বিদায়কালে বিদ্যুৎ চুক্তি

শেষ বেলায় নাটকীয় মোড়। অন্তত একটি সুখবর দিয়ে শেষ হয়েছে অষ্টাদশ সার্ক শীর্ষ সম্মেলন। কোনো ধরনের চুক্তির সম্ভাবনা নাকচ হয়ে যাওয়ার পরও বৃহস্পতিবার সার্ক দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার লক্ষ্যে জ্বালানি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এদিন দুই বৈরী প্রতিবেশী দেশের দুই প্রধানমন্ত্রী হাস্যোজ্জ্বলভাবে করমর্দন করে সার্কের সদস্য দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ আরও কার্যকর করার ইঙ্গিতও দিয়েছেন। আর সমাপ্তির দিনে ৩৬ দফা কাঠমান্ডু ঘোষণার মধ্য দিয়ে বৃহস্পতিবার নেপালের রাজধানীতে শেষ হয়েছে ১৮তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন। কাঠমান্ডুর ভ্রিকুটি মণ্ডপে অবস্থিত রাষ্ট্রীয় সভাগৃহের নগর মিলনায়তনে স্থানীয় সময় বিকাল ৫টায় কাঠমান্ডু ঘোষণার মধ্য দিয়ে শেষ হয় দু’দিনের এ সম্মেলন। এর আগে সকালে সার্কের পর্যবেক্ষক ৯টি দেশের প্রতিনিধি দলকে সঙ্গে নিয়ে শীর্ষ নেতারা হেলিকপ্টারযোগে গিয়েছিলেন কাঠমান্ডু থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত নেপালের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র নয়নাভিরাম ধুলিখেলের ‘দাওয়ারিকা রিসোর্ট’-এ অবকাশ যাপনে। ঠাণ্ডাজনিত অসুস্থতার কারণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেখানে যেতে পারেননি। তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী ও পররাষ্ট্র সচিব ওই আয়োজনে যোগ দেন।
কার্যত দাওয়ারিকা রিসোর্টে শীর্ষ নেতারা একে অপরের সঙ্গে আলোচনায় যোগ দিয়ে বিদ্যুৎ সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছান। চুক্তিটি সই করতে অবকাশ যাপনস্থলেই নেতারা সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নেন। বিদ্যুৎ সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাবনার এমন সুখবর কাঠমান্ডুতে স্বস্তি ছড়িয়ে দেয়। যদিও এর আগে পররাষ্ট্র সচিব ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে সম্ভাব্য তিনটি চুক্তির বিষয়ে একমত হতে না পারায় সেগুলোর কোনোটিই না হওয়ার আশংকা তৈরি হয়েছিল।
বৃহস্পতিবার শীর্ষ নেতাদের আলোচনায় পাকিস্তানে পরবর্তী সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠানের বিষয়েও ঐকমত্য হয়। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ নিজেই সম্মেলনের প্রথম দিনের বক্তৃতায় ১৯তম সার্ক সম্মেলন তার দেশে আয়োজনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
বিকালে সমাপনী অনুষ্ঠানের শুরুতেই আসন গ্রহণ করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সার্কের বিদায়ী চেয়ারম্যান মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিন আবদুল গাইয়ুম, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিন তোবগে, শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মাহেন্দ রাজা পাকসে, আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট ড. আশরাফ ঘানি এবং স্বাগতিক নেপালের প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালা।
স্থানীয় সময় বিকাল সাড়ে ৪টায় নেপালের জাতীয় সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে সমাপনী অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। শুরুতেই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সহযোগিতার লক্ষ্যে ‘দক্ষিণ এশিয়ার জ্বালানি (বিদ্যুৎ) সহযোগিতা বিষয়ক রূপরেখা’ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন আট দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। দেশগুলোর শীর্ষ নেতারা চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠান পর্যবেক্ষণ করেন। এই চুক্তিতে আন্তঃসীমান্ত বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে, যার মধ্য দিয়ে সার্কভুক্ত এক দেশের বিদ্যুৎ সহজেই অন্য দেশ কিনতে পারবে। এই সমাপনী অনুষ্ঠানেই হাত মেলান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ। তারা একে অপরের চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে হাস্যোজ্জ্বল অবস্থায় হ্যান্ডশেক করেন। এ সময় সবাই বিপুল করতালি দিয়ে তাদের স্বাগত জানান।
সমাপনী অনুষ্ঠানে ৩৬ দফা সংবলিত ১৮তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন ঘোষণা তথা কাঠমান্ডু ঘোষণা অনুমোদন করা হয়। নেপালের প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালা সমাপনী ভাষণ দেন। সবশেষে সার্কের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের পক্ষে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের বক্তৃতার মধ্য দিয়ে বিকাল ৫টায় ১৮তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের যবনিকা ঘটে। সম্মেলন শেষে নেপালের প্রধানমন্ত্রী একটি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে সম্মেলনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো তুলে ধরেন।
অন্যদিকে নেপালের রাষ্ট্রপতি ড. রামবরন যাদব তার বাসভবন ‘শীতল নিবাস’-এ সার্ক সম্মেলনে যোগ দিতে আসা নেতাদের সম্মানে গতকাল নৈশভোজের আয়োজন করেন।
তথ্য উপদেষ্টার সংবাদ সম্মেলন : সার্ক শীর্ষ সম্মেলন শেষে সন্ধ্যায় কাঠমান্ডুর হোটেল র‌্যাডিসনে সংবাদ সম্মেলন করেন প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী। তিনি বলেন, অত্যন্ত সফলভাবে শেষ হয়েছে এবারের সম্মেলন। সেখানে ৩৬ দফা কাঠমান্ডু ঘোষণায় সার্ক দেশের নেতারা সবক্ষেত্রে আঞ্চলিক সহযোগিতার মাধ্যমে দেশগুলোর জনগণের উন্নয়ন ও কল্যাণের বিষয়ে একমত হয়েছেন। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিষয়ে সহযোগিতার বিষয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। যোগাযোগের ক্ষেত্রে সহযোগিতার লক্ষ্যে আরেকটি চুক্তির বিষয়ে নেতারা একমত হয়েছেন। তিন মাসের মধ্যে দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে বিষয়টি পর্যালোচনা করা হবে। এগুলো এই সার্কের অনেক বড় সফলতা।
তথ্য উপদেষ্টা আরও বলেন, এবারের সম্মেলনে ভারত ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী পরস্পরের কাছাকাছি এসে করমর্দন করেছেন। এটিও সার্ক সম্মেলনের একটি বিরাট সফলতা।
এক প্রশ্নের জবাবে ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, বিদ্যুৎ সহযোগিতা চুক্তির মাধ্যমে কেবল বাংলাদেশ নয়, এই অঞ্চলের সব দেশই উপকৃত হবে। আঞ্চলিক সহযোগিতার মাধ্যমে দেশগুলোর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট নিরসনে উজ্জ্বল সম্ভাবনার একটি দ্বারও উন্মোচিত হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব একেএম শামীম চৌধুরী ও উপপ্রেস সচিব আশরাফুল আলম খোকন।
প্রধানমন্ত্রী ফিরছেন আজ : সার্ক সম্মেলনে যোগদান শেষে আজ দেশে ফিরছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সকাল সাড়ে ১০টায় বাংলাদেশ বিমানে করে তিনি দেশে ফিরবেন। নেপালের ত্রিভুবন বিমানবন্দর থেকে যাত্রা করে দুপুর ১২টা ৫ মিনিটে তিনি ঢাকায় পৌঁছবেন বলে আশা করা হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.