কোন পথে রাজনীতি by মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন

সভা-সমাবেশ ও অন্যান্য শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পালন করা রাজনৈতিক দল বা জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার। এ অধিকারে হস্তক্ষেপ করা বা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে বাধা সৃষ্টি করা অনৈতিক, অবিবেচনাপ্রসূত ও নিন্দনীয়। কিন্তু দেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল বিএনপিকে রাজধানীতে সমাবেশ করার অনুমতি দেয়নি সরকার। ৭ নভেম্বর উপলক্ষে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এ সমাবেশ করতে চেয়েছিল বিএনপি। কিন্তু অনুমতি না পাওয়ায় আহূত সমাবেশ অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। এই সমাবেশে বক্তব্য দেয়ার কথা ছিল বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার। উল্লেখ্য, এর আগেও খালেদা জিয়ার দুটি ঘরোয়া সমাবেশ সরকার পণ্ড করেছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপিকে কেন সমাবেশ করতে দেয়া হয়নি- এ বিষয়ে সরকারের তরফ থেকে কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে, দেশের গণতন্ত্র কি নির্বাসিত? দেশটি যদি গণপ্রজাতন্ত্রী হয়, তাহলে একটি রাজনৈতিক দল সমাবেশ করতে পারবে না কেন?
বিএনপি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার অনুমতি চেয়ে যথারীতি আবেদন করেছে। কিন্তু ঢাকা মহানগর পুলিশ অনুমতি দেয়নি। পত্রিকায় এসেছে, এ বিষয়ে উপকমিশনারের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেছেন, বিএনপি যদি ঘরোয়া সমাবেশ ও কর্মসূচি পালন করতে চায়, সে ক্ষেত্রে তাদের নিরাপত্তা দেয়া হবে। এর অর্থ কী দাঁড়ায়? বিএনপি রাজপথে বা মুক্ত স্থানে কর্মসূচি পালন করতে পারবে না? দেশে তো সামরিক শাসন নেই, জরুরি অবস্থাও জারি নেই; তাহলে কোন অবস্থা জারি আছে? এ প্রশ্ন ওঠা তো স্বাভাবিক। এসব রাজনীতি ও দেশের জন্য কোনো ভালো খবর তো নয়ই বরং চরম মন্দ খবর। এর জের রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের নাগরিককে একসময় বইতে হবে। কাজেই রাজনীতিকে তার সঠিক পথে চলতে দেয়া উচিত । রাজনীতির গতি রোধ করা কোনোভাবেই সমীচীন নয়। নদীর স্রোত, বাতাসের গতিবেগ ও মানুষের আবেগ যেমন আটকে রাখা যায় না, তেমনি রাজনীতির গতিও রোধ করা যায় না। এই নির্মোহ সত্য অনুধাবন করা সবার জন্য অপরিহার্য।
বিএনপিকে যদি নিরাপত্তার অজুহাতে সমাবেশ করতে না দেয়া হয়ে থাকে, তাহলে সেটা সরকারের ভুল সিদ্ধান্ত হিসেবে পরিগণিত হতে বাধ্য। কারণ বিএনপি অতীতে যত বড় বড় সমাবেশ করেছে, তার সব ক’টিই ছিল শান্তিপূর্ণ ও স্বতঃস্ফূর্ত। কোনো গোলযোগ জনসমাবেশগুলোয় হয়নি। তাছাড়া কয়েক দিন আগেও খালেদা জিয়া দেশের বিভিন্ন স্থানে সমাবেশ করেছেন এবং সেগুলো সবই ছিল শান্তিপূর্ণ ও স্বতঃস্ফূর্ত। সুতরাং নিরাপত্তার অজুহাত এখানে ধোপে টেকে না। বিএনপিকে সমাবেশ করতে না দেয়ার ইচ্ছাটাই এখানে কাজ করেছে প্রবলভাবে। এমন হয়ে থাকলে এটা অবশ্যই ভুল ও হঠকারী সিদ্ধান্ত।
একজন সাধারণ মানুষ ভুল করলে এর খেসারত তিনি নিজে অথবা তার পরিবার দিয়ে থাকে। কিন্তু সরকার যদি ভুল করে বা ভুল সিদ্ধান্ত নেয়, এর খেসারত দিতে হয় রাষ্ট্র তথা জনগণকে। তাই সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হয় ভেবেচিন্তে ও ঠাণ্ডা মাথায়। শুধু সমাবেশের ক্ষেত্রেই নয়, দেশের চলমান রাজনীতি এবং একটি মধ্যবর্তী নির্বাচনের ব্যাপারেও সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে ঠাণ্ডা মাথায়। কথায় আছে, একটি ঠাণ্ডা মাথার সিদ্ধান্ত হাজারও উত্তেজিত মাথার সিদ্ধান্তের চেয়ে উত্তম।
ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করলে মধ্যবর্তী নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ নির্বাচনের ওপর বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভরশীল। বাংলাদেশ বিশ্বে কোন
মর্যাদায় আসীন হবে তা নির্ভর করছে এই নির্বাচনের ওপর। এ নির্বাচন নিয়ে টালবাহানা করা প্রকারান্তরে বাংলাদেশের অসীম সম্ভাবনা ধ্বংস করার শামিল। দেশের ভালো চাইলে সব দলের অংশগ্রহণে আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের চিন্তা করতে হবে। তাহলেই বাংলাদেশের জন্য বয়ে আনা সম্মান মানুষের কাজে লাগবে।
আসলে বিএনপিকে কৌশলে নির্বাচনের বাইরে রাখার একটা খেলা চলছে। দলটিকে কোনোভাবে নির্বাচনের বাইরে রাখতে
পারলেই যেন সরকার বেঁচে যায়। বিএনপির উচিত সরকারের এই বিপজ্জনক কৌশলকে অত্যন্ত পরিপক্বতার সঙ্গে মোকাবেলা করা এবং আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়া। কারণ
সরকার মুখে যাই বলুক, দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি একটি মধ্যবর্তী নির্বাচনের ইঙ্গিতই দেয়।
ভোটের রাজনীতিতে শাসক দল এতটা অসহায় হয়ে পড়েছে যে, সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা শুনলেই তারা ভয় পায়। সংবিধানের দোহাই দিয়ে পার পেতে চায়। বিএনপিকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করতে চায়। রাজনৈতিক অঙ্গনে গুঞ্জন আছে, জামায়াতের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের একটা গোপন সমঝোতার প্রক্রিয়া চলছে। যুদ্ধাপরাধের বিচার ইস্যুতে দেশের রাজনীতি একটি জটিল সমীকরণের মধ্যে দাঁড়িয়ে। এই সমীকরণকে পুঁজি করে সরকার পার পেতে চায়। এই বিপজ্জনক সিদ্ধান্ত চূড়ান্তভাবে ক্ষমতাসীন দলের জন্যই বিপদ ডেকে আনবে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন।
রাজনীতিতে কোন কাজটি এ মুহূর্তে করতে হবে এবং কোনটির জন্য করতে হবে অপেক্ষা- এটি নির্ধারণ করা অপরিহার্য। চাপ প্রয়োগ ছাড়া কোনো রাজনৈতিক দাবি আদায় হয়েছে- এমন নজির ইতিহাসে নেই। আওয়ামী লীগের মতো দলের কাছ থেকে রাজনৈতিক সুবিধা আদায় করতে হলে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের কোনো বিকল্প নেই। এই ঐক্য গড়ার এখনই যথাযথ সময়। সময়ের কাজ সময়ে না করলে পরে পস্তাতে হয়।
একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় থাকার পরিবেশ এখন আর নেই। দীর্ঘ গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতায় দেশে অনেক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। মানুষ যার যার ভোট নিজে দিতে শিখেছে। প্রায় ৯ কোটি ভোটারের ছবিসহ পরিচয়পত্র তৈরি হয়েছে, যা বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্রে এক মাইলফলক। এখন ইচ্ছা করলেও একজনের ভোট আরেকজনে দিতে পারেন না বা দেয়ার পরিবেশও নেই। তথ্যপ্রযুক্তি ও গণমাধ্যম বহুদূর এগিয়েছে। বলা যায়, একটি বিশ্বমানের গণমাধ্যম বাংলাদেশে কাজ করছে, যা মানুষের ভোটাধিকার রক্ষায় সর্বদা সচেষ্ট। একে ফাঁকি দেয়ার ক্ষমতা কোনো দল, গোষ্ঠী বা ব্যক্তির নেই। তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে মুহূর্তের মধ্যেই যে কোনো খবর সম্প্রচার হয়ে যায় বিশ্বজুড়ে। তাই নির্বাচনে জালিয়াতি বা ভোট ডাকাতি করে কেউ পার পাবে না। ফুটেজ থেকে যাবে গণমাধ্যম কর্মীদের হাতে- এই ভয়ে নির্বাচনে জালিয়াতি বা ভোট ডাকাতি করতে কেউ উৎসাহী হবে না।
বাংলাদেশ ঐক্যের দিক থেকে বিশ্বে একটা নিদর্শন ছিল। কিন্তু এখন জাতি হিসেবে সব দিক থেকে আমরা বিভক্ত। বিভক্ত জাতি সাহসহীন, আশাহীন বিপন্ন এক জাতিতে পরিণত হয়। সবকিছু বিপন্ন হওয়ার আগে সরকারের উচিত বিরোধী দলকে আস্থায় নেয়া এবং সংকট দূর করে দেশকে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দিকে ধাবিত করা। এর জন্য শাসক দলকে অবশ্যই সংকীর্ণ দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি ত্যাগ করতে হবে, জাতীয় ঐক্যের পথ প্রশস্ত করতে হবে।
হিংসা-বিদ্বেষ ও অনৈক্য-বিভাজনের রাজনীতি দিয়ে বর্তমান ক্রান্তি সময় অতিক্রম করা অসম্ভব। এখন প্রয়োজন দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে উদারনৈতিক রাজনীতি। সর্বোপরি নির্দলীয় সরকারের অধীনে পক্ষপাতহীন, সুষ্ঠু মধ্যবর্তী নির্বাচনের ব্যবস্থা করলে সরকারের হারানো জনপ্রিয়তা যেমন পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে,
তেমনি শাসক দলকেও মানুষ নতুন চোখে দেখবে। সর্বোপরি দেশ এগিয়ে যাবে স্থায়ী শান্তি ও স্থিতির পথে।
মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন : রাজনীতি বিশ্লেষক

No comments

Powered by Blogger.