পাঁচ ব্যাংক : ১৮ সমস্যা

মারাত্মক অর্থ সংকট ও খেলাপি ঋণসহ ১৮ সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছে সরকারের বিশেষায়িত পাঁচ ব্যাংক। এগুলো স্বাভাবিক ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করতেই এখন হিমশিম খাচ্ছে। পর্যাপ্ত অর্থের অভাবে ব্যাংকের শাখাগুলোতে ঋণ বিতরণ কার্যক্রম গুটিয়ে আনা হচ্ছে। উচ্চ সুদে আমানত সংগ্রহ ও ধারদেনা করে চলতে গিয়ে ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে কয়েকটি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তৈরি করা প্রতিবেদনে সমস্যা চিহ্নিত করা হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি ব্যাংক, কর্মসংস্থান ব্যাংক, আনসার-ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংক ও প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের ওপর প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। এতে ১৮ সমস্যা শনাক্ত করে বলা হয়, এর কারণে বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো পরিচালনার ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। কোনো কোনো ব্যাংকের জন্য জরুরি ভিত্তিতে তহবিল চাওয়া হয়েছে মূলধন ঘাটতি পূরণের জন্য।
এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জানান, বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা রয়েছে। যে কারণে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। তা কমিয়ে আনতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নজরদারি করছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, ব্যাংকগুলো প্রতিষ্ঠার শুরুতে প্ল্যান অব অ্যাকশন ছিল না। কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য লোকবল ও অর্থের সংস্থান ঠিক করা হয়নি। দক্ষ লোকবল ও মনিটরিং ব্যবস্থা নেই। কিন্তু ব্যাংকগুলো করে ফেলছে। আমি নিজেও আনসার-ভিডিপি ব্যাংক না করার পরামর্শ দিয়েছিলাম। এখন এসব ব্যাংক টিকিয়ে রাখতে হলে দক্ষ ও ভালো লোক এবং অর্থের সংস্থান করতে হবে। প্রয়োজনে অন্যান্য সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের সঙ্গে মিলে যৌথভাবে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে।
রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) : এই ব্যাংকের মোট অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ ৪১৪৬ কোটি ৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ১৪০৬ কোটি ২৮ লাখ টাকা, যা মোট অনাদায়ী ঋণের ৩৪ শতাংশ। ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি প্রায় ৬৫০ কোটি টাকা। ব্যাংকটির অনুমোদিত মূলধন ৭৫০ কোটি টাকার বিপরীতে পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৭০ কোটি টাকা। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংকের কস্ট অব ফান্ড হচ্ছে ১০ শতাংশ। ৫ শতাংশ স্প্রেড ধরলে সুদের হার আসে ১৫ শতাংশ। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশে রাকাব কৃষি ঋণের ওপর ১৩ শতাংশের বেশি সুদ নেয়ার সুযোগ নেই। ব্যাংকে জনবলেরও ঘাটতি রয়েছে।
আনসার-ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংক : প্রধান সমস্যা হচ্ছে মূলধন ঘাটতি। ব্যাংকের পরিশোধিত ১০০ কোটি টাকা মূলধনের মধ্যে সরকার ২৫ কোটি টকা পূরণ করেছে। বাকি ৭৫ শতাংশ অর্থাৎ ৭৫ কোটি টাকা আনসার-ভিডিপির সদস্যদের কাছে শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে সংগ্রহ করার কথা। প্রতিবেদনে বলা হয়, ৬০ লাখ আনসার-ভিডিপি সদস্যের মধ্যে ১৮ বছরে মাত্র ২৫ লাখ ৫৮ হাজার ৪৪৩ জনের কাছে শেয়ার বিক্রি করা সম্ভব হয়েছে। এ থেকে অর্থ সংগ্রহ হয়েছে ৩০ কোটি ২২ লাখ টাকা। ফলে ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন ঘাটতি রয়েছে ৪৪ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। এই টাকা শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে সংগ্রহ করা খুবই কঠিন। ব্যাংকের তহবিল সংকট দেখা দিয়েছে। উচ্চ সুদে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে মেয়াদি আমানত সংগ্রহ করা হচ্ছে। ফলে ঝুঁকি দিন দিন বাড়ছে। অর্থের অভাবে বর্তমান শাখাগুলোতে ঋণ কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা যাচ্ছে না। এই ব্যাংক কর্পোরেট ট্যাক্স থেকে অব্যাহতি চেয়েছে। এর কারণ হিসেবে বলা হয়, আনসার-ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংক আনসার ও ভিডিপি সদস্যদের মধ্যে ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে কাজ করে।
কর্মসংস্থান ব্যাংক : নিজস্ব উদ্যোক্তা ও বাইরে থেকে আমানত সংগ্রহ করতে পারছে না ব্যাংকটি। ফলে নতুন ঋণ বিতরণের জন্য সরকারের সরবরাহকারীদের তহবিলের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয়। এ নির্ভরশীলতা কমাতে স্থায়ী আমানত সংগ্রহের অনুমোদন চেয়েছে ব্যাংকটি। প্রতিবেদনে আরও দেখা গেছে, ব্যাংকের তহবিল স্বল্পতা দেখা দিয়েছে। কর্মসংস্থান ব্যাংকের অনুমোদিত মূলধন ৭০০ কোটি টাকা। পরিশোধিত মূলধন ৫২০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৪৫ কোটি টাকা বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক এখনও পরিশোধ করেনি। প্রতিবেদনে ব্যাংকটিতে জনবল সংকটকে একটি সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। বর্তমানে এই ব্যাংকে জনবলের ঘাটতি রয়েছে ৫০৮।
প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক : প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক পরিচালনার ক্ষেত্রে চারটি সমস্যা চিহ্নিত করা হয়। সেখানে বলা হয়, ক্লিয়ারিং হাউসের সদস্য না হওয়ায় প্রবাসীদের অনুকূলে কোনো চেক ইস্যু করা যাচ্ছে না। এই ব্যাংকের কোনো শাখারই অথরাইজড ডিলার হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন না থাকায় বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া বাণিজ্যিক ব্যাংকের অনুমোদন না থাকায় বিদেশে শাখা ও এক্সচেঞ্জ হাউস খোলা যাচ্ছে না। রেমিটেন্স আনতেও কোনো ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক : কৃষি ঋণের শ্রেণীকৃত হওয়ার পরিমাণ বেশি। খেলাপি ঋণ এই ব্যাংকের একটি সমস্যা। পাশাপাশি কৃষি ঋণের সুদের হার কম বিধায় এটি সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। তবে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কৃষি ঋণের সুদের হার বাজারভিত্তিক করা সম্ভব নয়। এই ব্যাংকের কস্ট অব ফান্ড হচ্ছে ১১ দশমিক ৪৯ শতাংশ। অন্যদিকে শস্য ঋণের সুদের হার ১২ শতাংশ। ফলে ব্যাংকের পরিচালনা ব্যয় নিয়েও সমস্যা দেখা দিয়েছে। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত হিসাবে এই ব্যাংকের ঋণের স্থিতি ১৬ হাজার ৩২০ কোটি টাকা। যার মধ্যে কৃষি ও দারিদ্র্য বিমোচন খাতে ঋণ ১২ হাজার ৩৩০ কোটি টাকা। মোট কৃষি ঋণের শস্য খাতে ঋণের স্থিতি ৮ হাজার ৭ কোটি টাকা। প্রতিবেদনে বলা হয়, এই ব্যাংক মুনাফা অর্জনে সক্ষম হচ্ছে না। কারণ খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ খাত শস্য খাতে সর্বাধিক ঋণ দিচ্ছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপেদষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, নিঃসন্দেহে ব্যাংকিং খাতের জন্য এটি অসহনীয় সংকেত বহন করছে। এখন সরকারকে এক্ষেত্রে মনোযোগ দিতে হবে। দক্ষ, সৎ ও নির্ভীক লোক দিয়ে এসব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালনার মাধ্যমে পরিবর্তন আনতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.