নিষ্পাপ শিশুদের লাশের মিছিল সামনে রেখে কাঁদছে পাকিস্তান

শোকে স্তব্ধ পাকিস্তান। নিষ্পাপ শিশুদের লাশের মিছিল সামনে রেখে কাঁদছেন দেশবাসী। অকালে ঝরে যাওয়া এতগুলো প্রাণকে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে চিরবিদায় জানিয়েছেন তারা। অর্ধনমিত রাখা হয়েছে জাতীয় পতাকা। পালিত হচ্ছে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক। খাইবার পখতুনখাওয়া প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে হয়েছে একাধিক গণজানাজা। প্রতিটি জানাজায় অংশগ্রহণ করেছে হাজার হাজার মানুষ। এ সময় আপনজন হারানো পরিবার, স্বজন বন্ধুদের গগনবিদারী বিলাপ করতে দেখা যায়। সন্তানহারা পরিবারগুলোর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সবাই। পাকিস্তানজুড়ে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডাসহ সব ধরনের উপাসনালয়ে চলে প্রার্থনা। বিভিন্ন স্থানে মোমবাতি প্রজ্বলন করে দেয়া হয় শ্রদ্ধাঞ্জলি। অশ্রু, আর্তনাদ, হাহাহার আর হারানোর বেদনা সব মিলে-মিশে একাকার। এভাবেই ১৩২টি শিশু আর স্কুলের প্রাপ্তবয়স্ক ৯ কর্মীকে সমাহিত করেছে পাকিস্তান। মঙ্গলবারে তালেবানদের বর্বর হামলায় কমপক্ষে ১৪১ জন নিহত হয়। নৃশংস তালেবান হত্যাযজ্ঞের স্বাক্ষর বহনকারী বিদ্যালয়ের হৃদয়বিদারক সব ছবি আসে গণমাধ্যমগুলোতে। এসব ছবিতে দেখা যায়, কক্ষগুলোর সর্বত্র রক্তাক্ত। দেয়ালগুলোতে শ’ শ’ বুলেটের চিহ্ন। সারা দেশের স্কুল, কলেজ, বিপনিবিতান, বাজার, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, সব কিছু বন্ধ রাখা হয়েছে। এদিকে পেশোয়ারের সর্ববৃহৎ হাসপাতাল লেডি রিডিংয়ে অবতারণা হয়েছে আরেক মর্মান্তিক দৃশ্য। আহতদের চিকিৎসায় প্রাণান্ত চেষ্টা করছেন কর্তব্যরত চিকিৎসকরা। আহতদের জন্য প্রচুর রক্তের প্রয়োজন। চিকিৎসকরা রক্তদানের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। চরম রাজনৈতিক বিভক্তি ভুলে গিয়ে ছোট-বড় সব দলের নেতৃবৃন্দ এক কাতারে দাঁড়িয়েছেন। উপস্থিত হয়েছেন পেশোয়ারে। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন সবাই একসঙ্গে। সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড লাঘবের প্রসঙ্গে সন্ত্রাস বিষয়ক মামলাগুলোতে এ সুযোগ বাতিল করার ঘোষণা দিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ। বিশ্বনেতারাও ন্যক্কারজনক এ হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। নিন্দা জানিয়েছে আফগানিস্তানের তালেবানরাও। যে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ শিশুদের উচ্ছলতায় প্রাণবন্ত থাকে গতকাল সেখানে ছিল শিহরণ জাগানিয়া শোকের আবহ। নিষ্প্রাণ, বিধ্বস্ত ধংসস্তূপে পরিণত হয়েছে আর্মি পাবলিক স্কুল। সারা রাত সেনা সদস্যরা বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ থেকে বিস্ফোরক সরানোর কাজ করেন। বিবিসি’র খবরে বলা হয়, পাকিস্তান সেনাবাহিনী খাইবার  ও উত্তর ওয়াজিরিস্তান এলাকায় জঙ্গিদের ওপর পৃথক বিমান হামলা শুরু করেছে। তবে এটা স্কুল হামলার সরাসরি জবাব কিনা তা এখনও স্পষ্ট নয়। উল্লেখ্য, জুন মাস থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে। আর্মি পাবলিক স্কুলে মঙ্গলবারের হামলার দায় স্বীকার করে তালেবান মুখমাত্র বলেছে, এটা ছিল তাদের বিরুদ্ধে ওই সামরিক অভিযানের জবাব। স্বজন হারানোর বেদনা কি তা বোঝাতেই এ হামলা চালানো হয়েছে বলে সে উল্লেখ করে। তালেবানদের এ হামলার জবাব কিভাবে দেয়া হবে তা নির্ধারণ করতে পেশোয়ারে সকল আধাসামরিক বাহিনীকে নিয়ে বৈঠক করেন নওয়াজ শরীফ। এদিকে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল রাহিল শরীফ ঝটিকা সফরে গেছেন আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে। তিনি তেহরিক-ই-তালেবানের পাকিস্তান প্রধান  মোল্লাহ ফজলুল্লাহকে হস্তান্তর করার আহ্বান জানিয়েছেন কাবুলের প্রতি। তাকে ধরতে তিনি দেশটির সহায়তা চেয়েছেন। এ লক্ষ্যে, আফগান কর্মকর্তাদের সঙ্গে অতিগোপনীয় গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান করেন তিনি। রাহিল শরীফ আফগান নেতৃত্বকে বলেন, আফগানিস্তানে বসে এ হামলার নকশা করা হয়েছে। আর সন্ত্রাসীদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি আশ্বাস দিয়ে বলেছেন, তীব্র শোকের এ সময়ে তার দেশ পাকিস্তানের জনগণের পাশে রয়েছে। এর আগে খবর এসেছিল, তালেবান কমান্ডার উমার নারায় আফগানিস্তান থেকে পেশোয়ার হামলার ছক এঁকেছে। এদিকে পাকিস্তান তালেবান দাবি করেছে, পেশোয়ার এলাকায় তাদের সামরিক প্রধানই এ হামলার নীল নকশাকারী। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মুখপাত্র মেজর জেনারেল অসিম বাজওয়া আর্মি পাবলিক স্কুল পরিদর্শনে গিয়ে বার্তা সংস্থা এপিকে বলেন, এটা জাতীয় বিপর্যয়। তিনি আরও বলেন, এটা কোন মানুষের কাজ নয়। পাকিস্তানের দৈনিক দ্য নেশনের শিরোনামেও ছিল একই কথার প্রতিধ্বনি ‘ডেভিলস বুচার্ড আওয়ার লিটল চিল্ড্রেন’।
পেশোয়ারে বর্বরতা: বিশ্ব নেতাদের শোক
পাকিস্তানের পেশোয়ারে বর্বর হামলায় নিন্দার ঝড় উঠেছে বিশ্বজুড়ে। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা এ ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছেন। শোক প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন শ্রেণী, পেশার মানুষ। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি-মুন এ হামলার নিন্দা জানিয়েছেন। জাতিসংঘের মুখপাত্র বলেছেন, ভয়াবহ এই ট্র্যাজেডিতে যেসব পিতামাতা ও পরিবার তাদের সন্তানদের হারিয়েছেন বিশ্ববাসীর হৃদয় তাদের জন্য কাঁদছে। সবচেয়ে কঠোর ভাষায় পেশোয়ারের এই হায়েনার হামলার নিন্দা জানায় জাতিসংঘ। এমন বর্বরতা কোন যুক্তি দিয়ে বৈধতা দেয়া যায় না। এমন ভয়াবহতার জন্য কোন অজুহাত খোঁজা চলে না। প্রতিটি শিশুর শিক্ষা অর্জনের অধিকার আছে। পাকিস্তান সন্ত্রাস ও কট্টরপন্থিদের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে। এ লড়াইয়ে সরকারের প্রচেষ্টা সমর্থন করবে জাতিসংঘ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এ বর্বরতাকে হায়েনার হামলা হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, এই সন্ত্রাসী হামলার মধ্য দিয়ে তারা আবার তাদের বিকৃত রুচির পরিচয় দিয়েছে। ওবামা বলেন, আমরা পাকিস্তানের জনগণের পাশে আছি। সন্ত্রাস ও কট্টরপন্থিদের দমনে পাকিস্তান সরকার যে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আবারও তাতে যুক্তরাষ্ট্র তার সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতার পক্ষে। ইসলামাবাদে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস থেকে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রদূত রিচার্ড ওলসন ওই স্কুলে নিহত ও আহতদের পিতামাতার প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করছেন। দূতাবাসের এক বিবৃতিতে বলা হয়, বিবেকবর্জিত ও অমানবিক এই হামলা চালানো হয়েছে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের বিরুদ্ধে। যুক্তরাষ্ট্র শক্ত ভাষায় এর নিন্দা জানায়। যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের জনগণের প্রতি সংহতি প্রকাশ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি এ হামলার নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এই কঠিন সময়ে পাকিস্তানের পাশে আছে যুক্তরাষ্ট্র। এত শিশুর মৃত্যুর কথা বিশ্বাস করা কঠিন। সন্ত্রাসীদের বিকৃত রুচির কোন শেষ নেই। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়িপ এরদোগান মঙ্গলবারই ফোন করেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফকে। এ সময় তিনি এই সহিংস হামলার নিন্দা জানান। নিন্দা জানিয়েছেন আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি ও প্রধান নির্বাহী আবদুল্লাহ আবদুল্লাহ। তারাও নওয়াজ শরীফকে ফোন করে তাদের শোকবার্তা পৌঁছে দেন। পেশোয়ারের হামলাকে নিষ্ঠুর ও কাপুরুষোচিত বলে অভিহিত করেছে জার্মানি। জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফ্রাঁ-ওয়াল্টার সেইনমেয়ার এক বিবৃতিতে এ হামলার নিন্দা জানান। নিন্দা ও শোক জানিয়েছেন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের নির্বাহী পরিচালক কেনেথ রোথ। তিনি বলেন, স্কুলের শিশুদের ওপর তালেবানের হামলাকে কোন যুক্তিতেই মেনে নেয়া যায় না। শোক প্রকাশ করেছেন পাকিস্তান তেহরিকে ইনসাফ (পিটিআই) এর প্রধান ও সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খানের সাবেক স্ত্রী জেমিমা খান। তিনি বলেন, পেশোয়ারে বর্বরোচিতভাবে যেসব শিশুকে হত্যা করা হয়েছে তাদের ও তাদের পরিবারের জন্য প্রার্থনা করছি। এ হামলার নিন্দা জানিয়েছেন পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত বৃটিশ ও সাবেক মন্ত্রী সাঈদা ওয়ারসি। তিনি বলেন, যদি অভিন্ন এজেন্ডা নিয়ে পাকিস্তানের রাজনীতিবিদ, সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো একত্রে কাজ করে তাহলেই পাকিস্তানে সন্ত্রাস পরাজিত হবে। শোক প্রকাশ করেছেন পাকিস্তান ক্রিকেটের সাবেক জাতীয় অধিনায়ক শোয়েব মালিকের স্ত্রী ও টেনিস তারকা সানিয়া মির্জা। তিনি প্রার্থনা করেছেন- হে আল্লাহ ওই সব শিশু ও তাদের পরিবারের প্রতি সদয় হও। এ খবর হৃদয়বিদারক ও বেদনাদায়ক। ভারতের বিখ্যাত গীতিকার জাভেদ আখতার বলেছেন, পেশোয়ারে তালেবানরা নিষ্পাপ শতাধিক শিশুকে হত্যা করেছে। এটা মানবতার জন্য একটি কালো দিন। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন শোক বার্তায় বলেছেন, পাকিস্তান থেকে যে খবর আসছে তা গভীর বেদনাদায়ক। শুধু স্কুলে যাওয়ার জন্য শিশুদের হত্যা করা হয়েছে এটা ভীতিকর। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এ হামলাকে কাপুরুষোচিত বলে নিন্দা জানিয়েছেন। ঘটনার দিনই তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফকে ফোন করেন। এ সময় তিনি বলেন, সন্ত্রাস দমনে, এই কঠিন সময়ে প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে প্রস্তুত ভারত। তিনি বলেন, যারা জীবন হারিয়েছেন তাদের জন্য আমার হৃদয় কাঁদছে। আমি তাদের বেদনা অনুভব করছি। প্রকাশ করছি গভীর শোক। এখানেই শেষ নয়। নরেন্দ্র মোদি গতকাল সারা ভারতের সব স্কুলকে পাকিস্তানের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে দু’ মিনিট নীরবতা পালনের নির্দেশ দেন। তার নির্দেশ মতো গতকাল ভারতের সব স্কুলে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পালিত হয় নীরবতা। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব শ্রেণীর মানুষ নিহত ও আহতদের জন্য প্রার্থনা করে। ভারতীয় ক্রিকেটার বীরেন্দ্র সেহওয়াগ টুইটারে লিখেছেন, পেশোয়ারে নিহতদের জন্য আমার প্রার্থনা। এ হামলা বর্বর, বিবেক বর্জিত ও কাপুরুষোচিত। একজন পিতা হিসেবে এই বেদনা আমাকে আঘাত করছে। নিন্দা জানিয়েছেন পাকিস্তানি কিশোরী ও শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মালালা ইউসুফজাই ও ভারতীয়  কৈলাস সত্যার্থী। পাকিস্তানি ক্রিকেটার সাকলাইন মুশতাক টুইটারে বলেন, পেশোয়ারে যে সব নিরাপরাধ শিশুকে হত্যা করা হয়েছে তাদের জন্য আমি প্রার্থনা করছি। শহীদ আফ্রিদি লিখেছেন, এ হামলার খবর আমাকে আহত করেছে। এমন নৃশংসতার বর্ণনা দেয়ার ভাষা আমার জানা নেই। এ ঘটনায় আমার হৃদয় ভারি হয়ে আছে।

No comments

Powered by Blogger.