ডাক দিয়ে যায় মিলন by ডা. কামরুল হাসান খান

২৭ নভেম্বর ১৯৯০। ঝকঝকে সকাল। মিষ্টি রোদে শীতের আগমনী বার্তা। এদিন গণবিরোধী স্বাস্থ্যনীতি বাতিল এবং চিকিৎসকদের ২৩ দফা বাস্তবায়নের দাবিতে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের আন্দোলনের এক পর্যায়ে সারা দেশের চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে ২৪ ঘণ্টা কর্মবিরতি এবং পিজি হাসপাতালে কেন্দ্রীয় চিকিৎসক সমাবেশের কর্মসূচি নেয়া হয়। কয়েকদিন ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর ছিল উত্তপ্ত এবং সমাবেশ-মিছিল স্লোগানমুখর। বিক্ষিপ্ত গোলাগুলি, বোমাবাজি চলছে থেকে থেকে। এমনই এক উত্তপ্ত পরিবেশে চলছিল বিএমএ’র চূড়ান্ত পর্যায়ের কর্মসূচি। ডা. মিলন সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে পিজি হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মোড়ে বিএমএ’র তৎকালীন মহাসচিব ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনের সঙ্গে তার দেখা হয়। ডা. মিলন নিজের রিকশা ছেড়ে ডা. জালালের রিকশায় উঠে বসেন। রিকশা ছাড়তেই মিলন বললেন, ‘দেখেন তো জালাল ভাই কী হল, আমাকে একটু ধরেন জালাল ভাই, আমি পড়ে যাচ্ছি।’
এগুলোই ছিল মিলনের জীবনের শেষ শব্দ উচ্চারণ। মিলনকে ধরে রাখতে পারলেন না ডা. জালাল। মিলন হারিয়ে গেলেন আমাদের মাঝ থেকে, অবস্থান নিলেন ইতিহাসের পাতায়। থ্রি নট থ্রি’র একটি বুলেট তার ফুসফুস ও হৃদপিণ্ড ভেদ করে জায়গা করে নিয়েছিল বুকের পাঁজরের ভেতর। ঢাকা মেডিকেল কলেজে যখন তাকে নিয়ে যাওয়া হল, তখন মিলন কেবলই প্রাণহীন, শব্দহীন একটি দেহ। মুহূর্তেই চারদিকে বিদ্যুতের মতো ছড়িয়ে পড়ে এই মর্মান্তিক সংবাদ। গর্জে ওঠে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, রাজপথ। আন্দোলন ঝড়ের গতি পায়। চিকিৎসক আন্দোলন, ছাত্র আন্দোলন এবং সর্বদলীয় আন্দোলন একাকার হয়ে যায়। সেদিন সন্ধ্যায় সরকার জরুরি আইন ঘোষণা এবং কারফিউ জারি করে। অবশেষে সরকার পদত্যাগের ঘোষণা দেয় এবং ৬ ডিসেম্বর বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে।
ডা. শামসুল আলম খান মিলন একজন দেশপ্রেমিক, সাহসী ও প্রগতিশীল চিকিৎসক ছিলেন। সমাজ পরিবর্তনের মাধ্যমে একটি প্রগতিশীল, আধুনিক অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠন করাই ছিল তার স্বপ্ন। ডা. মিলন তৎকালীন বিএমএ’র যুগ্মসম্পাদক, ঢাকা মেডিকেল কলেজ শিক্ষক সমিতির কোষাধ্যক্ষ, কলেজের বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের প্রভাষক, প্রকৃচি আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন।
মিলনের রক্ত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিজয় সূচিত করেছে। এতে দেশবাসীর কাছে চিকিৎসক সমাজ বহুগুণে গৌরবান্বিত হয়েছে। আজ শহীদ ডা. মিলনের ২৪তম শাহাদৎ বার্ষিকীতে প্রশ্ন জাগে, আমরা চিকিৎসক সমাজ কি তার রক্তস্নাত গৌরব ধরে রাখতে পারছি? স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আজ দেশে চিকিৎসকের সংখ্যা প্রায় ৭২ হাজার, উপজেলা পর্যায়ে আধুনিক রোগ নির্ণয়ের সুবিধাসহ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা পৌঁছে গেছে। চিকিৎসকদের নিয়োগ, পদোন্নতি রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। প্রায় হাজার দশেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, সরকারি মেডিকেল ২৯টি, বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ৫৬টি, বিস্তৃত হয়েছে চিকিৎসকদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ, ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয়েছে চিকিৎসাসেবায় সুযোগ-সুবিধা। কিন্তু চিকিৎসকদের গৌরবের জায়গাটা ক্রমেই দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। ’৪৭ থেকেই এদেশের চিকিৎসক সমাজ রাজনৈতিকভাবে সচেতন যা বহুবার প্রমাণিত হয়েছে। এখন আবার সময় এসেছে এ পরিচয় নতুন করে দেয়ার। লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে যে দেশ, সে দেশের চিকিৎসকরা কেন মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে দিতে পারবে না? একটা বিষয় স্বীকার করা ভালো- চিকিৎসকদের সঙ্গে জনগণের দূরত্ব ক্রমেই বেড়ে চলেছে। কেন বেড়ে চলেছে এর অনেক ব্যাখ্যা আছে, যার কোনো কোনোটি চিকিৎসকদের নির্দোষ প্রমাণ করবে। যে অবস্থায়ই হোক, চিকিৎসা ব্যবস্থার দায়ভার চিকিৎসকদের এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। কেবল দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনই পাল্টে দিতে পারে গোটা চিকিৎসা ব্যবস্থা। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা পেয়েও আমরা চিকিৎসকরা জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে যদি গণমুখী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়াস না নেই, তবে মিলনের আত্মত্যাগ বৃথা যাবে। আজ শহীদ ডা. মিলন দেশের চিকিৎসকদের জেগে ওঠার সেই ডাক দিয়ে যাচ্ছেন।
ডা. মিলনসহ শহীদদের কাছে এদেশের প্রগতিশীল রাজনীতিকরা কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারেন না। তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাদের ক্ষমা করবে না। আজ জরুরি হয়ে পড়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সব রাজনৈতিক শক্তির ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র বিরোধী শক্তিকে সুদৃঢ়ভাবে মোকাবেলা করা- শহীদ মিলনের রক্ত আজ সেই ডাকই দিয়ে যায়।
অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান : মহাসচিব, পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদ; সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন; সাধারণ সম্পাদক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি

No comments

Powered by Blogger.