বাসমূলের সাহায্যে শ্বাস নেয়। তেলের আস্তরণ সে শ্বাসমূলগুলো ঢেকে দিয়েছে। ফলে বনে যে গাছ রয়েছে তা-ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। অতিথি পাখি আসার হার কমে যাবে উল্লেখ করে অধ্যাপক শহীদুল ইসলাম বলেন, পানি মনে করে তেলের আস্তরণে পাখিরা ঠোকর মারে। তখন তেলের মধ্যে পাখি আটকা পড়ে। এ কারণে অতিথি পাখি আসা বন্ধ হয়ে যাবে। তাছাড়া, তাদের খাবারও নষ্ট হয়ে গেছে। এ ঘটনায় জাতিসংঘ, ইউনেস্কোসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উদ্বেগ জানানোর বিষয়ে ড. শহীদুল বলেন, সুন্দরবন বিশ্বের সম্পদ। এর কারণে সবাই এটি নিয়ে ভাবছে। সুন্দরবনের কিছু অংশ ভারতেও রয়েছে। সেখানেও তেলের প্রভাব পড়তে পারে।
কারণ পাহারা দিয়ে আমরা মানুষ চলাচলে বাধা দিতে পারি। কিন্তু পানিপ্রবাহে তো বাধা দিতে পারি না। সে পানির সঙ্গে তেল ভারতের অংশেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। বন বিভাগের সুপারিশ থাকলেও তা বাস্তবায়নে কর্তৃপক্ষ উদ্যোগী ছিল না উল্লেখ করে ড. শহীদুল ইসলাম বলেন, বনবিভাগের সুপারিশ থাকলেও বিপর্যয় মোকাবিলায় কোন ধরনের পূর্ব প্রস্তুতি ছিল না। খুলনাতে দুর্ঘটনা ঘটেছে। জাহাজ আসছে চট্টগ্রাম থেকে। মংলা বন্দরে কেন কোন ব্যবস্থা রাখা হয় নি? কোস্টগার্ড, মংলা বন্দর, বনবিভাগ রয়েছে। তবে কে কার নেতৃত্বে কাজ করবে তা স্পষ্ট নয়। দুর্ঘটনার পর তেলকে একটি স্থানে আটকিয়ে রাখলে এত বড় বিপর্যয় হতো না। কিন্তু দুর্ঘটনার তিন দিন পর তেল সরানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। জাহাজে মানুষের জন্য লাইফ জ্যাকেট থাকে। তেলবাহী জাহাজেও টিউব থাকা উচিত। এ ধরনের বিপর্যয় হলে টিউব ফেলে তেল নির্দিষ্ট জায়গায় আটকিয়ে রাখা যেতে পারে। বাঁশ দিয়েও তেল আটকিয়ে রাখা যেতো। এই দুর্ঘটনায় সুন্দরবনের কোন ক্ষতি হবে না নৌমন্ত্রীর এমন মন্তব্য সম্পর্কে ড. শহীদুল ইসলাম বলেন, তার নিজস্ব কোন যুক্তি থাকতে পারে। তেল অপসারণে সাধারণ মানুষের আন্তরিকতার অভাব নেই তবে দক্ষতার অভাব রয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, সাধারণ মানুষ আন্তরিকতা দিয়ে বন বাঁচানোর জন্য চেষ্টা করছে। গামলা, বাটি, জাল দিয়ে তেলের আস্তরণ সরানোর চেষ্টা করছে। নানা রকম চর্মরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি নিয়েও খালি হাতে তেল সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করছে। ক্ষতি কমানোর জন্য চেষ্টা অব্যাহত রাখার বিষয়ে অধ্যাপক শহীদুল ইসলাম বলেন, অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে তাই বলে এখনই হাল ছেড়ে দিলে হবে না। বনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলোর মুখ আটকিয়ে দিতে হবে। জাতীয়ভাবে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। বিশেষজ্ঞ ও সিভিল সোসাইটির মধ্যে সমন্বয় করে কার্যকরী সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.