সিলেটে শ্রমিক পুলিশ সংঘর্ষ ওসির মৃত্যু

সিলেটের ওসমানীনগরে অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে ওসমানীনগর থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান নিহত হয়েছেন। তিন ঘণ্টাব্যাপী দফায় দফায় সংঘর্ষে পুলিশ সদস্যসহ উভয়পক্ষের কমপক্ষে অর্ধশত আহত হয়েছেন। এ সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ রাবার বুলেট ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ ছাড়াও উভয়পক্ষের মধ্যে শতাধিক রাউন্ড গুলিবিনিময়ের ঘটনা ঘটে। বুধবার দুপুরে সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের ওসমানীনগর থানার গোয়ালাবাজারে দু’দল শ্রমিকের সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়লে ওই এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এ সময় ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক টানা ৩ ঘণ্টা অবরুদ্ধ ছিল। খবর পেয়ে স্থানীয় পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে তাদের লক্ষ্য করে ব্যাপক ইটপাটকেল ছুড়ে শ্রমিক ও গ্রামবাসী। একপর্যায়ে শ্রমিক-পুলিশ সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এ সময় তাদের মধ্যে শতাধিক রাউন্ড গুলিবিনিময়ের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষ চলাকালে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে গুরুতর আহত হন ওসমানীনগর থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান। প্রথমে তাকে স্থানীয় একটি ক্লিনিকে নেয়া হলে দ্রুত ওসমানী হাসপাতালে স্থানান্তরের পরামর্শ দেয়া হয়। ওসমানী হাসপাতালে নিয়ে আসার পথেই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তবে সিলেটের পুলিশ সুপার নূরে আলম মীনা দাবি করছেন, ওসি মোস্তাফিজুর রহমান গুলিবিদ্ধ বা আহত হয়ে নয়, সংঘর্ষ থামাতে গিয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন। একই বক্তব্য সিলেট জেলা পুলিশের মিডিয়া কর্মকর্তা সুজ্ঞান চাকমার। সংঘর্ষ ও গুলিবর্ষণের ঘটনায় গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ১১ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এর মধ্যে রওশন ও রুবেল নামে দু’জনকে আহত অবস্থায় সিলেট ওসমানী হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। সংঘর্ষে আহতরা হচ্ছেন- করনসী গ্রামের জুয়েল, রমজান, এমরান হোসেন, আহাদ মিয়া, আবদুল মতিন, আজাদ, ব্রা?হ্মণ গ্রামের মুহিবুর রহমান, রুবেল, শানুর, মাহমদ আলী, আবদুল হামিদ, মতিন মিয়াসহ কমপক্ষে অর্ধশত আহত হয়। সংঘর্ষ চলাকালে একটি নোয়া মাইক্রো, একটি যাত্রীবাহী বাস, তিনটি মোটরসাইকেল, ডাচ্বাংলা ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক ও বেবিশপ নামের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাংচুর করা হয়। সংঘর্ষ চলাকালে দুপুর ১২টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত মহাসড়কের সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ থাকে। এ সময় মহাসড়কের উভয়দিকে অ্যাম্বুলেন্সসহ সহস্রাধিক যানবাহন আটকা পড়ে। চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় রোগীসহ দূরপাল্লার যাত্রীদের।
প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় সূত্র জানায়, কয়েক মাস ধরে গোয়ালাবাজার অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব চলে আসছিল। এর ধারাবাহিকতায় তারা দুটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এর মধ্যে সাবেক গ্রুপটি গোয়ালাবাজারের উত্তরাংশে এবং অপর গ্র“পটি দক্ষিণাংশে অফিস স্থাপন করে। তাদের মধ্যে এ নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই বচসা চলে আসছিল। গতকাল বেলা ১১টার দিকে উভয় ইউনিয়নের শ্রমিকদের মধ্যে কথা কাটাকাটির জের ধরে উত্তেজনা দেখা দেয়। একপর্যায়ে তারা হাতাহাতি ও মারামারিতে লিপ্ত হয়। দুপুর ১২টা পর্যন্ত সংঘর্ষ শুধু শ্রমিকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। পরবর্তী সময় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ব্রাহ্মণপাড়া গ্রামবাসী সাবেক শ্রমিক ইউনিয়নের পক্ষে এবং করনসী গ্রামবাসী নতুন ইউনিয়নের পক্ষ নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এ সময় গোয়ালাবাজার পয়েন্ট পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করে রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকে। ফলে বন্ধ হয়ে যায় সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের যান চলাচল। খবর পেয়ে ওসমানীনগর থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে একদল পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। দু’পক্ষকে শান্ত করতে ব্যর্থ হলে পুলিশ রাবার বুলেট ও টিয়ার শেল ছুড়তে বাধ্য হয়। পুলিশ গুলি ও টিয়ার শেল ছুড়তে শুরু করলে বিক্ষুব্ধ শ্রমিক-গ্রামবাসী আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। তারা বৃষ্টির মতো নিক্ষেপ করে ইট-পাটকেল ও পাথর। পাল্টা গুলি ছুড়ে পুলিশের ওপর। একপর্যায়ে সংঘর্ষটি ত্রিমুখী রূপ নেয়। পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে স্থানীয় পুলিশ সহযোগিতা চায় জেলা পুলিশের। খবর পাওয়ার পর রেঞ্জ থেকে অতিরিক্ত পুলিশ পাঠানো হয় গোয়ালাবাজারে। অতিরিক্ত পুলিশ পৌঁছার আগ মুহূর্তে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মাটিতে পড়ে যান ওসি মোস্তাফিজ। গুরুœতর আহত অবস্থায় প্রথমে তাকে স্থানীয় একটি ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হলে দ্রুত সিলেট ওসমানী হাসপাতালে স্থানান্তরের পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। ওখান থেকে ওসমানী হাসপাতালে নিয়ে আসার পথেই মারা যান তিনি। ওসমানী হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যাওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এদিকে অতিরিক্ত পুলিশ গোয়ালাবাজার পৌঁছার পর সংঘর্ষে লিপ্ত দুটি গ্র“পের শ্রমিক ও গ্রামবাসী পালাতে থাকে। বিকাল ৩টার পর পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে আসলে সিলেট-ঢাকা মহাসড়কে ফের যান চলাচল শুরু হয়।
যেভাবে ওসি নিহত : সংঘর্ষ চলাকালে ওসির ওপর ইটপাটকেল পড়ে। পুলিশ টিয়ার শেল নিক্ষেপ করার পর তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে প্রথমে স্থানীয় একটি ক্লিনিকে পরে দীর্ঘ যানজট পেরিয়ে তাকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত ডাক্তার মৃত ঘোষণা করেন। সিলেটের এএসপি (মিডিয়া) সুজ্ঞান চাকমা ডাক্তারের বরাত দিয়ে ওসির মৃত্যুর বিষয়টি সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেন। বিকালে নিহত মোস্তাফিজুর রহমানের লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। রাত ৮টায় পুলিশ লাইনে তার জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। নিহত ওসি মোস্তাফিজুর রহমানের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা সদরের কোতোয়ালি থানায়। ছাত্রজীবনে কুমিল্লা শহরের সংস্কৃতি চর্চায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তিনি। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ২ কন্যা সন্তানের জনক। স্ত্রীসহ ২ কন্যা ঢাকায় বসবাস করে। এর আগে তিনি বিয়ানীবাজার থানার ওসি (তদন্ত) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ৩ মাস পূর্বে তিনি ওসমানীনগর থানার ওসি হিসেবে যোগ দেন। এদিকে ওসি মোস্তাফিজুর রহমানের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে ওসমানী হাসপাতালে ছুটে যান পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এছাড়া আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা হাসপাতালে ছুটে যান।
যেভাবে ঘটনার সূত্রপাত : কিছুদিন পূর্বে গোয়ালাবাজার অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের একজন ম্যানেজার দক্ষিণ স্ট্যান্ডের একটি অটোরিকশা অফিসে নিয়ে আসার পর শ্রমিকদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এর পর থেকে বাজারের দক্ষিণ অংশের কিছু অটোরিকশা শ্রমিক গোয়ালাবাজারে নতুন একটি শ্রমিক শাখার দাবি তুলে। সিলেট জেলা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা এলাকা পরিদর্শন করে নতুন শাখা দেয়ার আশ্বাস দিয়ে তা আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করার প্রতিশ্র“তি দেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা না করায় শ্রমিকদের একটি অংশ উত্তেজিত হয়ে মহাসড়কে নামলে এই সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। করনসী রোড এলাকার অটোরিকশা শ্রমিক নেতা পিয়ার আলী বলেন, দীর্ঘদিন ধরে জেলা কমিটি গোয়ালাবাজারে আমাদের একটি শাখা উদ্বোধন করে দিবে বলে তারিখ করে আসলেও তা দিচ্ছিল না। এর প্রতিবাদে আমরা মহাসড়কে অবস্থান নিলে অপর সংগঠনের শ্রমিকরা আমাদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়ন গোয়ালাবাজার শাখার সভাপতি জিলু মিয়া বলেন, করনসী রোডের কিছু অবৈধ লাইসেন্সধারী শ্রমিক আমাদের সংগঠনের সদস্য হতে না পেরে নতুন শাখার জন্য জেলায় আবেদন করে। এর জের ধরে তারা আমাদের শ্রমিকদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। গোয়ালাবাজার ইউপি চেয়ারম্যান আতাউর রহমান মানিক সংঘর্ষের সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়েনের সিলেট জেলার নেতারা নতুন শাখা দেয়ার কথা বলে না দেয়ায় সংঘর্ষের ঘটনাটি ঘটে।

No comments

Powered by Blogger.