‘কুঁড়েঘরে জীবন কাটিয়েছেন ভাসানী’ by কাজী সুমন

মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সারা জীবন গ্রামের কৃষকের মতো জীবন-যাপন করেছেন। সামপ্রদায়িক শক্তি, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ও মেহনতি মানুষের অধিকারের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করে গেছেন। কিন্তু আজও তার মেহনতি মানুষের মুক্তির স্বপ্ন পূরণ হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য হায়দার আকবর খান রনো। মানবজমিনকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, মওলানা ভাসানীর সম্পদের কোন মোহ ছিল না। তিনি সারা জীবন গ্রামের একজন সাধারণ কৃষকের মতো একটি কুঁড়েঘরে জীবন কাটিয়েছেন। তারা টাকা-পয়সা, বাড়ি-গাড়ির লোভ ছিল না। যতটুকু সময় তিনি জীবিত ছিলেন, ততদিন এ দেশের অসহায়, গরিব, সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কথা বলে গেছেন। আর তাদের জন্য কাজ করে গেছেন। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন- এ দেশকে সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলতে। ধনী-গরিব ভেদাভেদ ভুলে হাতে হাত মিলিয়ে চলবে। মেহনতি মানুষের অধিকারের মুক্তি হবে। তিনি বলেন, মওলানা ভাসানী অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছিলেন। যেখানে সব ধর্ম-বর্ণ ও মতের মানুষ একসঙ্গে বসবাস করবে। বৃটিশদের সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন। পাকিস্তানিদের অধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের অবসান হলেও আজও মেহনতি মানুষের অধিকারের মুক্তি হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের এ সংগঠক বলেন, ১৯৪৯ সালের ২৩শে জুন মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ সেই ভাসানীর আদর্শ থেকে দূরে সরে গেছে। তারা ভাসানীর অবদানকে অস্বীকার করছে। মওলানা ভাসানীর নাম পাঠ্যপুস্তক থেকে মুছে ফেলা হয়েছে। তিনি বলেন, মওলানা ভাসানী যে চিন্তা-চেতনা নিয়ে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পরে বঙ্গবন্ধু সেই ধারা অনুসরণ করেছেন। কিন্তু এখন তারা ভাসানীর অস্তিত্বকে ভুলে গেছে। এটা খুবই দুঃখজনক। মওলানা ভাসানীর জীবন থেকে বর্তমান রাজনীতিবিদদের শিক্ষা নেয়ার আহ্বান জানিয়ে হায়দার আকবর বলেন, ভাসানীর নির্মোহ জীবনাদর্শ থেকে রাজনীতিবিদদের শিক্ষা নেয়া উচিত। তাহলে আমাদের দেশের রাজনীতির অচলাবস্থার অবসান হয়ে যাবে। প্রতিহিংসার রাজনীতি বন্ধ হবে। তরুণ প্রজন্মকেও মওলানা ভাসানীর জীবনাদর্শ অনুসরণ করার আহ্বান জানান তিনি।

১৮৮০ সালে সিরাজগঞ্জ শহরের উপকণ্ঠে ধানগড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করা এই ক্ষণজন্মা নেতার জীবনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়ে হায়দার আকবর বলেন, ১৯১৯ সালে উপমহাদেশে অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলন শুরু হলে এ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন মওলানা ভাসানী। এই আন্দোলন তার সামনে নতুন দিগন্তের সূচনা করে। ১৯৩৬ থেকে প্রায় সুদীর্ঘ ১০ বছর পর্যন্ত লাইন প্রথা বিরোধী আন্দোলন করেন মওলানা ভাসানী। বাঙ্গাল খেদাও বলে আসামের জমিদাররা কৃষকদের ওপর চালায় নির্মম অত্যাচার। আসামের উচ্ছেদকৃত বাস্তুহারা কৃষকদের কাছে মওলানা ভাসানী আবিষ্কৃৃত হয়েছিলেন ত্রাণকর্তারূপে। এসব কৃষকের পরম দুর্দশার দিনগুলোতে সুদূর বাংলা থেকে কোন বড়  নেতা তাদের হয়ে আসামে সংগ্রাম করতে যাননি। ১৯৪২ সালে লাইন প্রথা ভাঙার শপথ নিয়ে ভাসানচরে এক কৃষক সম্মেলন আহ্বান করেন, সেখান থেকেই তার নামের সঙ্গে ‘ভাসানী’ যুক্ত হয়। তিনি বলেন, বৃটিশ ভারতে ইংরেজ খেদাও আন্দোলন, লাইন প্রথা বিরোধী আন্দোলন, আজাদী আন্দোলন, ৫২-র ভাষা আন্দোলন, ২১ দফা তথা স্বাধিকার আন্দোলন, ’৬৯-এর গণভ্যুত্থান, স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার আন্দোলন, ফারাক্কা মিছিল, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, বাংলা খুতবা ও হক কথার প্রকাশ, খোদায়ী খিদমতগার প্রতিষ্ঠাসহ অনেক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন মওলানা ভাসানী। রনো বলেন, ফারাক্কা বাঁধের প্রতিবাদে ১৯৭৬ সালের ১৬ই মে এক বিশাল লংমার্চের আয়োজন করেন তিনি। দু’দিনে ১০০ কিলোমিটার পথ হেঁটে ১৭ই মে রাজশাহীর চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে গিয়ে শেষ হয়। সেখানে তিনি বলেছিলেন, গঙ্গার পানিতে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যার ন্যায়সঙ্গত দাবি মেনে নিতে ভারত সরকারকে বাধ্য করার জন্য আমাদের অন্দোলন। আমি জানি এখানেই শেষ নয়। সত্যিই তার কথা প্রমাণিত হয়েছে।  সেখানেই শেষ হয়নি, আজও আমাদের ফারাক্কা ও টিপাইমুখ বাঁধের প্রতিবাদে লড়াই করতে হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.