এক রাত্রির আঁধিয়ার by রফিকুর রশীদ

সালিশ মজলিশের মাঝ থেকে তাড়া খেয়ে রব্বানি যখন দৌড়ুতে শুরু করে তখন তার মোটেই দিগি¦দিক জ্ঞান ছিল না। ‘ধর শালাকে’- এ ঘোষণা শোনার পর সে উত্তর-দক্ষিণ কিংবা পূর্ব-পশ্চিমের হিসাব না করেই মানববৃত্ত ভেঙে প্রাণপণে দৌড়োয়। পেছনে মজা দেখতে আসা কৌতুকামোদী জনতার মারমুখী হুংকার আর প্রবল দাপাদাপি। রব্বানি যাবে কদ্দূর! রাতের অন্ধকার ডানা মেলে খানিক আগলায় বটে, তবু এরই মাঝে কারও কারও হাতে নেচে ওঠে টর্চ লাইট, অন্ধকারের বুক চিরে তারই ফোকাস এলোমেলো মাতামাতি করে। এ আক্রমণ থেকে নিজেকে কীভাবে রক্ষা করে রব্বানি!
আচমকা এক গর্তের মধ্যে পা হড়কে পড়তেই সে কঁকিয়ে ওঠে। প্রথমে মনে হয় ডান পায়ের হাঁটুর নিচে হাড়হাড্ডি ভেঙেচুরে একাকার। পা তুলে আর কোনোদিন বুঝি সে দাঁড়াতেই পারবে না। প্রাথমিক অবস্থা থিতিয়ে এলে ডান হাঁটুতে হাত বুলাতেই বেদনাক্লিষ্ট অনুভূতি টের পায়, তখন আবার আশা জাগে, মাথা উঁচু করে বুঝতে চেষ্টা করে- ধাওয়াকারীদের অবস্থান কোথায় কতদূরে। সম্মিলিত কোলাহলের ঢেউ আসছে বাতাসে গড়িয়ে, কিন্তু স্পষ্ট নয়। মনে মনে কলেমা পড়ে বুকে ফুঁ দিতেই সহসা গাছের পাতা শনশন করে ওঠে। ঠিক তখনই আবার চমকে ওঠে রব্বানি- এ আমি কোথায় এসে পড়েছি! এ্যাঁ!
হাতের তেলো উল্টিয়ে চোখ রগড়ায় রব্বানি। চোখের পাতা বন্ধ করে আবারও চোখ মেলে তাকায়। চোখসওয়া হয়ে আসে অন্ধকার। মনে মনে ভাবে- এতক্ষণ কি তবে একবারও চোখ মেলে তাকায়নি সে! এই যে ঝাঁকড়া ডুমুরগাছ দিব্যি চিনতে পারছে! রাতজাগা কোনো পাখি ডানা ঝাপটাতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে, হুতোম প্যাঁচা নাকি! তার মানে সে কি তবে লোকালয় এড়াতে গিয়ে একেবারে গোরস্থানে এসে পড়েছে? মাঠপাড়ার গায়ে লাগা এ গোরস্থানপাড়া। আগে শুধু গোরস্থানই ছিল, সারা গ্রামের বারোয়ারি গোরস্থান; মাঠপাড়া সম্প্রসারিত হয়ে জনবসতি গড়ে উঠেছে অনেক পরে। হয়েছে গোরস্থানপাড়া। কিন্তু পাড়া মানে তো গোরস্থান নয়। পায়ের নখে হোঁচট খেয়ে যে গর্তে সে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে সেটা তাহলে নেহায়েত সাধারণ কোনো গর্ত নয়। মানুষের কবর! এই যে কবে কোনকালে ইট গেঁথে বাঁধানো হয়েছিল দেখা যাচ্ছে, এখন ধসে পড়ছে! বয়সের ভারে ধসে পড়ছে, নাকি শেয়াল-টেয়ালে খাবলে খুবলে ধসিয়ে দিচ্ছে কে জানে! এই যে রীতিমতো সুড়ঙ্গ হয়ে ভেতরে চলে গেছে! ভেতরে মানে কত ভেতরে? মাটির তলে কি সেটা অন্য কোনো দেশ? এমন দুঃসময়ে এতটা বিপন্ন মুহূর্তেও রব্বানিকে কেমন দার্শনিকতায় পেয়ে বসে। কিছুদিন বাউল তরিকায় যুক্ত হওয়ার অভিজ্ঞতাও তার ভাণ্ডারে আছে কিনা। হয়তো সেই সাধনভজনের জোরেই সে জীবিত মানুষ হয়েও এ রাতের অন্ধকারে অচেনা কবরের গুহায় বসে ভাবতে পারে- মৃত্যুর পরে মানুষ কোথায় যায়, কোন নিরুদ্দেশের পথে? রব্বানি কি মৃত্যুর আগেই সেই পথে নিজের অজান্তে রওনা হয়েছে?
নাহ্, ‘অচেনা কবর’ শব্দযুগল ষোল আনা ঠিক হচ্ছে না। বারোয়ারি এ গোরস্থানে সারি সারি অনেক কবর আছে। একেবারে গোড়ার দিকে খানিকটা বিশৃংখলা ঘটলেও পুরাতন এ গ্রামের জনসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি মৃতের সংখ্যাও বৃদ্ধি ঘটার কারণে কবর খোঁড়ার কাজেও শৃংখলা এসেছে। বিগত কয়েকবছর থেকে তো দ্বিতীয় দফা খননের কাজ শুরু হয়েছে। দ্বিতীয় দফার সমাধিপর্ব ক্রমশ এগিয়ে আসছে। ডানে-বামে ভালো করে তাকিয়ে দেখার পর রব্বানি দিব্যি নিশ্চিত হতে পারে- দ্বিতীয় পর্যায়ের আগ্রাসন এখনও এতদূর এসে থাবা বসায়নি। এ কবর তার অচেনা নয়, চেনা। বহুদূর কৈশোরের স্মৃতি জেগে আছে এ ডুমুরতলার কবরটি ঘিরে, তার ওপরে সময়ের ধুলো জমেছে অনেক; কিন্তু সে স্মৃতি এতটাই রোমাঞ্চকর যে তার উজ্জ্বলতা আজও সম্পূর্ণ ‘বিবর্ণ’ হতে পারেনি।
কিন্তু সে যা-ই হোক, রব্বানিকে কি এ কবর গুহায় বসেই কাটাতে হবে সারাটা রাত? পেছনে তেড়ে আসা লোকলস্করের আর কোনো সাড়াশব্দ নেই, দিকভ্রান্ত হয়ে তারা হয়তো চলে গেছে যে যার মতো। রাত পোহালেই ভোটের মাতামাতি। প্রকাশ্যে প্রচার-প্রচারণা শেষ হলেও রাত গভীর হলে শুরু হবে শেষরাতের খেল। হয় টাকাকড়ি, নয়তো পেশিশক্তি- মাথা নোয়াতেই হবে একটার কাছে। এসব ক্রীড়া-কৌতুক ফেলে রেখে কার কাজ নেই তার পেছনে ছুটে বেড়াবে! বললেই হল- একটা ভোটের মূল্য কত, তার হিসাব আছে! কুরবান হাজী সালিশ মজলিশের আর সময় পেল না, ভোটের আগের রাতে জুড়ে দিল তাইরে নাইরে না। বিচার হবে, রূপসী খাতুনের। কেন, রূপসীর কী অপরাধ? বিলম্বে হলেও রব্বানি বুঝেছে- গরিবের মেয়ের দেহে রূপ থাকাও এক অপরাধ বটে। সম্পদ যে রক্ষা করতে পারবে না, সম্পদ আঁকড়ে ধরে রাখবে সে কিসের জোরে? বারো ভূতের নজর তো পড়তেই পারে, লুটেপুটে খাবে না তারা! তো সেই বারোভূতের এক ভূত হচ্ছে কুরবান হাজীর ছোট ছেলে ইমরান আলী। বাব্বা! ভূত বলে ভূত! ইমরান হচ্ছে ভূতের রাজা ভূত। বারোভূতের সর্দার। যার ঘাড় একবার মটকাবে তার কি আর রক্ষা আছে! হাড়-মাংস চিবিয়ে চূর্ণ করবে। না হলে রূপসীর আজ এ দশা কেন হবে! বিয়ে থা দিয়ে মেয়েকে ঘর সংসারে থিতু করে তোলার চেষ্টা তো কম করেনি রব্বানি! কিন্তু সে থিতু হবে কী করে! কাঁধের ওপর ভূত থাকলে কেউ থিতু হতে পারে! সে তো তখন হাওয়ায় ভাসা নাগরদোলায় চেপে নাচবেই। দোষ কার- যে নাচে, নাকি যে নাচায়?
সহসা ডুমুরগাছের ডালে প্যাঁচা ডেকে উঠতেই শিউরে ওঠে রব্বানি। এমন রাত-বিরাতে সুনসান গোরস্থানের মধ্যে ভাঙা কবরের গর্তে দাঁড়িয়ে ভূতের ভাবনা আসছে কেন মাথায়? না, ভূতপ্রেতের অস্তিত্বে তার প্রবল বিশ্বাস আছে এমন নয়। ফকিরি লাইনে বাউল তত্ত্ব চর্চা করতে গিয়ে একদা সে কার্যকারণ সূত্র এবং যুক্তিবাদী বিশ্লেষণও করতে শেখে। কিন্তু সে আর কত দিনের চর্চা? বহু যুগের সংস্কারের শেকড় তারও চেয়ে গভীরে প্রোথিত। সে কি সমূলে উৎপাটন সম্ভব? এতক্ষণ পর ডান পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে গিয়ে টের পায়- এ কবরের গর্তে হুমড়ি খেয়ে পড়ার সময় যতটা আঘাত সে পেয়েছিল, এখন আর ততটা ব্যথা নেই। ঝিঁঝি লাগার মতো মৃদু শিরশিরানি আছে, কিন্তু সেই কলজে উপড়ানো যন্ত্রণা অনেকটাই যেন গায়ে বসে গেছে। চোখ সরু করে দক্ষিণে তাকাতেই তার নজরে পড়ে- অনতিদূরে এক নতুন কবর জুড়ে শেয়ালের হল্লা। শেয়ালেরই বা দোষ কী, কবরে শোয়ানো লাশ নিয়ে যদি পুলিশে টানাটানি করে, ওরা যাবেটা কোথায়! হামিজুদ্দিনের মেয়ে হেনা মরল দোররার ঘায়ে, ওইটুকু মেয়ে একশ’ ঘা দোররা নাকি সইতে পারে! অথচ মেয়ের শোক হজম করে সেই হামিজুদ্দিন বাইরের মানুষের সামনে দিব্যি চোখের পানি মুছতে মুছতে ঘোষণা করে- তার মেয়ে বিষপানে আত্মহত্যা করেছে। কেন, আত্মহত্যা কেন? মায়ের ওপর রাগ করে। সে নিজে কাঁধ বাড়িয়ে দোষ স্বীকার করে, বাপ হয়ে মেয়ের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল সেই জন্য এ অপঘাত। স্কুল বন্ধের কারণ বলতে গিয়ে আরও উল্টোপাল্টা হয়ে যায় তার বক্তব্য। স্থানীয় কাগজে নানা রকম মুখরোচক কেচ্ছা ছাপা হলে আইন-আদালত তোলপাড় হয়, টানাটানি হয় হেনার কবরে শোয়ানো লাশ নিয়ে।
এখানে এসে রব্বানির দু’চোখের তারায় ঝলসে ওঠে বিদ্যুতের তরবারি। আকাশ ভেঙে বাজ পড়ে বুকের জমিনে। বিদ্যুৎ ঝলকের প্রভায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে আত্মজার মুখ। রব্বানির শ্বশুর আহ্লাদ করে নাতনির নাম রেখেছিল রূপসী। বড় হতে হতে সে যথার্থই রূপসী হয়ে ওঠে। একবার তাকালে আর চোখ ফেরানো যায় না। কিন্তু গরিবের ঘরে এত রূপ আঁটবে কেন! কন্যার রূপের কাঁটাই বিঁধল শেষে পিতার গলায়। কী করবে রব্বানি, বাপ হওয়ার দায়ে নীলকণ্ঠ হয়ে সব বিষই হজম করতে হয় মুখ বুজে। না, একসময় তাকে নিরূপায় হয়ে মুখ খুলতেই হয়। মুখ খুলতে গিয়েই যত বিপদ এসে কাঁধে চাপে। একগিঁট খুলতে না খুলতেই আর এক গিঁট এসে পথ আগলে দাঁড়ায়। দিশেহারা রব্বানি তো খড়কুটো ধরে বাঁচার স্বপ্ন দেখতেই পারে! সে কি তার অপরাধ!
বুক ধড়ফড় করে রব্বানির। হঠাৎ দুশ্চিন্তা হয়- শেষ পর্যন্ত আমার মেয়েটাকে ওরা বাঁচতে দেবে তো! নাকি ওই হেনার মতোই অনভিপ্রেত কোনো পরিণতি রূপসীর জন্যও অপেক্ষা করছে, আড়াল থেকে জিভ ভেংচিয়ে পরিহাস করছে নিয়তি? একান্ত নিভৃতে আর্তনাদ করে ওঠে তার পিতৃহৃদয়। না না, নিজের মেয়ের ক্ষেত্রে ওই রকম নিষ্করুণ পরিণতির কথা সে ভাবতেও রাজি নয়। দু’হাতে দেয়াল সরানোর মতো করে সে নিয়তিকে ভ্রুকুটি হানতে চেয়েছে। সত্যিকারের বিয়ের বয়স হওয়ার আগেই রূপসীর বিয়ে দিয়েছে। জামাই বাবাজি উপজেলা শহরে দর্জির কাজ করে। সুনাম, আয়-ইনকাম সবই ভালো। আরও ভালো জায়গা থেকেও একাধিক প্রস্তাব এসেছে। রব্বানি কিছুতেই নিজের শ্রেণী-অবস্থান বিস্মৃত হতে চায়নি। রূপসী স্কুলে যায়। যাওয়া আসার পথে অনেকেই উত্ত্যক্ত করার চেষ্টা করে। বিপন্ন বোধ করে রূপসী এবং তার জন্মদাতা রব্বানি। ঠিক এমনি সময় এগিয়ে আসে ইমরান, কুরবান হাজীর ছেলে। কলেজে পড়ে। রাজনীতি করে। মোটরসাইকেলে ধোঁয়া উড়িয়ে সে রূপসীকে গার্ড দেয়া শুরু করলে রাস্তার উপদ্রব খানিক কমে যায় বটে, রব্বানি মগজের কোষে ছড়িয়ে থাকা উদ্বেগ বিশেষ কমে না। রূপসীর মাকে ডেকে বলে- ইবার আমি মেয়ির বিয়ি দেব।
গালে টোল ফেলে ফিক করে হেসে ফ্যালে রূপসীর মা। এ প্রস্তাব তার অনেকদিনের। আপন ভাইয়ের ছেলে রমজান ঘুরে ঘুরে হদ্দ হল, মেয়ে কিংবা মেয়ের বাপ ফিরেও তাকায়নি। কেন, পাত্র হিসেবে রমজান কম কিসে! লেখাপড়া কি সবার হয়! রমজানের দুর্বলতা এ এক জায়গায়, আর রূপসীরও উল্টো রোখ- সে আরও পড়তে চায়, বিয়ে করতে নয়। বাপও এতদিন হ্যা হ্যা করে হেসে হেসে মেয়েকে আশকারা দেয়। সেই মানুষ হঠাৎ বদলে গেল! ভাইপো রমজান অন্যত্র বিয়ে করে ফেলেছে বলে একটুখানি দুঃখ হয়, তবু নিজেকে বুঝ দেয়- রূপসীর বাপ যে মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি হয়েছে সেটাই অনেক। কিন্তু হঠাৎ এমন মতি হল যে বড়!
কুরবান হাজী বিপত্নীক হওয়ার পর বেশ কিছুদিন উদাস হয়ে কাটায়। উপজেলা শহরের অতবড় হার্ডওয়্যার দোকানের পুরো দায়িত্ব রব্বানির কাঁধে ফেলে পুনর্বার হজ করতে যায়। একই গ্রামে বাড়ি এবং দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত কর্মচারী- এর বাইরে অন্য কোনো আত্মীয়তার বন্ধন বা পরিচয় তো তাদের মধ্যে নেই। তবু রব্বানিকেই বিশ্বাস। প্রায় সমবয়সী হলেও গ্রামসুবাদে তাদের সম্পর্ক খানিকটা আড়ষ্ঠ চাচা-ভাতিজা। দ্বিতীয় দফা হজ করার পরও বুকের ভেতর শীতল না হওয়ায় চোখ কান বন্ধ করে কুরবান হাজী একদিন সোজাসুজি প্রস্তাব দিয়ে বসে- তুমার মেয়িডা আমাক্ দ্যাও বাবাজি, আমার সেযত্নে করবে।
রব্বানির কপালে ভাঁজ পড়ে, এ কথার মানে কী! মুখে প্রশ্ন না করে চোখ তুলে তাকায়। কুরবান হাজী একটু খোলাসা করে- ব্যবসাপাতি তো তুমিই চালাচ্ছ, চালাও। আমি আর কী করবু? রাজনীতি কত্তিও আর মন চায় না। তুমার মেয়িডা দ্যাও, নতুন সংসার করি।
কুরবান হাজীর নতুন সংসার! রূপসীকে নিয়ে?
রব্বানি খুব ঠাণ্ডা মাথায় ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফ্যালে- অচিরেই সে তার মেয়ের বিয়ে দিয়ে ফেলবে। কুরবান হাজীর দোকানেও আর খাটবে না নিজে। চেনা এ বৃত্ত থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেবে। কুরবান হাজী লোক লাগিয়ে হুমকি ঝাড়ে- চুরির মামলায় ঝুলিয়ে দেব। কিন্তু রব্বানি মোটেই পরোয়া করে না হুমকি। পেশা বদলে কিঞ্চিৎ বিলম্ব হলেও মেয়ের বিয়েতে মোটেই দেরি করে না। রূপসী প্রবল কান্নাকাটি করে। হাত-পা ছুড়ে দাপায়। কাজ হয় না কিছুতেই। বিয়ে হয়ে যায়।
অভ্যস্ত পেশা থেকে নিজেকে উৎখাত করার পর ভয়ানক নিঃসঙ্গ মনে হয় রব্বানির। কী করবে, কোথায় যাবে ভেবে স্থির করতে পারে না। ইমরান এসে তাকে খুব ফুঁসলায়- চলো দেখি দোকানে চলো। আব্বা এবার ভোটে দাঁড়াবে। ব্যবসা চালাবে কে?
রব্বানি অনড়। এসব নিয়ে কারও কাছে মুখ খুলতেও নারাজ। মুখের থুতু বাইরে ফেলার পর সে আর মুখে তুলতে চায় না। ইমরান গিয়ে রূপসীকে পটায়। কোনো কিছুতেই কাজ হয় না। রব্বানি এখনও ভেবে পায় না- প্রত্যাখ্যানের এত জোর সে পেয়েছে কোথায়?
মধ্যরাত পেরিয়ে যাওয়ার পর আকাশে চাঁদ ওঠে। চারদিক ফর্সা হয়ে আসে। রব্বানি ইচ্ছে করলেই হয়তো গোরস্থান থেকে বৈরিয়ে আসতে পারে। কিন্তু তারপর কি নিজেকে রক্ষা করতে পারবে? এ প্রশ্নের সদুত্তর খুঁজে পায় না। তার বাপ পেরেছে নিজেকে রক্ষা করতে? একাত্তরে শহীদ হয়েছে। শহীদ হওয়া মানে কি নিজেকে রক্ষা করা? তবে হ্যাঁ, দুর্দান্ত সাহস ছিল তার বুকে। মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার পর একরাতে বাড়ি এসে রাজাকারদের হাতে প্রায় ঘেরাও হয়ে গিয়েছিল। একা গুলি ছুড়ে নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে যায়। সেটা আবার কোথায়? এ শিমুলতলার কবর গুহায়। এখানেই তার গোলাবারুদের সঞ্চয়। পরদিন রাজাকার দল এসে রব্বানির মাকে নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া শুরু করলে এখান থেকেই সে প্রতিরোধ গড়ে কিশোর পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে। বাপের হাতে গুলি এগিয়ে দেয়াতেই কিশোর রব্বানির কত উত্তেজনা, কত আনন্দ!
রব্বানি শুনেছে তার বাপ সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হয়েছে। তা বেশ, তার মরদেহটি কোথায় কবর দেয়া হয়েছে? না, সে সংবাদ জানা হয়নি। এখন এ কবরগুহার ভেতরে ঢুকে পড়লে কেমন হয়? মাটির তলে আর দেয়াল কিসের! রব্বানি কি এ প্রক্রিয়ায় তার শহীদ পিতার কবরদেশে পৌঁছে যেতে পারে না? আহা, পৌঁছুতে পারলে কী ভালোই যে হতো! একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে সে জানাতে পারত- দিয়েছি হাটে হাড়ি ভেঙে। টাকা হয়েছে। হজ হয়েছে। শালা রাজাকারের বাচ্চা রাজাকার এবার চেয়ারম্যান হবে। পেটের দায়ে তার নুন খেয়েছি, গুণ গেয়েছি, এতদিন মুখ খুলিনি তো! রাজাকারের বাচ্চা রাজাকার আমার মেয়ের সংসার ভাঙে, বদনাম রটায়; আবার সালিশ-মজলিশে আমাকে চোর সাজায়! গুণ্ডাপাণ্ডা পুষে হাতে খুব শক্তি হয়েছে। জোর দেখাতে আসে। আমিও মুখের ওপর বলে দিয়েছে- রাজাকারের বাচ্চা রাজাকারই হয়। লুণ্ঠনকারী হয়, ধর্ষণকারী হয়! উচিত কথায় কুটুম ব্যাজার, গরমভাতে বেড়াল ব্যাজার! এতক্ষণে রব্বানি ভেতরে ভেতরে স্বস্তি পায়- এখান থেকেই তো তার বাপ প্রতিআক্রমণ রচনা করেছিল, সেও এখান থেকেই যাত্রা শুরু করতে চায়। একাত্তরে তার বাপের হাতে ছিল অস্ত্র-গোলাবারুদ, এখন সে কোথায় পাবে এসব! তখনই ভোরের আজান হয়। মানুষ জোগে উঠছে। ঘর ছেড়ে বাইরে আসছে। দিনের আলো ফুটছে। তবে আর ভয় কী! রব্বানি ভরসা পায়- অস্ত্র গোলাবারুদ কিছুই লাগবে না তার। না, কিছুই লাগবে না। জনগণ ওদের ঠিক প্রত্যাখ্যান করবে।
আজ ভোটের দিন। মানুষ ঘর ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে এলে রব্বানি কেন কবরগুহায় বসে থাকবে! রূপসীর জীবনযাপন নির্বিঘ্ন করতেই আজ প্রয়োজন নতুন শক্তি-সাহস-উদ্যমের। সেই জন্যই বুঝিবা জরুরি হয়ে উঠেছিল এক রাত্রির এই কবরবাস।

No comments

Powered by Blogger.