অভিবাসীর অধিকার মানবাধিকার by ড. আমিনুর রহমান

প্রতিবছর ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সব সদস্য দেশে আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস পালিত হয়ে আসছে। মূলত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে অভিবাসন এবং অভিবাসীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করেই এ দিবসের উৎপত্তি। ১৯৯০ সালের ১৮ ডিসেম্বর অভিবাসীরা তাদের পরিবার-পরিজনদের নিরাপত্তায় এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করেন। সেই সম্মেলনে অভিবাসী শ্রমিক ও তাদের পরিবারের অধিকার রক্ষায় জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ আন্তর্জাতিক চুক্তি ৪৫/১৫৮ প্রস্তাব আকারে গ্রহণ করে। বিশ্বের সব দেশকে এ সনদের সঙ্গে সঙ্গতি জানানোর আহ্বান জানানো হয়। ১৯৯৭ সাল থেকে ফিলিপিনো এবং অন্যান্য এশীয় অভিবাসী সংগঠনগুলো এ দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক ঐক্য দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। এ ধারাবাহিকতায় মাইগ্র্যান্ট রাইটস ইন্টারন্যাশনাল, ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন অন মাইগ্র্যান্ট রাইটসসহ বিশ্বের বিভিন্ন সংগঠন অভিবাসীদের স্বার্থ রক্ষার্থে বৈশ্বিকভাবে প্রচারণা চালাতে থাকে। অবশেষে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ২০০০ সালের ৪ ডিসেম্বর দিনটি পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। দিবসটি উদযাপনের জন্য এর সনদ গৃহীত হওয়ার দিনটিকে বেছে নেয়া হয়।
মানুষ নানা কারণে দেশান্তরে পাড়ি জমায়। অতীতে মানুষের দেশান্তরিত হওয়ার সঙ্গে ঔপনিবেশবাদিতার একটি সম্পর্ক ছিল। বর্তমানে কর্মসংস্থান বা ভাগ্যান্বেষণের জন্যই মানুষ দেশান্তরিত হয় বেশি। কেননা বিশ্বের সব স্থান একরকম নয়। সমানভাবে সমৃদ্ধ বা উন্নত নয়। কোনো দেশ ধনী আবার কোনো দেশ গরিব। তাই কর্মসংস্থানের বেলায় দেখা যায় বৈসাদৃশ্য। পৃথিবীর এক প্রান্তে যখন অফুরন্ত কাজের সুযোগ, তখন অন্য প্রান্তের মানুষ বেকার সমস্যায় হিমশিম খাচ্ছে। সঙ্গত কারণেই কর্মসংস্থানের তাগিদে মানুষ ছুটছে দেশ থেকে দেশান্তরে। কেউবা সুন্দর ভবিষ্যতের আশায়ও দেশত্যাগ করে। ভিনদেশে নতুন পরিবেশে তারা জীবন গড়তে চায়। কিন্তু সেখানে কি তারা নিজ দেশের পরিবারের মতোই উষ্ণ সান্নিধ্য উপভোগ করে? নিজ ভূখণ্ডের মতো জীবন কাটাতে পারে? মানুষ হিসেবে তার অধিকার, মর্যাদা ও অর্থনৈতিক সুবিধাগুলো কি নিশ্চিত হয়?
অনেক ক্ষেত্রে হয় না বলেই অভিবাসীদের অধিকার সুরক্ষার দাবিটি এত জোরালো। এ দাবি উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। কারণ বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসরত অভিবাসীর সংখ্যা ২১ কোটি ৪০ লাখ, যাদের একটি ভূখণ্ডে একত্রিত করা গেলে তা পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম জনবহুল দেশে পরিণত হতে পারত। তাছাড়া এটিও মনে রাখা দরকার, অভিবাসীরা শুধু নিজ দেশেই অর্থ পাঠায় না, তারা যে দেশকে কর্মক্ষেত্র বা আবাসস্থল হিসেবে বেছে নেয়, সেদেশের সমাজ ও অর্থনীতিকেও সমৃদ্ধ করে।
বাংলাদেশের অবস্থান
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ১৫৭টি দেশে বাংলাদেশের ৮০ লাখের বেশি মানুষ কর্মরত আছেন। এছাড়া প্রতিবছর প্রায় ছয় লাখ কর্মীর বিদেশে কর্মসংস্থান হচ্ছে। প্রবাসী আয়ের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। ১৯৭৬ সালে মাত্র ৬ হাজার ৮৭ জন কর্মী প্রেরণের মাধ্যমে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সূচনা হয়। সে বছর এ খাতে রেমিটেন্স অর্জিত হয় মাত্র ২৩.৭৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তখন মাত্র ৭-৮টি দেশে কর্মী পাঠানো হতো। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় বাড়তে থাকে কর্মীর সংখ্যা, দেশের সংখ্যা আর রেমিটেন্সের পরিমাণ। ২০১৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত বিদেশে গেছে ৮৭.০৫ লাখ কর্মী। বর্তমানে ১৫৭টি দেশে কর্মী পাঠানো হচ্ছে আর রেমিটেন্স আয় বেড়ে হয়েছে প্রায় ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অর্থাৎ ১৯৭৬ সালকে ভিত্তি বছর ধরলে ২০১৩ সালে বৈদেশিক কর্মসংস্থান বেড়েছে ১৪২.৯১ শতাংশ। রেমিটেন্স প্রবাহ বেড়েছে ৪৯৬ শতাংশ। আর দেশের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ১৮৬২.৫০ শতাংশ।
বাংলাদেশী কর্মীরা অভিবাসনের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র তৈরি করেছেন। তারা তাদের পরিশ্রমের অর্থ দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের বিনিময়ে অর্জিত অর্থ দেশে প্রেরণ করে তারা দেশের অর্থনীতির গতি বেগবান করছেন। অভিবাসনের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিটেন্স দেশের দারিদ্র্য বিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের গুরুত্ব অপরিসীম। বেকারত্ব বাংলাদেশের অন্যতম আর্থ-সামাজিক সমস্যা। ২০১০ সালের লেবার ফোর্স সার্ভে অনুযায়ী দেশে মোট শ্রমশক্তির সংখ্যা ৫.৪১ কোটি। বেকারত্বের হার ৫ শতাংশ। অধিক জনসংখ্যার দেশ বাংলাদেশ। অভ্যন্তরীণ শ্রমবাজারে কর্মক্ষম সব ব্যক্তির কর্মসংস্থান সম্ভব নয়। বৈদেশিক কর্মসংস্থানের মাধ্যমে দেশে বেকারত্বের চাপ কমেছে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিতে অভিবাসী শ্রমিকের প্রেরিত রেমিটেন্স অসামান্য ভূমিকা রেখেছে। প্রবাসী কর্মীদের পরিবারে আর্থিক সচ্ছলতা এসেছে। রেমিটেন্স শুধু আর্থিক সচ্ছলতা নয়, বিভিন্ন বিনিয়োগ ও আয় বর্ধনমূলক কাজে ব্যবহার হচ্ছে। বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রেকর্ড সৃষ্টি করেছে, যার মধ্যে রেমিটেন্সের অবদান উল্লেখযোগ্য।
যে প্রবাসীরা দেশের অর্থনীতিতে এত অবদান রাখছেন, তাদের স্বার্থে রাষ্ট্রের বিশেষ দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। রাষ্ট্র কিছু করছে না তা নয়। প্রবাসীদের জন্য জনশক্তি ব্যুরো, পৃথক মন্ত্রণালয়, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক, বৈদেশিক কর্মসংস্থান নীতি এবং ওয়েজ আর্নার ওয়েলফেয়ার বোর্ড গঠন করা হয়েছে। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন এবং সেসব দেশে সরকারি তত্ত্বাবধানে কর্মী প্রেরণ করা হয়েছে। বর্তমানে বৈদেশিক কর্মসংস্থান সরকারের একটি অন্যতম অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত খাত হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
তবে এসবই যথেষ্ট নয়। প্রবাসে অনেক বাংলাদেশী কর্মী সীমাহীন কষ্টের মধ্যে দিনযাপন করেন। বৈদেশিক মিশনগুলোকে তাদের প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে। দেশে তাদের পরিবার-পরিজনদের নিরাপত্তা বিধান করতে হবে। বিমানবন্দরে যাত্রী হয়রানি বন্ধ করতে হবে। তাদের কষ্টার্জিত বিনিয়োগের নিরাপত্তা দিতে হবে। তাদের ভোটাধিকার সুনিশ্চিত করা প্রয়োজন। প্রবাসীদের দেশের ভেতর বিশেষ সুবিধা দিতে হবে। বিদেশে কর্মরত কর্মীদের অধিকার সংরক্ষণ, তাদের অধিকতর কল্যাণ নিশ্চিতকরণ, সব ধরনের সমস্যা সমাধান ও সহযোগিতা প্রদানের জন্য কর্তৃপক্ষকে অধিকতর দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। আমরা চাই, সব ধরনের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে বের হয়ে আসুক আমাদের অভিবাসীরা। তাদের প্রতি সব অবহেলার অবসান হোক। অভিবাসীদের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক।
অভিবাসীদের প্রতিও আমাদের কিছু প্রত্যাশা আছে। তারা যেন সততা ও নিষ্ঠার মাধ্যমে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল করেন এবং বিদেশে বাংলাদেশের সুনাম বজায় রাখেন।
ড. আমিনুর রহমান : অভিবাসন গবেষক ও লেখক

No comments

Powered by Blogger.