শুধু ঘোষণায় সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না by আকমল হোসেন

কাঠমান্ডুতে দক্ষিণ এশীয় সহযোগিতা সংস্থার ১৮তম শীর্ষ সম্মেলন চলছে। ১৯৮৫ সালে শুরু হয়ে সার্ক ২৯ বছর পার করছে এ বছর। যে কোনো সংগঠনের ক্ষেত্রে নিজেকে বলিষ্ঠভাবে তুলে ধরার জন্য এ সময় নেহায়েত কম নয়। কিন্তু অন্যান্য সফল আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার তুলনায় সার্ক অত্যন্ত দুর্বল এক উদাহরণ হয়ে আছে। সনদ অনুযায়ী সার্ক শীর্ষ সম্মেলন বার্ষিক ভিত্তিতে অর্থাৎ প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও তা হচ্ছে না। কোনো সংস্থার ব্যাপ্তিকাল ও শীর্ষ সম্মেলনের সংখ্যার ফারাক দিয়ে তার সবলতা বোঝা যায়। সদস্য দেশগুলোর মধ্যে বিরাজমান অবিশ্বাস ও বৈরী সম্পর্ক সার্ক শীর্ষ সম্মেলন নিয়মিত অনুষ্ঠানের পথে একটি বাধা। সংস্থার আট সদস্যের মধ্যে প্রভাবশালী দুই সদস্য ভারত ও পাকিস্তানের বৈরিতা এক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে।
প্রত্যেক শীর্ষ সম্মেলনে সদস্য দেশগুলো একটি ঘোষণা প্রকাশ করে থাকে, যা সম্মেলনস্থলের নামে পরিচিত হয়ে থাকে। যেমন এবার কাঠমান্ডু ঘোষণা সম্মেলনের শেষদিন প্রকাশ করা হবে। প্রতিটি সম্মেলনের ঘোষণায় সহযোগিতা সম্পর্কে অনেক প্রত্যয়দীপ্ত কথার সঙ্গে নতুন নতুন লক্ষ্যও স্থির করা হয়। তবে সেসব ঘোষণা ও বাস্তবায়নের মধ্যে দেখা যায় দুস্তর পার্থক্য। সহযোগিতার কথা মুখে যত উচ্চারণ করা হয়, কার্যক্ষেত্রে সে অনুযায়ী উদ্যোগ গ্রহণ না করায় আঞ্চলিক সহযোগিতার ভিত্তি সবল হয়নি এবং এ অঞ্চলের জনগণের জীবনে এর কোনো প্রভাব পড়েনি। এটা বলা কোনো অতিকথন হবে না যে, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে স্নায়ুযুদ্ধের অবসান হলেও দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে নিজস্ব স্নায়ুযুদ্ধ বিদ্যমান থাকায় এ অঞ্চলে আঞ্চলিক সহযোগিতার বলিষ্ঠ ছাপ পড়ছে না।
আন্তঃরাষ্ট্রীয় বাণিজ্যে দক্ষিণ এশিয়া পিছিয়ে আছে- এ উপলব্ধি থেকে যে দুটি বাণিজ্য সহযোগিতা চুক্তি যথাক্রমে সাপটা ও সাফটা স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে দেশগুলো ব্যর্থ হওয়ায় আঞ্চলিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এখনও উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়নি। এর পেছনে যেমন কাঠামোগত প্রতিবন্ধকতা, তেমনি মনস্তাত্ত্বিক বাধাও কাজ করে থাকে। বিশেষ করে ভারতের বৃহৎ বাজারে অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রের প্রবেশাধিকার সহজ না হলে বাণিজ্যিক সম্পর্ক পিছিয়ে থাকবে। পাকিস্তান ছাড়া সার্কের অন্য সদস্য দেশগুলোর অর্থনীতি ক্ষুদ্র থাকার প্রেক্ষাপটে তাদের বাজারে ভারতের প্রবেশাধিকারের তুলনায় ভারতের বাজারে তাদের সহজ প্রবেশাধিকারের তাৎপর্য ভিন্ন।
১৮তম শীর্ষ সম্মেলনে এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়ক স্লোগান হচ্ছে শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য আরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। যে কোনো আঞ্চলিক সহযোগিতার পেছনের তাগিদ হচ্ছে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, যা জনগণের জীবনে গুণগত পরিবর্তন আনতে সক্ষম। শাসকশ্রেণীর জীবনের উন্নতি বা সমৃদ্ধিকে রাষ্ট্রের ভিত্তি গণ্য করার দিন অনেক আগেই গত হয়েছে। বর্তমান যুগের কল্যাণকামী রাষ্ট্রের ধারণা এর জনগণের সার্বিক জীবনমানের উন্নতির ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত। অন্যদিকে শান্তি প্রত্যয়টি দ্বারা শুধু যুদ্ধের অনুপস্থিতি বোঝায় না। এর সঙ্গে জনগণের জীবনমানের উন্নতিও সম্পর্কিত। দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে পৃথিবীর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর এক বিরাট অংশের বসবাস। অতএব সার্ক সহযোগিতা কাঠামো ব্যবহার করে দক্ষিণ এশিয়ার জনগণের জীবনে সমৃদ্ধি আনার আকাক্সক্ষা স্বাভাবিক।
এবার আঞ্চলিক সংযোগ বা কানেক্টিভিটির ধারণা অবলম্বন করে সার্ক সদস্য দেশগুলোর মধ্যে রেল যোগাযোগ এবং পণ্য ও যাত্রীবাহী মোটরযান চলাচল সংক্রান্ত দুটি চুক্তি হওয়ার কথা থাকলেও চুক্তি স্বাক্ষর নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। বাণিজ্য বৃদ্ধির তাগিদ থেকে এ ধরনের সংযোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নিঃসন্দেহে। রাজনৈতিক সীমানা টানার আগে এ অঞ্চলে মানুষ ও পণ্য চলাচলের অবাধ গতি ছিল। কিন্তু দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ওপর রাজনৈতিক জটিলতা ধীরে ধীরে প্রভাব ফেলায় এ গতি বাধাগ্রস্ত হতে হতে এক পর্যায়ে বন্ধ হয়েও গিয়েছিল। সবচেয়ে সফল আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা ইউরোপীয় ইউনিয়ন আজ যে পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে, তা দীর্ঘকালের প্রচেষ্টার ফল। সংযোগের এ ধরনের ধারণার সঙ্গে রাজনৈতিক ঐক্যের সম্পর্ক যে ঘনিষ্ঠ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পারস্পরিক অবিশ্বাস-সন্দেহ থেকেই যার যার সীমান্ত সুরক্ষা করার চিন্তার উদ্ভব হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় সুরক্ষিত সীমান্ত তৈরির চিন্তার উপস্থিতি প্রবল। যেমন, ভারত ও পাকিস্তান নিজ নিজ নিরাপত্তা চিন্তা থেকে সীমান্তকে সুরক্ষা করার উদ্যোগ নেয়। বাংলাদেশকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখার ভারতীয় চিন্তার উদ্ভব এভাবেই হয়েছে।
অন্যদিকে বাণিজ্য সম্প্রসারণের মধ্য দিয়ে অর্থনীতিকে সবল করার ভাবনা প্রকাশ পায়। মানুষের সহজ গমনাগমনের মাধ্যমে পারস্পরিক চেনাশোনা বাড়ে বলে তারও গুরুত্ব রয়েছে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের জনগণ সহজে একে অপরের দেশে যেতে পারলে নানা ধরনের কল্পিত ধারণার অবসান হয়। তাই এবারের শীর্ষ সম্মেলনের আলোচ্যসূচিতে কানেক্টিভিটির যে আলোচনার কথা আছে, তা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। ১৯৪৭ সালের পর থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে রেল সংযোগ বিদ্যমান ছিল। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর অন্যান্য সহজ সংযোগের মতো রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। নতুন করে এ ধরনের সংযোগের উদ্যোগ জনগণের মধ্যে আস্থা যেমন তৈরি করতে পারে, একই সঙ্গে তা নেপাল ও ভুটানের মতো স্থলবেষ্টিত দেশের জন্য সমুদ্রপথে বৈদেশিক বাণিজ্য বাড়াতে ভূমিকা রাখতে পারে। ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের রাজ্যগুলোর সঙ্গে পণ্য চলাচলে বাংলাদেশকে যেমন দিল্লির প্রয়োজন, তেমনি পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান ও আফগানিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সংযোগের জন্য ঢাকার প্রয়োজন ভারতের রেলপথ ও সড়কপথ ব্যবহারের সুযোগ। তাই পারস্পরিক সুবিধার ভিত্তিতে এ ধরনের সংযোগের কথা চিন্তা করা যেতে পারে।
আশির দশকে বাংলাদেশ আঞ্চলিক সহযোগিতার ধারণাসংবলিত যে ওয়ার্কিং পেপার তৈরি করেছিল, তাতে সহযোগিতা যাতে একপেশে না হয়ে যায় তার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছিল। আজ ২৯ বছর পরও তা প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি। তবে সহযোগিতাকে এগিয়ে নিতে সদস্য দেশগুলোর যে পরিমাণ উদ্যোগ নেয়া দরকার ছিল তার অভাব আছে। বিশেষত ভারত এক্ষেত্রে যে নেতৃত্ব দিতে পারত, সেটা লক্ষ্য করা যায়নি। ভারতে দল নির্বিশেষে যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক, তারা ভারতের ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার কথা বলে প্রতিবেশীদের সঙ্গে যে সম্পর্ক তৈরি করতে চায় তা একপেশে হয়ে যায়। পাকিস্তান তার চির বৈরী প্রতিবেশী ভারতকে মোকাবেলা করার নামে যে বৈদেশিক নীতি গ্রহণ করে, তাও আঞ্চলিক উত্তেজনা প্রশমনে ভূমিকা রাখে না।
দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতাকে শীর্ষ সম্মেলনের ঘোষণার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে তাকে প্রকৃত অর্থে জনগণের স্বার্থ অর্জনের মাধ্যমে পরিণত করতে হলে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ ও আঞ্চলিক আধিপত্য কায়েমের চিন্তা বাদ দিয়ে ইতিমধ্যে চিহ্নিত সহযোগিতার বিষয়গুলোর প্রতি মনোযোগী হতে হবে। তা না হলে শীর্ষ সম্মেলনের আনুষ্ঠানিকতার জন্য জনগণের করের অর্থ খরচ করার কোনো যৌক্তিকতা থাকতে পারে না।
ড. আকমল হোসেন : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.