ওসমানী নগরে সংঘর্ষে প্রাণ গেল ওসির

সিলেটের গোয়ালাবাজারে দু’দল অটোরিকশা শ্রমিকের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষে ওসমানীনগর থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান নিহত হয়েছেন। তিন ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষে পুলিশ সদস্যসহ উভয় পক্ষের অর্ধশত লোক আহত হয়েছে। এ সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ রাবার বুলেট ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ ছাড়াও উভয় পক্ষের মধ্যেও গুলিবিনিময়ের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষ চলাকালে শতাধিক রাউন্ড গুলি ছোড়া হয়। এতে আতঙ্কে সিলেট-ঢাকা মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে। প্রায় তিন ঘণ্টা যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় গোটা এলাকায় যানজট দেখা দেয়। এদিকে, ওসি নিহত হওয়ার পর শতাধিক পুলিশ সদস্য গোয়ালাবাজার, করনসী ও ব্রাহ্মণশাসন গ্রামের ঘরে ঘরে তল্লাশি শুরু করে। সন্ধ্যা পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে কমপক্ষে ১৫ জনকে আটক করা হয়েছে। স্থানীয়রা জানান, গোয়ালাবাজারে অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের পাল্টাপাল্টি কমিটি গঠনকে গত কয়েক দিন ধরে উত্তেজনা চলছিল। এ ঘটনায় শ্রমিকদের দুটি গ্রুপ কয়েক দিন ধরে মুখোমুখি অবস্থান নেয়। এর মধ্যে কয়েক দিন আগে একটি পক্ষ রাস্তাও অবরোধ করেছিল। এর জের ধরে গতকাল বুধবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে গোয়ালাবাজার অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের নতুন একটি শাখা দেয়াকে কেন্দ্র করে শ্রমিকদের একটি অংশ লাঠিসোটা নিয়ে মহাসড়কে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এ সময় গোয়ালাবাজার বর্তমান অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের কিছু শ্রমিক মহাসড়কের অন্যত্র বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। এর পর থেকে উভয় পক্ষে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। খবর পেয়ে ওসমানীনগর থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা চালায়। ওসি মোস্তাফিজুর রহমানসহ পুলিশ দল অবরোধ করে রাখা শ্রমিকদের রাস্তা থেকে ফিরিয়ে আনেন। এর কিছুক্ষণ পর ওই ক্ষুব্ধ অংশটি আরও লোকবল নিয়ে রাস্তায় জড়ো হয়ে অবরোধ দেয়। এ সময় প্রতিপক্ষ গ্রুপের কর্মীরাও দলবল নিয়ে এগিয়ে আসে। এক পর্যায়ে দুপুর ১টার দিকে উভয়পক্ষ সশস্ত্র অবস্থায় সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। সংঘর্ষে গোয়ালাবাজার উত্তর অংশের শ্রমিকদের সঙ্গে ব্রা??হ্মণশাসন গ্রামের কিছু লোক এবং দক্ষিণ অংশের শ্রমিকদের সঙ্গে করনসী গ্রামের কিছু লোক অংশ নেয়। এক পর্যায়ে সংঘর্ষটি করনসী ও ব্রাহ্মণশাসন গ্রামের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। বেলা ১টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত চার দফা সংঘর্ষে উভয় পক্ষে ব্যাপক গোলাগুলি, ইটপাটকেল নিক্ষেপ হয়। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে রাবার বুলেট ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, সংঘর্ষ চলার সময় দুই গ্রুপ একে অপরকে লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। সংঘর্ষে করনসী গ্রামের জুয়েল, রমজান, এমরান হোসেন, আহাদ মিয়া, আবদুল মতিন, আজাদ, ব্রা?হ্মণ গ্রামের মুহিবুর রহমান, রুবেল, শানুর, মাহমদ আলী, আবদুল হামিদ, মতিন মিয়াসহ কমপক্ষে অর্ধশত লোক আহত হয়। সংঘর্ষ চলার সময়ই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন ওসমানীনগর থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান। স্থানীয় লোকজন সঙ্গে সঙ্গে তাকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এদিকে, সংঘর্ষ চলাকালে একটি নোয়া মাইক্রো, একটি যাত্রীবাহী বাস, তিনটি মোটরসাইকেল, ডাচ্‌ বাংলা ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক ও বেবি শপ নামের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর করা হয়। দুপুর ১২টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত মহাসড়কের সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ থাকে। এ সময় মহাসড়কের উভয় দিকে এম্বুলেন্সসহ সহস্রাধিক যানবাহন আটকা পড়ে। চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় রোগীসহ দূরপাল্লার যাত্রীদের। সংঘর্ষের পর রিজার্ভ পুলিশের শতাধিক সদস্যকে নিয়ে যাওয়া হয় গোয়ালাবাজারে। সেখানে চলে একের পর এক অভিযান। পুলিশের একটি দল গোয়ালাবাজারে তল্লাশি অভিযান শুরু করে। আরও কয়েকটি দল স্থানীয় করনসী ও ব্রাহ্মণশাসন গ্রামে অভিযান চালায়। অভিযানের কারণে গতকাল বিকাল থেকে দু’টি গ্রাম পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে। সন্ধ্যা পর্যন্ত পুলিশ অভিযান চালিয়ে অন্তত ১৫ জনকে আটক করেছে। এদিকে, সংঘর্ষ চলাকালে ওসির ওপর ইটপাটকেল পড়ে। পুলিশ টিয়ার শেল নিক্ষেপ করার পর তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়লে দীর্ঘ যানজট পেরিয়ে তাকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। সিলেটের এএসপি সুজ্ঞান চাকমা ডাক্তারের বরাত দিয়ে ওসির মৃত্যুর বিষয়টি সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেন। এলাকার লোকজন জানান, কিছুদিন আগে গোয়ালাবাজার অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের একজন ম্যানেজার দক্ষিণ স্ট্যান্ডের একটি অটোরিকশা অফিসে নিয়ে আসার পর শ্রমিকদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এর পর থেকে বাজারের দক্ষিণ অংশের কিছু অটোরিকশা শ্রমিক গোয়ালাবাজারে নতুন একটি শ্রমিক শাখার দাবি তোলে। সিলেট জেলা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ এলাকা পরিদর্শন করে নতুন শাখা দেয়ার আশ্বাস দিয়ে তা আনুষ্ঠানিক ভাবে উদ্বোধন করার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা না করায় শ্রমিকদের একটি অংশ উত্তেজিত হয়ে মহাসড়কে নামলে এই সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। করনসী রোড এলাকার (নতুন শাখার দাবিদার) অটোরিশা শ্রমিক নেতা পিয়ার আলী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, দীর্ঘ দিন ধরে জেলা কমিটি গোয়ালাবাজারে আমাদের একটি শাখা উদ্বোধন করে দেবে বলে দিচ্ছিল না। এর প্রতিবাদে আমরা মহাসড়কে অবস্থান নিলে অপর সংগঠনের শ্রমিকরা আমাদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়ন গোয়ালাবাজার শাখার সভাপতি জিলু মিয়া সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, করনসী রোডের কিছু অবৈধ লাইসেন্সধারী শ্রমিক আমাদের সংগঠনের সদস্য হতে না পেরে নতুন শাখার জন্য জেলায় আবেদন করে। এর জের ধরে তারা আমাদের শ্রমিকদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। গোয়ালাবাজার ইউপি চেয়ারম্যান আতাউর রহমান মানিক জানান, অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়েনের সিলেট জেলার নেতৃবৃন্দ নতুন শাখা দেয়ার কথা বলে না দেয়ায় সংঘর্ষ ঘটে। তিনি এ ঘটনার জন্য জেলার নেতাদের দায়ী করেন। সংঘর্ষকালে মারা যাওয়া ওসি মোস্তাফিজুর রহমানের বাড়ি কুমিল্লা জেলার পাথারিয়া মোগলটুলা গ্রাম। তার পিতা নওয়াব মিয়া। ওসি মোস্তাফিজুর রহমান ব্যক্তিগত জীবনে দুই সন্তানের জনক। তার দু’টি মেয়ে মাইশা ও রাইশা ঢাকার ভিকারুন্নেছা নুন স্কুলের শিক্ষার্থী। তার পরিবার বসবাস করতো ঢাকার বনশ্রী এলাকায়। বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার লাশ নিয়ে আসার পর সেখানে যান সিলেটের ডিআইজি মিজানুর রহমান ও ভারপ্রাপ্ত এসপি নাজমুল হাসানসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর অনেকটা নির্বাক ছিলেন ডিআইজি মিজানুর রহমান। ঘটনাস্থলে উপস্থিত পুলিশের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সংঘর্ষের সময় পুলিশ পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করছিল। এ সময় উভয় পক্ষ ইটপাটকেল ছুড়ে মারে। এসময় কয়েকটি ইটপাটকেল এসে ওসি মোস্তাফিজুর রহমানের ওপর পড়ে। তবে, তাতে তিনি খুব বেশি আহত হননি। ওসি মোস্তাফিজুর রহমানের মৃত্যুর খবর শোনা মাত্র ওসমানী হাসপাতাল মর্গে ছুটে যান আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ, সিলেট-২ আসনের সাবেক এমপি শফিকুর রহমান চৌধুরী। এছাড়া সিলেট জেলা ও মহানগর পুলিশের সিনিয়র কর্মকর্তারাও সেখানে ছুটে যান। বিকাল সাড়ে ৫টায় ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে ওসি মোস্তাফিজুর রহমানের লাশের ময়না তদন্ত সম্পন্ন হয়। পরে কোতোয়ালি থানার ওসি আসাদুজ্জামান তার মরদেহ গ্রহণ করে। পুলিশ জানিয়েছে, রাতে সিলেটে প্রথম জানাজার পর ওসি মোস্তাফিজুর রহমানের লাশ গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা নিয়ে যাওয়া হবে।

No comments

Powered by Blogger.