ধিক এই ব্যর্থতা, এই কপটতা

সরকারিভাবে উদ্ধারকাজ স্থগিত ঘোষণার দশ মিনিটের মধ্যে কয়েক তরুণের চেষ্টায় উদ্ধার হলো শিশু জিয়াদ। তবে জীবিত জিয়াদ নয়, আ্ড়াই শ ফুট গভীর পাইপের নিচ থেকে উদ্ধার হলো তার তরতাজা মরদেহ। মনে হয় যেন ঘুমিয়ে আছে। হয়তো উদ্ধার হওয়ার কিছু আগেও ক্লান্ত জিয়াদ ঘুমিয়েই ছিল। ডাক্তার যে বলেছেন কয়েক ঘণ্টা আগে মারা গেছে জিয়াদ। আমাদের দেবদূত তরুণরা আরো আগে উদ্ধারকাজের সুযোগ পেলে হয়তো সপ্রাণ জিয়াদই উঠে আসত। কিন্তু সেটা আর হয়নি। রাষ্ট্রযন্ত্রের অত অত সংস্থা থাকতে ওই তরুণদের কিসের প্রয়োজন? আমরা ২৩ ঘণ্টা ধরে সরকারি সংস্থার ব্যর্থতার প্রদর্শনী দেখলাম। দেখলাম স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আর সরকারি কর্মকর্তার স্ববিরোধী আচরণ। অবশেষে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক সংবাদ সম্মেলনে স্বীকার করেন, এটা তাদের প্রথম অভিজ্ঞতা, তাদের দক্ষতা ও সরঞ্জামের অভাব রয়েছে। তাহলে আগেই কেন সাধারণ মানুষের সহযোগিতা আহ্বান করে তাদের সহযোগিতা নেয়া হলো না? জিয়াদকে উদ্ধারে ২৩ ঘণ্টা ধরে সরকারি কয়েকটি সংস্থা যে প্রচেষ্টা চালিয়েছে, তাতে কোনো পেশাদারি দক্ষতা কিংবা এ ধরনের উদ্ধারকাজের পদ্ধতিগত প্রক্রিয়া দেখা যায়নি। সুচিন্তিত কোনো পরিকল্পনা ধরে উদ্ধারকাজের লক্ষণও দেখিনি আমরা। বরং দেখা গেছে পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রবণতা। ফলে কেবল সময়ই নষ্ট হয়েছে। আর তাতে শিশুটিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে মৃত্যুর দিকে। শুক্রবার বিকাল চারটার দিকে ১৭ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপের ভেতর পড়ে যায় ছোট্ট জিয়াদ। খবর পেয়ে সেখানে ছুটে গিয়ে জিয়াদের মা প্রিয় ছেলের আকুতি শোনেন, “মা, আমাকে বাঁচাও।” উদ্ধারকাজে ছুটে আসা ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা নিশ্চিত করেন, সেখানে জিয়াদ পড়ে আছে। তার সঙ্গে কথা হয়েছে তাদের। তারা তাকে পানি ও জ্যুস সরবরাহ করলেন। দেশের মানুষ উৎকণ্ঠার মধ্যেও আশ্বস্ত হয়, শিশু জিয়াদ বেঁচে আছে। কিন্তু এই আশ্বাস রাত আড়াইটায় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর এক বক্তব্যে রূপ নেয় বিভ্রান্তিতে। পাইপের ভেতরে ক্যামেরা পাঠিয়ে কোনো মানুষের অস্তিত্ব না পাওয়ার এবং সেখানে কোনো মানুষ না থাকার নিশ্চয়তা দেন তিনি। এরপর উদ্ধারকাজে ঢিলেমির যে অভিযোগ উঠেছে, তাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। ফলে আরো একটি অভিযোগও যুক্তিসঙ্গতভাবেই উঠেছে সাধারণ মানুষের মধ্যে, আরো আগে উদ্ধার করতে পারলে বেঁচে যেত জিয়াদ।   শিশু জিয়াদ উদ্ধার ঘটনা আমাদের কয়েকটি দিকে উপহাসের আঙুল তুলে গেছে। আমাদের বেসামরিক নিরাপত্তা সংস্থা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স যথেষ্ট দক্ষ নয়, আমাদের প্রশাসন অবিবেচক ও অদূরদর্শী, আমাদের সেবা সংস্থাগুলো দায়িত্বহীন, আমাদের সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা জনগণের জীবনকে যথেষ্ট মূল্য দিতে ইচ্ছুক নন। আমরা অত্যন্ত বিস্মিত যে, সরকারযন্ত্র জিয়াদকে উদ্ধার করতে না পারলেও তার বাবা ও ছোট ছোট বোনদের পুলিশ ধরে নিয়ে হয়রানি করেছে। তাদের অপরাধ গুজব ছড়ানো ও জিয়াদকে লুকিয়ে রাখা। এখন প্রতিমন্ত্রী, ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ জিয়াদের বাবা-মা ও দেশবাসীর কাছে কী জবাব দেবেন? আমরা সরকারযন্ত্রের এই অদক্ষতা আর কপটতাকে জানাই ধিক্কার। মন্ত্রী, সরকারি নানা সংস্থার কর্মকর্তাদের নিশ্চয়তাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে যে তরুণরা আবেগ আর মানবিক উদ্যম নিয়ে অতল থেকে জিয়াদকে তুলে এনছে আমরা তাদের জানাই সালাম। জিয়াদের উদ্ধার ঘটনা আমাদের আবার স্মরণ করিয়ে দিল বাঙালি মনের মানবিক কোমলতার কথা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা এমনকি রাত জেগে টিভির সামনে বসে থেকে জিয়াদের বেঁচে থাকার প্রার্থনা করেছে দেশের মানুষ। আমরা দেখি জীবনের ঝূঁকি নিয়ে পাইপের ভেতর নেমে শিশুকে উদ্ধারে এক তরুণের আকুল আগ্রহ ও প্রস্তুতি। আমরা দেখি জিয়াদকে উদ্ধারে নিজেদের বুদ্ধি ও দক্ষতা কাজে লাগানোর সুযোগ পেতে কয়েকজন তরুণের রাত জেগে ঘটনাস্থলে অপেক্ষা করা। এবং যেখানে সরকার ব্যর্থ, সেখানে নিজের উদ্ভাবিত প্রযুক্তিতে মাত্র কয়েক মিনিটে জিয়াদকে উদ্ধার করার ঘটনা। আমাদের দেশে মেধার অভাব নেই। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ আন্তরিক আবেগে ঋদ্ধ, তা বারবার প্রমাণিত। আবার আমাদের সরকারযন্ত্র ও সংস্থা যে দায়িত্বহীন, সেটাও আবার আমাদের সামনে ফুটে উঠেছে জিয়াদ উদ্ধার ঘটনায়। ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক যে বললেন, এ ঘটনা থেকে আমাদের শেখার আছে, তার সঙ্গে আমরা একমত। একই সঙ্গে ফায়ার সার্ভিসের দক্ষতা বাড়াতে প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জামের ব্যবস্থা নেয়া আশু প্রয়োজন। আর পাইপটি অরক্ষিত থাকার পেছনে যে সংস্থা, প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির দায়িত্বহীনতা ছিল, তাদের বিরুদ্ধে নিতে হবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা।

No comments

Powered by Blogger.