জাতীয় ঐক্যভিত্তিক অভিন্ন ভারতনীতি সমাধানের পথ -ঢাকা ফোরামের গোলটেবিল আলোচনায় বক্তাদের অভিমত

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে আয়োজিত এক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা বলেছেন, প্রতিবেশী এই দেশ দুটির মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নতুন মাত্রা পেয়েছে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে অমীমাংসিত বিষয়গুলোর নিষ্পত্তি শুধুই পেছাচ্ছে। এর প্রধান কারণ ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে জাতীয় পর্যায়ে বিভক্তি।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, এই ধারা পরিবর্তন করতে হলে জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে নিজেদের অভিন্ন নীতি (ওয়াননেস অব আওয়ার পলিসি) সংহত করতে হবে। একেক রাজনৈতিক দল একেক রকম কথা বলবে, সরকার পরিবর্তন হলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের নীতিতে পরিবর্তন হবে, এটা বাঞ্ছনীয় নয়। এতে ফল পাওয়া যাবে না।
গতকাল শনিবার সকালে নগরের ব্র্যাক সেন্টার ইন-এ ‘বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক’ শীর্ষক এই আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন পেশার সমমনা কয়েকজন বিশিষ্ট নাগরিকের নির্দলীয় ও অলাভজনক সংগঠন ‘দ্য ঢাকা ফোরাম’ এই গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করে।
আট সদস্যের আয়োজক সংগঠনের আহ্বায়ক, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। তাঁরই সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে মূল নিবন্ধ উপস্থাপন করেন সংগঠনের সদস্য, সাবেক রাষ্ট্রদূত এম সেরাজুল ইসলাম।
তাতে বলা হয়, ২০০৯ সালে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে যে নতুন ধারা সূচিত হয়, বর্তমান মোদি সরকারের আমলে তা নতুন মাত্রা পেয়েছে। এই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ভিত্তি হচ্ছে রাজনীতি। তাই ভারত বাংলাদেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি ও গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ পর্যবেক্ষণ করছে। যেহেতু এখানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রশ্নাতীত নয়, তাই সম্পর্কের বিষয়ে ভারত পূর্ণ স্বস্তিতে নেই। এই কারণে বাংলাদেশ নিরাপত্তা ও কানেকটিভিটির নিশ্চয়তাসহ ভারতকে অনেক প্রতিশ্রুতি দিলেও ভারত স্থলসীমান্ত ও তিস্তার পানি বণ্টনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়ই মীমাংসা করছে না।
মূল নিবন্ধে বলা হয়, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের মধ্যে আরেকটি স্পর্শকাতর বিষয় হয়ে উঠেছে চীন। ভারত-চীন সম্পর্কে টানাপোড়েন থাকায় চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বিশেষ সহযোগিতার সম্পর্ক ভারতের উষ্মার কারণ হয়েছে। বিশেষ করে কক্সবাজারের সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ কয়েকটি বড় প্রকল্পে চীনের বিনিয়োগ এবং চীন থেকে বাংলাদেশের বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র কেনার ঘটনায় ভারত উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় বিষয়গুলো মীমাংসার আগে ভারত বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের বিষয়টি আরও পর্যবেক্ষণ করতে পারে।
আলোচনায় অংশ নিয়ে সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা রিয়াজ রহমান বলেন, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের মূল ভিত্তি হওয়া উচিত দুই দেশের জনগণের সমান সুবিধা (মিউচুয়াল বেনিফিট)। বিএনপি সব সময় এটা বলেছে, চেয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতকে দেওয়া অর্থনৈতিক করিডর ও নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছেন। কিন্তু ভারত এখন পর্যন্ত প্রধান সমস্যাগুলোর একটিরও সমাধান করেনি। উপরন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাদের হস্তক্ষেপ বেড়েছে।
আরেক সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী বলেন, ‘আমরা কেউ অ্যান্টি ইন্ডিয়ান, কেউ প্রো-ইন্ডিয়ান। সেখানেই সমস্যা। আসলে আমাদের হতে হবে প্রো-বাংলাদেশ। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক হতে হবে সম সুযোগের ভিত্তিতে (উইন উইন অ্যপ্রোচ)।’
সাবেক উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াজেদ আলী খান পন্নী বলেন, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নির্ণয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনা দরকার। একটি অভিন্ন জাতীয় অবস্থান নিয়ে তার ভিত্তিতে ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সমস্যা সমাধানে আলোচনা ফলপ্রসূ হতে পারে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জমির বলেন, ‘যদি আমরা একত্রে কাজ করতে পারি তাহলেই আমরা এগিয়ে যেতে পারব।’
দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনাস্থা দূর করার পদক্ষেপ অব্যাহত রাখা দরকার উল্লেখ করেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ফারুক সোবহান। তিনি বলেন, সমান সুযোগ-সুবিধা পাওয়া ও দেওয়ার (উইন উইন অ্যাপ্রোচ) মানসিকতা সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে বেশ কিছু অগ্রগতি আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ফল পেতে হলে আরও উদ্যোগী হতে হবে।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী বলেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের কারণে ভারত কখনোই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে সদাচরণ (বেস্ট প্রাকটিসেস) করেনি। এখন অমীমাংসিত বিষয়গুলোতে আটকে গেছে সম্পর্কের গতিশীলতা। নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও অনেক কিছু কাজ করছে না। যেমন ২০০৬ সালে জেএমবি নিশ্চিহ্ন করা হয়েছিল। এখন তা শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতের জন্যও হুমকি হয়ে উঠেছে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত আবদুল মোমেন চৌধুরী বলেন, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রতিটি দেশ নিজ নিজ স্বার্থ দেখবে, এটাই স্বাভাবিক। কাজেই ভারতকে দোষারোপ করে লাভ নেই। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন অভিন্ন নীতিগত অবস্থান নিয়ে কথা বলতে পারেনি। আরও যত দিন তা না পারবে তত দিন সমস্যা মিটবে না।
ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক অপরিহার্য বলে উল্লেখ করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দিলারা চৌধুরী বলেন, তবে ভারতের দাদাগিরির (হেজিমনি) প্রবণতা রয়েছে। আর বাংলাদেশের আছে জাতীয় পর্যায়ে বিভক্তি। এই অবস্থায় একটি স্বাভাবিক দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক হতে পারে না। চীনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের সঙ্গে শর্তযুক্ত হতে পারে না। ভারত ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের আদান-প্রদানের ক্ষেত্র এক নয়।
সভাপতির বক্তব্যে সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, জাতীয় নিরাপত্তার জন্য জাতীয় ঐক্যের বিকল্প নেই। বিশ্বায়নের এই যুগে ভূ-রাজনীতি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য জাতীয় ঐক্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
গোলটেবিল আলোচনায় আরও বক্তব্য দেন ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম, বিআইআইএসএসের চেয়ারম্যান মুন্সী ফয়েজ আহমেদ, সাবেক রাষ্ট্রদূত ইফতেখারুল করিম, শাহেদ আখতার, মহসিন আলী খান ও সাবিহ্ উদ্দিন আহমেদ, সিপিডির নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান, ইসফাক এলাহী ও ড. তাজ হাশমী।

No comments

Powered by Blogger.