মহামান্য আদালত- আমার একটা নালিশ আছে by মোকাম্মেল হোসেন

বাটা মাছকে আমরা বলি বাইট্যা মাছ। কয়েকদিন আগে বাজারে ঢুকে দেখি, পুঁটি মাছের ছড়াছড়ি। সস্তা পেয়ে দুই কেজি কিনে বাসায় হাজির হলাম। মরহুম হওয়ায় পুঁটিমাছগুলো লবণ বেগমের প্রতিক্রিয়া দেখার সুযোগ পেল না। আমি পেলাম। পুঁটিমাছ ট্রাজেডির পর লবণ বেগম ফরমান জারি করেছে, মাছ কেনার আগে অবশ্যই তার অনুমতি নিতে হবে। অনুমতি নেয়ার জন্য লবণ বেগমকে ফোন করে বললাম-
: ভালো বাইট্যা মাছ পাইছি। আনব কিনা কও।
- কোন জায়গার?
: মুক্তাগাছার।
- আরে বেক্কল, মাছ মুক্তাগাছার না- ফুলবাড়িয়ার, সেইটা ফ্যাক্টর না। নদীর, না পুকুরের- এইটা বল।
: এইটা তো জানি না। মাছওয়ালারে জিজ্ঞাসা করলাম- কোন জায়গার মাছ? সে বলল- মুক্তাগাছার।
-মাছ নদীর, না পুকুরের- এইটা জিজ্ঞাসা করলেই তো হয়।
: সে যদি ভুল তথ্য দেয়?
- আইচ্ছা ঠিক আছে, দাম জিজ্ঞাসা কর।
: জিগাইছিলাম। দুইশ টাকা কেজি চাইছে। কবিরাজি কইরা দেড়শ টাকায় নামানো যাইতে পারে।
লবণ বেগম নীরব হয়ে গেল। নীরবতা শেষে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল-
: তাসিনের আব্বু! কবিরাজি করতে করতেই তোমার জিন্দেগি পার হইল। ডাক্তার আর হইতে পারলা না! শোন, নদীর এক কেজি বাটা মাছের দাম কমপক্ষে ৬শ টাকা। এইটা চাষের মাছ। চাষ করা বাটা মাছ না খাওয়াই ভালো।
- কেন?
: ঘাসের মতো লাগে।
- এইগুলা মনে হয় ভালোই হবে।
: কম দামে পাওয়া যাইতেছে- এইজন্য?
- আরে না।
: তাইলে?
- মাছগুলা রূপার মতো ঝিকমিক করতেছে।
: রূপার মতো ঝিকমিক করলেই ভালো হয়- এই কথা তোমারে কে বলছে? প্রথম যখন তোমারে দেখি- তুমিও রূপার মতো ঝকমক করতেছিলা। পাতে নেওয়ার পর টের পাইছি, দেখতে ঝকমকা হইলেই জিনিস ভালো হয় না! যাকগা, আমার অত কথার দরকার নাই, তুমি অন্য মাছ দেখ।
- অন্য আর কী মাছ দেখব! পাঙ্গাশ আনি?
: আন। কাইট্যা আনবা। আস্ত মাছ ব্যাগে ভইরা ঢ্যাংঢ্যাংয়াইয়া বাসায় হাজির হবা না।
- আইচ্ছা।
পাঙ্গাশ হচ্ছে গরিবের ইলিশ। ছোটবেলায় আমরা ইলিশ মাছ খেতে খেতে ছড়া বলেছি-
: ইলিশ মাছের তিনশ কাঁটা, গলায় ফুটলে দিও না খোঁটা।
সমুদ্র বিজয়ের আনন্দে আমাদের গাল বেলুনের মতো ফুলে উঠলেও দেশে যে মৎস্য বিপ্লবের সূচনা হয়েছে, সেটাকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত টেনে নেয়ার যোগ্যতা, সাহস ও দূরদর্শিতা কোনো নেতা-নেত্রীর নেই। আমার ছেলেরা পাতে পাঙ্গাশ নিয়ে ইলিশের গল্প-কবিতা শুনবে। সহজলভ্য পাঙ্গাশ তাদের আমিষের জোগান দিলেও কাঁটার বৈচিত্র্য নিয়ে নতুন কোনো ছড়া-কবিতা রচনার সুযোগ তারা পাবে না।
১২০ টাকা কেজি দরে ২ কেজি ৬শ গ্রাম ওজনের একটা পাঙ্গাশের দাম কত হয়- মনে মনে এ হিসাব করছি, কাঁধে মৃদু চাপ অনুভব করলাম। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি, আমার বন্ধু আলাউদ্দিন। গায়ে সাপ মার্কা জামা দেখে তাকে চক্কর-বক্কর নামে সম্বোধন করতেই জিহ্বায় কামড় দিয়ে সে বলল-
: চক্কর-বক্কর বলতে যাইয়া আবার বক্কর-চক্কর বইল্য না!
আলাউদ্দিনের কথা বুঝতে না পেরে বললাম-
: চক্কর-বক্কর একটা বিশেষণ হিসেবে তোমার উপর আরোপ করছি। বক্কর-চক্কর কী জিনিস?
- আরে! বক্কর-চক্কর কী- জান না? এইটা হইল চুদুর-বুদুরের যমজ ভাই।
চুদুর-বুদুরের কাহিনী মনে পড়ল। অনেকদিন আগে এ শব্দজোড়া দেশসেরা হিসেবে নির্বাচিত জ্ঞানী-গুণীর বাহাসালয় হিমশীতল সংসদ ভবনের আবহাওয়া গরম করে ফেলেছিল। তার যমজ ভাই আবার কোন বিপত্তি ঘটায়, এটা ভেবে তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম-
: আমার চক্কর-বক্করও দরকার নাই। বক্কর-চক্করও দরকার নাই। তুমি আলাউদ্দিন। স্রেফ আলাউদ্দিন।
আলাউদ্দিন চারপাশে চোখ ঘুরিয়ে বলল-
: পাঙ্গাশ কিনলা?
- হ।
: তুমি কি মূর্খ?
পচা মাছ কিনলাম নাকি? উহুঁ! দেখে তো তরতাজা মনে হচ্ছে। তাহলে? অবাক হয়ে বললাম-
: এই কথা কেন বলতেছ?
- তুমি পত্র-পত্রিকা পড় না?
: পড়ি!
- ট্যানারি শিল্পের বিষাক্ত বর্জ্য দিয়া খামারের হাঁস-মুরগি ও মাছের খাবার তৈরি হইতেছে- এই নিউজ তোমার চোখে পড়ে নাই?
: পড়ছে।
- পড়লে এত নিশ্চিন্ত মনে রেডিমেড খাবার খাওয়া মাছের লেজ ধরছ কীজন্য?
ধরেছি কী সাধে? দেশের অধিকাংশ নদ-নদী, খাল-বিল পানিশূন্য। যেগুলোর বুকে তিরতিরিয়ে জলধারা বইছে, সেখান থেকে সংগৃহীত মাছের দাম শুনে খাওয়ার বাসনা বাষ্প হয়ে যায়। বিপুল জলরাশির সমুদ্র তার গর্ভ থেকে প্রচুর তাজা মাছের জোগান দিলেও সেগুলোর ওজন আর টাকার ওজন সমান-সমান। এসব মাছের একটা অংশ আরব দেশের খেজুরের মতো শুকিয়ে কটকি লাগার পর ৫০ গ্রাম, ১০০ গ্রাম কিনে খাব- তারও উপায় নেই। সেসব শুঁটকি মাছের গায়ে লেগে থাকা ডিডিটি পাউডার রাক্ষসের রূপ ধরে আমাকে গিলে খাওয়ার জন্য হা করে আছে। অতএব চাষের মাছই ভরসা। ভরসার এ জায়গাটাও রাক্ষস কব্জা করে ফেলছে! কার দোষে? কার পাপে?
পাপীর তালিকায় প্রথমেই দেখা গেল পুলিশের নাম। আলাউদ্দিন এক দলা থু থু নিক্ষেপ করে বলল-
: ট্যানারির বিষাক্ত বর্জ্য দিয়া চরম ক্ষতিকর মাছের খাবার তৈরির কারখানাগুলা পুলিশ ওয়ান-টুর মধ্যে বন্ধ করতে পারে। দুঃখের কথা কী বলব- ব্যাটারা ভেজাল কারখানার দরজায় খিল লাগাইতে যাইয়া নিজেরাই খিল খাইয়া যায়!
- খিল খাইয়া যায় মানে?
: ম্যানেজ হইয়া যায়।
স্কুল থেকে ইউনিভার্সিটি, দফতর-বিভাগ-সচিবালয় থেকে কোর্ট-কাছারি, সব জায়গা ম্যানেজ হওয়ার ব্যারামে আক্রান্ত। শুধু পুলিশের দোষ খুঁজে লাভ কী? আমি পুলিশের পক্ষ নিয়ে বললাম-
: পুলিশ না হয় ম্যানেজ হইল। পুলিশের উপরে তো দারোগা আছে! তারা কী করে?
- তারা ঘোড়ার লেদা পরিষ্কার করে। তোমারে একটা কথা বলি, শুইন্যা রাখ।
: কী কথা?
: দেশ ও সমাজ নিয়ন্ত্রণকারী ক্ষমতাবান-বিত্তশালী শ্রেণী অস্ট্রেলিয়া থেইক্যা আমদানি করা স্যামন মাছ খাইয়া যতই নিজেদের নিরাপদ মনে করুক, তারা আসলে নিরাপদ নয়। তাদের সামনে ভয়ংকর বিপদ অপেক্ষা করছে।
- কীসের বিপদ?
: জীবনঘাতী খাবার খাইয়া দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হইলে, তাদের লিভার, কিডনি অচল হইয়া পড়লে বিত্তশালীর কল-কারখানা, অফিস ও গাড়ির চাক্কা সচল রাখবে কে? ক্ষমতাবানের দলীয় কর্মী হইয়া স্লোগান দেবে কে? কর্মী হইয়া, শ্রমিক হইয়া সাধারণ মানুষ ক্ষমতা ও বিত্তের চুলায় লাকড়ির ভূমিকা পালন না করলে তাদের পাতিলের চাইল ফুইট্যা ভাত আর হবে না। আমরা মরব রোগে-শোকে। তারা মরবে ক্ষমতা ও টাকার শোকে।
চাচা আপনা প্রাণ বাঁচা। অন্যের মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে না ভেবে নিজের মৃত্যুর কারণ ও প্রতিকার সম্পর্কে ভাবলাম। এ ভাবনা আলাউদ্দিনের কানে যেতেই সে বলল-
: এর প্রতিকার হইল ডাইরেক্ট অ্যাকশন।
- মানে?
: শিশুখাদ্য হিসেবে প্রচলিত গুঁড়োদুধে মেলামাইনের উপস্থিতি লইয়া সারা বিশ্বে ব্যাপক হৈচৈ হইছিল- মনে আছে তোমার?
- আছে।
: চীনের প্রসঙ্গ উঠলেই আমরা মুখে ফেলা তুইল্যা ফেলি- চীন এইটা করছে, চীন ওইটা করছে। আফিমখোর হিসেবে পরিচিতি পাওয়া একটা জাতি উন্নয়নের শিখরে কীজন্য উইঠ্যা যাইতেছে- কও তো?
-কীজন্য?
: চীনের রাজনৈতিক নেতৃত্ব নীতির প্রশ্নে কোনো আপস করে না। মেলামাইন কেলেংকারির ঘটনায় যে কয়জন চীনা নাগরিক জড়িত ছিল, সঙ্গে সঙ্গে তাদের লটকাইয়া দেওয়া হইছে।
- চীনা রূপকথা শুইন্যা লাভ নাই বন্ধু। আমরা ৯ মণ ঘি জোটাতে পারব না- রাধাও নাচবে না। চীনা রাজনীতির সঙ্গে বাংলা রাজনীতির তুলনা খাটে না। আমাদের রাজনীতিতে রাজ আছে, নীতি নাই। নীতিরে নির্বাসনে পাঠানো হইছে। নীতিবিহীন রাজশাস্ত্র এখন ঝগড়া-ফ্যাসাদ, কোন্দল ও কামড়া-কামড়ির শাস্ত্রে পরিণত হইছে। একপক্ষের আন্ধারঘরের রাজমানিক লন্ডনি ইঁদুর সাইজ্যা ইতিহাসের অমোচনীয় একটা সত্য অধ্যায়ের উপর দাঁত বসাইতেছে। অন্যপক্ষের এক বড় রাজমিস্ত্রি চরদখলকারী লাঠিয়ালের ভাষায় প্রতিপক্ষের হ্যাডম দেখার ঘোষণা দিতেছে। আরেক গুঁড়া রাজমিস্ত্রি সিঙ্গাপুরে বইসা বাপের বয়সী নেতৃবৃন্দকে নেড়িকুত্তার মতো পিটানোর বার্তা প্রেরণ করতেছে। ন্যায়-নীতি ও আদর্শের প্রতীক হইয়া জ্যেষ্ঠরাজরা স্বগোত্রীয় ছোটদের ধমক তো দিতেছেই না, উল্টা মুচকি হাসতেছে। নীতিবিবর্জিত এ রাজঅঙ্গনে সাত খুন কেন- কেউ যদি ৭ কোটি মানুষের মৃত্যুর কারণ হওয়ার পরও গলা দিয়া শুধু এই আওয়াজ বাইর করতে পারে- আমি তোমার দলের লোক, ব্যস! মামলা ডিসমিস।
: এই ব্যাপারে মহামান্য আদালতের কাছে আমার একটা নালিশ আছে। দাবিও বলতে পার।
- কী দাবি?
: মহামান্য আদালত অনেক সময় স্বপ্রণোদিত হইয়া জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ভেজালের বিরুদ্ধে একটা শক্ত ব্যবস্থা নিলে খুবই ভালো হইত। দেশে যত প্রকার ভেজালকারী আছে, তাদের সংশোধন করার জন্য একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন খুব জরুরি। এই কাজ অন্য কাউরে দিয়ে হবে না। আদালতই একমাত্র ভরসা।
: তা তো বুঝলাম! মাছের ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত হইল?
- মাছের টাকা দিয়া ডাইল কিইন্যা বাসায় যাও।
ডালের দর আর পাঙ্গাশের দর প্রায় সমান-সমান। ডাল না কিনে সবজি কিনলাম। সঙ্গে আরও একটা জিনিস কিনে বাসায় ঢুকতেই লবণ বেগম বলে উঠল-
: রুমা, তোমার খালুজান মাছ আনছে। তাজাতাজা কয়েক টুকরা মাছ ভাজি কইরা ফেল।
ব্যাগ হাতড়িয়ে রুমা বলল-
: আন্টি। ব্যাগে কুনু মাছ দেখতেছি না!
লবণ বেগম কপাল কুঁচকাল। বলল-
: মাছ আন নাই?
- সবজি আনছি।
: আমি জিগাইতেছি, মাছ আন নাই?
- না।
: বাচ্চারা ভাত খাবে কী দিয়া?
- সবজি দিয়া। তবে মাছের বিকল্প হিসেবে সঙ্গে আরেকটা জিনিস আনছি।
: কী জিনিস?
- মাস্তুরি জিনিস। ছোটবেলায় বাংলাদেশ টেলিভিশনে টারজান সিরিজ দেখার সময় একবার দেখলাম- আফ্রিকার আদিবাসী এক গোত্র প্রধানের বাড়িতে যাওয়ার পর টারজানরে এক প্রকার সবুজ শরবত খাইতে দেওয়া হইল। সেই শরবত খাওয়ার পর টারজানের হাতে জঙ্গলার বাঘ-সিংহ-কুমির সব কাবু। তখন বুঝতে পারি নাই। বড় হইয়া বুঝতে পারছি- সেই শরবতটা ছিল স্পিরুলিনার শরবত। শ্যাওলা জাতীয় স্পিরুলিনা প্রক্রিয়াজাত কইরা ট্যাবলেট আকারে বাজারে ছাড়া হইছে। আমি একসঙ্গে দুই কট্টা আনছি। তোমার ছেলেরা সবজি দিয়া ভাত খাওয়ার পর একটা স্পিরুলিনা ট্যাবলেট হাতে ধরাইয়া দিবা। দেখবা তারাও টারজানের মতো পালোয়ান হইয়া উঠবে। স্পিরুলিনায় আছে প্রচুর পরিমাণ আমিষ, আয়রন, বিভিন্ন প্রকার ভিটামিন এবং ...
লবণ বেগম হাতের ইশারায় আমাকে থামিয়ে দিল। অগ্নিদৃষ্টি বলে একটা কথা আছে। তার দৃষ্টিতে এখন আগুনের আভাস। মেয়েদের দুচোখে থাকে সাত সমুদ্রের জল। সেখানে আগুন কীভাবে জ্বলে- বুঝতে পারছি না!
মোকাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.