ঢাকার মাঠও সাক্ষী এমন মৃত্যুর

রমন লাম্বার সঙ্গে কী দেখা হবে ফিল হিউজের। দুজনই তো এখন একই জগতের বাসিন্দা। হাসি-আনন্দে ঠাসা এই দুনিয়া থেকে দুজনের বিদায়ের ধরনটাও যে প্রায় একই। দুজনই যে ক্রিকেট মাঠকে ভালোবেসে এই মাঠকেই বানিয়েছেন মৃত্যুর মঞ্চ। সবচেয়ে বড় কথা—দুজনই ক্রিকেট খেলাটার ভয়ংকর দুই ট্র্যাজেডির নায়ক। আজ থেকে ১৬ বছর আগে বাংলাদেশ সাক্ষী হয়েছিল দুঃসহ এক ক্রিকেট-ট্র্যাজেডির। হ্যাঁ, রমন লাম্বার মৃত্যুর প্রসঙ্গেই বলা হচ্ছে কথাটা। লাখো-কোটি মানুষের আনন্দ-উপলক্ষ ক্রিকেট ১৬ বছর আগে এই বাংলাদেশের মাটিতেই লিখে দিয়েছিল এক অসম্ভব প্রতিভাবান ক্রিকেটারের মৃত্যুগাথা। আজ এত বছর পরেও এ দেশের ক্রিকেটকে দুঃস্বপ্নের মতোই তাড়িয়ে বেড়ায় লাম্বার ওই মৃত্যু। এ দেশের ক্রিকেটকে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেওয়া লাম্বার ওই মৃত্যুর দুঃস্বপ্ন যেন আজ অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটার হিউজের মৃত্যুর ঘটনায় নতুন করে স্তব্ধ করে দিল এ দেশের ক্রিকেটপ্রেমী মানুষকে। টেস্ট-পূর্ব যুগে ঢাকার ঘরোয়া ক্রিকেট ছিল খুবই জমজমাট। আবাহনী, মোহামেডানের মুখোমুখি হওয়াটা ছিল ওই যুগে এ দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে সবচেয়ে আরাধ্য উপলক্ষ। ১৯৯৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি এমনই এক আবাহনী-মোহামেডান লড়াইয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছিলেন ভারতীয় ক্রিকেটার রমন লাম্বা। আশি-নব্বইয়ের দশকে এ দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত পারফর্মার লাম্বার মৃত্যু সেদিন নাড়া দিয়েছিল গোটা দেশকে। শোকস্তব্ধ করেছিল সবাইকে।
আবাহনী-মোহামেডানের ওই ম্যাচে লাম্বা খেলছিলেন আবাহনীর হয়ে। ওই সময় ঢাকার প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগে প্রতি মৌসুমেই আবাহনীতে খেলতে আসতেন লাম্বা। মোহামেডানের বিপক্ষে ওই ম্যাচে শর্ট লেগে ফিল্ডিং করতে গিয়ে মোহামেডান ব্যাটসম্যান মেহরাব হোসেনের একটি পুলের আঘাতে আহত হয়ে কয়েকদিন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ছিলেন লাম্বা। রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে সেরা চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হলেও তাঁকে আর জীবনে ফেরানো যায়নি। ঢাকার মাঠকে ভালোবেসে ছিলেন, এই মাঠের টানেই বারবার ফিরে আসতেন। তিনি কী জানতেন এই মাঠই একদিন তাঁর মৃত্যুর মঞ্চ হতে চলেছে! এই ভয়াবহ ঘটনার ঘানি এ দেশের ক্রীড়াঙ্গন টেনে যাবে অনন্তকাল ধরেই।
কীভাবে আহত হয়েছিলেন লাম্বা? মোহামেডানের হয়ে ব্যাটিংয়ে তখন মেহরাব হোসেন। নন স্ট্রাইকিং এন্ডে দাঁড়িয়ে আমিনুল ইসলাম। আবাহনীর ফিল্ডাররা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন। বোলার সাইফুল্লাহ খান জেম। হঠাৎ কী মনে করে সাইফুল্লাহর একটি ওভারের মাঝপথে শর্ট লেগে নিজেকে নিয়ে এলেন লাম্বা। অনেকেই নাকি লাম্বাকে তখন হেলমেট পরার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু ক্রিকেট যিনি হৃদয় দিয়ে খেলেন, সেই লাম্বা সব আহ্বান তুচ্ছ করেই শর্ট লেগে দাঁড়ান। মেহরাবের সঙ্গে নাকি একটু কথা-বার্তাও বিনিময় হয়েছিল তাঁর। এমন একটা সময়ে হঠাৎই মেহরাবের পুল আঘাত করে তাঁর মাথার পেছন দিকে। মুহূর্তে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেও সংজ্ঞা হারাননি তিনি। নিজেকে সামলে উঠেও দাঁড়ান। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই ড্রেসিং রুমে গিয়ে বমি করতে করতে জ্ঞান হারান তিনি। তাঁর সংজ্ঞা আর কোনো দিনই ফেরেনি।
স্টেডিয়াম থেকেই তাঁকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে অনেক সময় ধরে অস্ত্রোপচারও হয়। দেশের সেরা চিকিৎসকেরা দিন-রাত পরিশ্রম করেও তাঁকে আর জীবনে ফেরাতে পারেননি। তাঁর আইরিশ স্ত্রী কিম ঘটনার পরপরই ঢাকায় এসেছিলেন। সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন দিল্লির একজন বিখ্যাত নিউরো-সার্জনকেও। কিন্তু তিনি ঢাকায় এসেই বলেছিলেন, বাংলাদেশের চিকিৎসকেরা তাঁর আঘাতের ধরন অনুযায়ী সম্ভাব্য সেরা চিকিৎসাটাই দিয়েছেন। তাঁর বাঁচার আর কোনোই আশা নেই। আহত হওয়ার পাঁচ দিন পর পারিবারিক সম্মতিতেই খুলে দেওয়া হয় তাঁর কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসযন্ত্র।
ঘটনাটি অনেক দিন তাড়িয়ে বেড়িয়েছে মেহরাব হোসেনকে। একদিনের ক্রিকেটে দেশের প্রথম সেঞ্চুরিয়ান লাম্বার এই অকাল মৃত্যুর জন্য নিজেকেই দায়ী করেছেন। থেকে থেকেই নিজেকে দিয়েছেন অভিসম্পাত। মানসিক অবসাদে ভুগেছেন বহুদিন। ঘটনার এত বছর পর আজও হয়তো মেহরাবের অবচেতনেই লুকিয়ে থাকেন লাম্বা। শুধু মেহরাব কেন, লাম্বা লুকিয়ে থাকেন এ দেশের প্রায় সব ক্রিকেটপ্রেমীর অবচেতনেই!

No comments

Powered by Blogger.