স্কুলে হামলা: শুধুই প্রতিশোধ নয়

দুই দিন আগেও প্রাণবন্ত ছিল শ্রেণিকক্ষটি। জঙ্গি তাণ্ডবে পরিণত হয়েছে
প্রায় ধ্বংসস্তূপে। তাঁর মধ্য দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন একজন পাকিস্তানি
সেনা। মঙ্গলবারের তালেবানি হামলার শিকার পেশোয়ারের
আর্মি পাবলিক স্কুলের গতকালের চিত্র। ছবি: এএফপি
পাকিস্তানের পেশোয়ারে সেনাবাহিনী পরিচালিত একটি স্কুলে তালেবানের গত মঙ্গলবারের হামলাকে দেশটির ইতিহাসে ভয়াবহতম জঙ্গি হামলাগুলোর একটি বলা হচ্ছে। কিন্তু নির্দোষ শিশুদের ওপর কেন এই হামলা? এর মাধ্যমে কী অর্জন করতে চেয়েছে তালেবান? হামলার কিছুক্ষণ পরই দায় স্বীকার করা তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) বলেছে, সেনাবাহিনীর অভিযানে উপজাতি-অধ্যুষিত এলাকায় অনেক নিরপরাধ মানুষ, নারী-শিশু প্রাণ হারিয়েছে। তার প্রতিশোধ হিসেবেই এ হামলা চালানো হয়েছে। তবে এককথায় ‘সেনাবাহিনীর অভিযানের প্রতিশোধ’ বলে দিলে সরলীকরণ হবে। বিষয়টির আরও কিছু দিক আছে। দীর্ঘদিন ধরেই সরকারের বিরুদ্ধে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে টিটিপি। সংগঠনটির মূল লক্ষ্য বর্তমান শাসনব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে শরিয়া আইন চালু করা। তারা কথিত ‘পাশ্চাত্যমুখী’ শিক্ষা ও নারীদের চাকরি করারও বিরোধী। পাকিস্তান সরকার টিটিপির সঙ্গে শান্তি আলোচনারও উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু করাচি বিমানবন্দরে গত জুন মাসের সন্ত্রাসী হামলার পর তা স্থগিত করা হয়। এরপর টিটিপি তথা জঙ্গি নির্মূলে আফগান সীমান্তের দুর্গম উত্তর ওয়াজিরিস্তান অঞ্চলে ‘জারব-ই-আজাব’ নামের অভিযান শুরু করে সেনাবাহিনী। গবেষণা প্রতিষ্ঠান এশিয়া প্যাসিফিক ফাউন্ডেশনের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা পরিচালক সাজন গোহেল বলেন, টিটিপি চায় উপজাতি-অধ্যুষিত এলাকাগুলো নিজেদের মতো করে চালাতে। সেখানে সরকার বা সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ কোনোভাবেই মেনে নিতে চায় না তারা। সেনাবাহিনীর ‘জারব-ই-আজাব’ অভিযানে চরম ক্ষুব্ধ টিটিপি। আর পেশোয়ারের স্কুলটিতে মূলত সেনা কর্মকর্তাদের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করে। পুরুষ শিক্ষকের পাশাপাশি সেখানে নারী শিক্ষকও ছিলেন।
সবকিছু মিলিয়েই লক্ষ্যবস্তু হিসেবে ওই স্কুলটি বেছে নেয় টিটিপি। পাকিস্তানের গবেষণা প্রতিষ্ঠান জিন্নাহ ইনস্টিটিউটের রাজা রুমি বলেন, ‘টিটিপির মূল লক্ষ্য হলো পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনীর ওপর হামলা চালানো।’ কিন্তু প্রশ্ন হলো, স্কুলের মতো জায়গায় নৃশংসতা চালিয়ে কী পেল তালেবান? সিএনএনের জাতীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষক পিটার বার্গেন বলেন, এই হামলা চালিয়ে তালেবান একটা প্রচার পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাদের মূল উদ্দেশ্য সম্ভবত পূরণ হবে না। তিনি বলেন, হামলার উদ্দেশ্য যদি হয় সরকার কিংবা সেনাবাহিনীকে দুর্বল করা, সে উদ্দেশ্য সফল হচ্ছে না; বরং এই হামলার ফলে অতীতে যে পাকিস্তানিরা তালেবানের সঙ্গে শান্তি আলোচনার পক্ষে ছিলেন, তারাও এখন টিটিপির প্রতি কঠোর হবেন। বার্গেনের মতে, এই হামলার ফলে অদূর ভবিষ্যতে সরকারের সঙ্গে টিটিপির আলোচনার সম্ভাবনাও ক্ষীণ হয়ে গেল। সীমান্তের সঙ্গে লাগোয়া উত্তর ও দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তান এবং খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশে টিটিপিসহ কট্টরপন্থী গোষ্ঠীগুলোর শক্ত অবস্থান। পেশোয়ারে এই হামলার পর ওই এলাকাগুলোতে সেনাবাহিনীর অভিযান আরও জোরদার হবে বলে মনে করেন কোনো কোনো বিশ্লেষক। তবে গবেষণা প্রতিষ্ঠান মিলিটারি ইনকরপোরেশনের বিশ্লেষক আয়েশা সিদ্দিকি মনে করেন, শুধু সামরিক অভিযান জোরদার করলেই হবে না, কট্টরপন্থী গোষ্ঠীগুলোকে মোকাবিলার পদ্ধতি এবং কোনো ধরনের জঙ্গিবাদই সহ্য করা হবে কি না, সে বিষয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। তা না হলে রক্তপাত চলতেই থাকবে। আয়েশা বলেন, টিটিপি যত বেশি সম্ভব প্রাণহানি ঘটানোর নীতি নিয়েছে। তাই পৌঁছানো কঠিন—এমন লক্ষ্যবস্তুতে হামলা করতে ব্যর্থ হয়ে তারা অপেক্ষাকৃত সহজ লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটাচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.