সীমান্তের বাইরে অভিযান চালাবে পাকিস্তান

পাকিস্তানের পেশোয়ারে স্কুলে হামলা চালানো নরপিশাচদের ছবি প্রকাশ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ বলেছেন, সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রয়োজনে সীমান্তের বাইরে অভিযান চালাবে পাকিস্তান। একজন সন্ত্রাসী জীবিত থাকা পর্যন্ত সে অভিযান থামবে না। ওদিকে সেনাবাহিনী পরিচালিত আর্মি পাবলিক স্কুলে ভয়াবহ হামলার প্রতিশোধ নিতে জঙ্গিদের কয়েকটি আস্তানায় বিমান হামলা চালানো হয়েছে। এতে কমপক্ষে ৫৭ জঙ্গি নিহত হয়েছে। রাজনৈতিক মতবিরোধ থাকলেও এক টেবিলে বসেছেন পাকিস্তানের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা। যে নওয়াজ শরিফের পদত্যাগ দাবিতে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন পাকিস্তান তেহরিকে ইনসাফ (পিটিআই) প্রধান ইমরান খান তিনি সেই নওয়াজের দিকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। নওয়াজ শরিফের বাম পাশে বসে তিনি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে একমত পোষণ করেছেন। পাকিস্তান মনে করে পেশোয়ার হামলায় জড়িতদের মূল রয়েছে আফগানিস্তানে। তাদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান জানান দিতে হামলার পরের দিন বুধবার আফগানিস্তান সফর করেছেন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল রাহিল শরিফ। তিনি আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনিকে আহ্বান জানিয়েছেন সন্ত্রাসী, বিশেষ করে তালেবানদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। তিনি আভাস দিয়েছেন, পাকিস্তানি তালেবানরা আফগানিস্তানে হামলা চালাতে পারে। একজন সেনাপ্রধানের এমন আহ্বান বিরল। আফগানিস্তানে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তার বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ন্যাটো বাহিনীর কমান্ডার জেনারেল জন এফ ক্যাম্পবেল। পরে আশরাফ গনি এক বিবৃতিতে বলেন, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সততা ও কার্যকরভাবে একত্রে কাজ করবে দু’দেশ। পেশোয়ারে স্কুলে ওই হামলায় নিহতের সংখ্যা এখন কমপক্ষে ১৪৮।  হাসপাতালে এখনও অনেকে আশঙ্কাজনক অবস্থায়। তাদের আর্তনাদে হাসপাতালের পরিবেশ ভারি হয়ে উঠেছে। পাকিস্তানজুড়ে চলছে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক। যে শিশু-কিশোরের চঞ্চলতায় স্কুল, বাড়ি পেতো প্রাণ এখন তারা অন্য জগতে। তাদের স্মৃতি স্মরণ করে কাঁদছে পুরো পাকিস্তান। সন্তান হারিয়ে পিতামাতা পাগলপ্রায়। তাদের সান্ত্বনা দেয়ার কেউ নেই। সারা দেশই কাঁদছে। কে কাকে সান্ত্বনা দেবে! ওদিকে ঘাতক ৭ তালেবান সদস্যের ছবি প্রকাশ করেছে জঙ্গি সংগঠন তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)। একই সঙ্গে এ ধরনের আরও হামলা চালানোর প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন পাকিস্তানি তালেবানের মুখপাত্র মোহাম্মদ খুরাসানি। পাকিস্তানের বেসামরিক মানুষকে সব ধরনের সামরিক প্রতিষ্ঠান থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করার ব্যাপারেও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন তিনি। তালেবান প্রকাশিত একটি ছবিতে আরবিতে লেখা একটি সাদা ব্যানারের সামনে বন্দুক হাতে ও সেনা পোশাক পরা অবস্থায় দেখা যাচ্ছে হামলাকারীদের। তবে মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তির পরনে রয়েছে কাবলি জাতীয় পাঞ্জাবি। অপর একটি ছবিতে কাবলি জাতীয় পোশাক পরা অবস্থায় দেখা যাচ্ছে তাদের।
দৃঢ়প্রতিজ্ঞ নওয়াজ: প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ তার দেশকে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদমুক্ত করার ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। পেশোয়ারে সেনা পরিচালিত একটি স্কুলে তালেবানের নারকীয় হত্যাযজ্ঞে ১৩২ স্কুলশিশুসহ কমপক্ষে ১৪৮ জন নিহতের পর বুধবার পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্বকারী সব দলের সঙ্গে বৈঠকে বসেন তিনি। এ সময় নওয়াজ বলেন, জঙ্গিবাদ দমনের লড়াইয়ে ‘ভাল ও খারাপ তালেবানে’র মধ্যে কোন পার্থক্য বিবেচনা করা হবে না। তিনি বলেন, শেষ সন্ত্রাসী নিশ্চিহ্ন না হওয়া পর্যন্ত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা নিয়েছি আমরা।
সেনা অভিযানে ৫৭ জঙ্গি নিহত: সেনাবাহিনী সন্দেহভাজন জঙ্গিদের বেশ কয়েকটি আস্তানা ও বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে কমপক্ষে ২০টি বিমান হামলা করেছে। খাইবার এজেন্সির তিরাহ উপত্যকায় চালানো ওই অভিযানে কমপক্ষে ৫৭ জঙ্গি নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে আরও অনেকে। এক টুইট বার্তায় এ তথ্য দিয়েছেন সেনাবাহিনীর এক মুখপাত্র। ইন্টার সার্ভিসেস পাবলিক রিলেশন্সের (আইএসপিআর) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আসিম বাজওয়া জানিয়েছেন, মঙ্গলবারের ট্র্যাজেডির পর জঙ্গি দমনে নতুন এ অভিযান শুরু হয়েছে।
১৭ জঙ্গির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে কয়েক দিনের মধ্যে: কয়েকদিনের মধ্যে কমপক্ষে ১৭ জঙ্গির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করবে পাকিস্তান। পেশোয়ারে ভয়াবহ হামলার পর প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে যে নিষেধাজ্ঞা ছিল তা প্রত্যাহার করেছেন। ফলে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যেসব মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার কথা রয়েছে তা অবিলম্বে কার্যকর করা হবে। প্রাথমিকভাবে ১৭ জঙ্গির ফাঁসি কার্যকর হবে। এ জন্য মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ওয়ারেন্ট জারি করা হবে। শেষ মুহূর্তে তাদের পরিবারের সদস্যদের জানানো হবে। এই ১৭ জঙ্গির মধ্যে ১০ জন পাঞ্জাবের। ৬ জন সিন্ধুর। একজন খাইবার পাখতুনখাওয়ার।
১২০ প্রাণভিক্ষার আবেদন: প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের কাছে ১২০ জঙ্গির প্রাণভিক্ষা চেয়ে আবেদন করা হয়েছে। গতকাল প্রধানমন্ত্রীর কাছে এসব আবেদন পাঠিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে নওয়াজ শরিফ তা বিবেচনা করবেন বলে মনে হয় না। কারণ, পেশোয়ার হামলার পর তিনি যে পরিমাণ চাপে রয়েছেন তাতে ওই আবেদন গ্রহণ করার কোন সুযোগ তার সামনে নেই।
৮২৬১ ফাঁসির আসামি: দেশজুড়ে বিভিন্ন জেলে এখন ফাঁসির রায়  কার্যকরের অপেক্ষায় আছে ৮২৬১ আসামি। এর মধ্যে শতকরা ৩০ ভাগই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য বিশেষ আদালত থেকে ফাঁসির রায় পেয়েছে। ২০০৪ সাল থেকে পাকিস্তান ফাঁসি কার্যকর করেছে ২৩৫টি। তবে ২০০৮ সালের পর এই শাস্তি কার্যকর স্থগিত করে সরকার। কিন্তু পেশোয়ার হামলার পর সেই সিদ্ধান্ত শুধু সন্ত্রাসীদের বেলায় পরিবর্তন করেছে তারা।
জাকিউর রহমান লাকভির জামিন: মুম্বই হামলার প্রধান অভিযুক্তদের একজন পাকিস্তানের জাকিউর রহমান লাকভিকে জামিন দিয়েছে সন্ত্রাসবিরোধী আদালত। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির প্রসিকিউটর এই জামিনের বিরোধিতা করেছেন। লাকভির আইনজীবী রিজওয়ান আব্বাসি আদালতে তার জামিন আবেদন করলে আদালত ৫ লাখ রুপি বন্ডের বিনিময়ে তা মঞ্জুর করেন। ২০০৮ সালে মুম্বইয়ে যে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছিল সেই ঘটনায় লাকভি সহ আরও ৬ জনের বিচার চলছে। তারা এখন আদিয়ালা জেলে। তারা হলো- হাম্মাদ আমিন সাদিক, শাহিদ জামিল রিয়াজ, ইউনাস আনজুম, জামিল আহমেদ, মাজহার ইকবাল ও আবদুল মজিদ।  ওদিকে জাকিউর রহমান লাকভিকে জামিন দেয়ায় কড়া প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে ভারত। এ ঘটনায় ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি বিবৃতি দিয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, পেশোয়ারে   গণহত্যার পর পরই এমন ঘটনা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। পাকিস্তানকে অবশ্যই উচ্চ আদালতে আপিল করতে হবে। যৌক্তিক কারণে ২৬/১১ হামলার মামলা অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত পাকিস্তানের।

No comments

Powered by Blogger.