ফেনীতে ৫ বছরের বন্দি জীবন থেকে মুক্ত মা-ছেলে

ফেনী শহরের রামপুর। চারদিকে দেয়াল তোলা বিশাল একটি বাড়ি। ভেতরে দুই কক্ষবিশিষ্ট দুটি পাকা ঘর। একটি ঘরের চারপাশে আগাছা গজিয়ে ঠিক যেন জঙ্গল। দেয়ালেও বিশ্রী রকম স্যাঁতসেঁতে-শেওলা। ঘরটির দরজায় তালা দিয়ে তার ওপর আড়াআড়ি করে অনেকগুলো রড ঝালাই করা। দেখলে মনে হবে দীর্ঘদিন ধরে অযতেœ পড়ে থাকা কোনো হিংস্র প্রাণীর খাঁচার দরজা এটি। এই ঘরে দীর্ঘ ৫ বছর ধরে বন্দিজীবন কাটিয়েছেন মা-ছেলে। জাহানারা বেগম রোজী ও তার ১১ বছর বয়সী ছেলে মেহেদী ইসলাম জিমুন। স্থানীয়রা জানান, পৈতৃক সম্পত্তি আত্মসাৎ করতে বড় ভাই শেরশাহ শিশুসন্তানসহ রোজীকে মানসিক প্রতিবন্ধী সাজিয়ে বন্দি করে রাখে। বুধবার বেলা ২টা থেকে পুলিশ ও দমকল বাহিনী প্রায় তিন ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে দরজায় সাঁটা রড কেটে তালা ভেঙে ঘরে প্রবেশ করে। সেখান থেকে মা-ছেলেকে উদ্ধার করে ফেনী সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার অসিমকুমার সাহা জানান, দীর্ঘদিন কক্ষবন্দি থাকায় তারা মানসিক প্রতিবন্ধী হয়ে গেছেন। স্বাভাবিক হতে কিছুদিন সময় লাগবে।
জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষ করে ইডেন কলেজে শিক্ষকতা করেছেন জাহান আরা বেগম রোজী (৪৫)। তার স্বামী সিলেট সদর উপজেলা সমাজসেবা অফিসার আবুল কালাম আজাদ ভূঞা। একমাত্র ছেলে মেহেদী ইসলাম জিমুনের জšে§র কিছুদিন পর ভেঙে যায় আজাদ-রোজীর সংসার। সেই সঙ্গে রোজী ও তার একমাত্র সন্তানের স্বপ্নেরও মৃত্যু হয়। খড়গ নেমে আসে মা-ছেলের জীবনে। ২০০৯ সালের শেষদিকে তাদের ওই দুই কক্ষবিশিষ্ট ঘরে বন্দি করে রাখে রোজীর বড় ভাই শেরশাহ। শেরশাহ ঢাকার ইস্কাটনে ব্যবসা করেন। দুই ভাই ও ছয় বোনের মধ্যে অপর ভাই শাহেনশাহ মানসিক ভারসাম্যহীন। এক বোন ইতিমধ্যে মারা গেছেন। বড় ভাইয়ের ভয়ে অন্য চার বোনের কেউই রোজীর খোঁজ নেয় না। তাদের তিন বোন থাকেন ঢাকায়। এক বোন ফেনী শহরেই বসবাস করেন। তিনি শহরের রামপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা।
দুটি পাকা ঘরের অন্যটি ভাড়া দেয়া। ভাড়াটেরা ভাড়ার চার হাজার টাকা পাশের দোকানে জমা দেন। আর দোকানদার রোজী ও তার সন্তানকে জানালার ফুটো দিয়ে চাল-ডাল সরবরাহ করেন। শেরশাহ খুব একটা আসতেন না বলে জানান স্থানীয়রা। ভাড়াটিয়ারা জানান, ভুতুড়ে ওই ঘরের ভেতরে একটি লাইট থাকলেও পাখাটি দীর্ঘদিন ধরে বিকল ছিল। সূর্যের আলোও সেখানে পৌঁছে না। পর্যাপ্ত আলো-বাতাস না থাকায় ভ্যাপসা-দুর্গন্ধময় হয়ে ওঠে ঘরটি। কক্ষের ভেতরে একটি টয়লেট ও রান্নার একটি চুলা আছে। এছাড়া আছে দুটি জানালা।
উদ্ধারের পর ফুটফুটে জিমুন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছিল। এক প্রতিবেশী জানান, একসময় ছেলেটি বেশ চঞ্চল ছিল। কিন্তু দীর্ঘদিন কক্ষবন্দি থাকায় ধীরে ধীরে শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়ে গেছে শিশুটি। তিনি আরও জানান, রোজীও মানসিক প্রতিবন্ধী। কেউ এলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকত। তবে জিমুন ভেতর থেকে কথা বলার চেষ্টা করত। জানালা দিয়ে পাশের ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে বই নিয়ে পড়ত। এক ভাড়াটিয়া জানান, জিমুন অত্যন্ত মেধাবী। কোনো ধরনের বই পেলে মুখস্থ করে ফেলত সে।
যুগান্তরকে জিমুন জানায়, পড়াশোনার প্রবল আগ্রহ আছে তার। সে খেলতে চায়, বন্দিদশা থেকে মুক্তি চায়। সে কথা বলতে চাইলেও মায়ের বাধায় থেমে যায়। একপর্যায়ে একটি চিরকুট ধরিয়ে দেয় সে। তাতে লেখা ‘আমি মেহেদী ইসলাম। আমার আম্মুর সঙ্গে অনেক দিন ধরে বন্দি। আমার মামা আমাদের আটকে রেখেছে।’ এ ব্যাপারে শেরশাহসহ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কাউকে পাওয়া যায়নি। ফেনীতে বসবাসকারী রোজীর বোন শিক্ষিকা নূরের সাফা নিলুর মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে তার স্বামী অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষা কর্মকর্তা নুর ইসলাম ফোন রিসিভ করেন। তবে এ ব্যাপারে কিছু বলতে তিনি রাজি হননি।

No comments

Powered by Blogger.