মাদরাসা ছাত্রকে পুলিশের গুলি- চট্টগ্রামে প্রতিক্রিয়া

ছেলেটির কোন দোষ ছিল না। ওই পুলিশ কনস্টেবল তাকে হাসতে হাসতে ঊরু থেকে একটু ওপরে (মেরুদণ্ডের সংযোগস্থল) কোমরের পেছনের দিকে গুলি করে। পিস্তল তাক করে গুলি করতেই সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এরপর থানাহাজতের ভেতরে আত্মগোপনে থাকে কনস্টেবল সিরাজী। গুরুতরভাবে আহত ছেলেটির এক পায়ের ঊরু থেকে তখন রক্ত ঝরছিল অঝোরে। রাতেই তাকে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। চট্টগ্রামে গত মঙ্গলবার রাতে হাটহাজারী মাদরাসার এক ছাত্রকে পুলিশ সদস্যের গুলি করার বর্ণনা দিচ্ছিলেন মীর ইদ্রিস। তিনি পেশায় স্থানীয় আল হুদা নামের আরেকটি মাদরাসার শিক্ষক। গতকাল সকালে হাটহাজারী এলাকায় গিয়ে এ বিষয়ে জানা গেল পুলিশ সদস্যের চক্রান্তের শিকার মাদরাসা ছাত্রটি। বর্তমানে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ছিদ্দিক। তার সব ধরনের ব্যয়ভার ও চিকিৎসার খরচ পুলিশ বিভাগ দিচ্ছে বলে জানান স্থানীয়রা।
ঘটনার বিবরণ দিয়ে মাদরাসার শিক্ষক মীর ইদ্রিস বলেন, গভীর রাতে আমরা সবাই থানায় ছুটে গিয়েছিলাম। থানার ওসি বললেন ঘটনার সুষ্ঠু বিচার হবে। চিন্তা করবেন না। ওই পুলিশ কনস্টেবল কেন এমন করলো তা জানি না। তবে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে পুলিশ বিভাগ ব্যবস্থা নেবে। তাকে গ্রেপ্তার করে সকালের মধ্যেই আদালতে পাঠিয়ে দেয়া হবে।
তিনি আরও বলেন, ছেলেটি পঙ্গু হয়ে যেতে পারে। ডাক্তার বলেছে তার একটি পা অকেজো হয়ে যেতে পারে। অবস্থা গুরুতর। তাই তাকে রাতেই ঢাকায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। ছেলেটির জ্ঞান ফেরেনি। কি অবস্থায় আছে তা-ও জানি না।
স্থানীয় সূত্র জানায়, ছিদ্দিকের পুরো নাম মোহাব্বত সিদ্দিক। বন্ধুমহলে সে আবু সিদ্দিক নামে পরিচিত। খুলনা জেলার সোনাডাঙ্গা থানার বড় বয়রা গ্রামের আবদুল হান্নানের পুত্র সে। মাদরাসায় শিক্ষায় শিক্ষিত হতে তাফসির বিভাগে ভর্তি হয়েছিল সিদ্দিক।
হাটহাজারী মাদরাসার ছাত্ররা জানান, ঘটনার সময় সিদ্দিক ওই থানার সামনে দিয়ে হেঁটে আসছিল। ঘড়িতে তখন রাত সাড়ে ৮টা। গুলি করার ঘটনায় অভিযুক্ত পুলিশ কনস্টেবল রোমান সিরাজী দাবি করেন, সিদ্দিকের সঙ্গে বাকবিতণ্ডার জের ধরে রাগের বশে তিনি এ ঘটনা ঘটিয়েছেন। কিন্তু প্রত্যক্ষ গাড়িচালকরা জানিয়েছেন এ ধরনের কিছুই হয়নি। হঠাৎ করেই পুলিশ কনস্টেবল সিরাজী কোমর থেকে পিস্তল বের করে তার দিকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। এ সময় ছেলেটি ‘মাগো’ বলে চিৎকার দেয়।
আকিব হাসান নামের এক ছাত্র বলেন, আহত সিদ্দিকের বিরুদ্ধে থানায় কোন মামলা নেই। সে কোন ঘটনার সঙ্গে জড়িতও নয়। তাহলে কেন তাকে এভাবে গুলি করা হবে? এভাবে পুলিশ সদস্যের হাতে গুলি খেয়ে মরতে হলে আমাদের জীবনের নিরাপত্তা কোথায়?
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের একটি সূত্র জানায়, রাত সাড়ে ১২টায় মাদরাসার ছাত্র সিদ্দিককে গুরুতর অবস্থায় অ্যাম্বুলেন্সযোগে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সকাল সাড়ে ৮টায় তাকে পঙ্গু হাসপাতালের ই আর ওয়ার্ডের ২ নম্বর কক্ষে ভর্তি করানো হয়। ঘটনার পরপরই দারুল উলুম মইনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসার উচ্চতর তাফসির বিভাগের ছাত্ররা হাসপাতালের সামনে বিক্ষোভ করেন মঙ্গলবার রাতে। সিদ্দিকের ডান পায়ে গুলি লেগেছে। তবে এ ঘটনায় প্রভাব পড়েছে তার পিঠেও। মেরুদণ্ডে টান পড়ায় শারীরিক অবস্থার ব্যাপক অবনতি হয়েছে।
ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে বর্তমানে ছেলেটির সঙ্গে রয়েছেন নিজামউদ্দিন। তিনি গতকাল মাদরাসার ছাত্রদের প্রচুর রক্তের প্রয়োজন বলে ফোনে জানান। গতকাল বিকাল পর্যন্ত আহত সিদ্দিকের জন্য ৫ ব্যাগ রক্ত দেয়া হয়েছে। গতকাল তাকে ফোন করা হলে তিনি বলেন, ওর অবস্থা ভাল না। দোয়া করবেন। কি হয় জানি না। সিদ্দিকের কোন দোষ ছিল না। অযথা তাকে গুলি করা হয়েছে।
ঘটনার পরপরই হাটহাজারী থানায় অভিযুক্ত পুলিশ কনস্টেবল সিরাজীকে দায়ী করে মামলা করেছেন একই বিভাগের ইফতা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মো. জাফর। তিনি বলেন, এ ঘটনার কোন বিচার না হলে সারা দেশের সব মাদরাসার ছাত্র রাস্তায় নামবে। বিনা দোষে একজন ছাত্রকে কেন পঙ্গু হতে হবে? পুলিশ বলে কি তারা যা খুশি তাই করবে?
তিনি বলেন, মোহাব্বত সিদ্দিকের ওপর পুলিশ কনস্টেবলের গুলি করার ঘটনায় হাটহাজারী থানায় হত্যার চেষ্টা করার অভিযোগ আনা হয়েছে। মামলা করা হয়েছে। মামলা নম্বর ১৯/৩৩৩।
নগর পুলিশের একটি সূত্র জানায়, মাদরাসার ছাত্রকে গুলি করার ঘটনায় পুলিশ বিভাগে তোলপাড় চলছে। অভিযুক্ত কনস্টেবল সিরাজীকে ইতিমধ্যে বরখাস্ত করা হয়েছে। তাকে গতকাল আদালতে নেয়া হয়েছে। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (উত্তর) মো. শহীদুল্লাহ মানবজমিনকে বলেন, ঘটনাটি অনুসন্ধান চলছে। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। ওই পুলিশ কনস্টেবল তার দায়িত্বের বাইরে অস্ত্রের অপব্যবহার করেছে। তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
হাটহাজারী থানার একটি সূত্র জানায়, অভিযুক্ত কনস্টেবল রোমান সিরাজীর বিরুদ্ধে উচ্ছৃঙ্খলের অভিযোগ রয়েছে। কেবল তা-ই নয়, সম্প্রতি থানায় জায়গা-জমিসংক্রান্ত ঘটনার নিষ্পত্তি করতে গেলে তিনি ওই মহিলার কাছে টাকা চেয়ে থাকে। এর আগেও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহেদ নামের এক ছাত্র মামলা করতে গেলে সিরাজী তাকে নানাভাবে হয়রানি করে বলে ভুক্তভোগীরা জানান।

No comments

Powered by Blogger.