নরওয়ের অসলোতে প্রতিবাদী স্বর্ণা by এনামুল হক

বাল্যবিবাহ ভেঙে গ্রামে তুমুল আলোচিত হয়ে ওঠে স্বর্ণা। শুধু নিজের নয়, গ্রামের যেখানেই বাল্যবিবাহ সেখানেই ঝাঁপিয়ে পড়তো সে। কখনও কন্যাশিশুর মা-বাবাকে বুঝিয়ে আবার কখনও বা সে শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি অথবা প্রশাসনের সহযোগিতায় ভেঙে দিয়েছে বাল্যবিয়ে। এ কারণেই ৮ থেকে ১০ গ্রামের শিশুদের মধ্যে এখন সে প্রতিবাদী এক কিশোরী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। সাহিদা আক্তার স্বর্ণা শ্রীপুর উপজেলার মাওনা ইউনিয়নের সিংদিঘী গ্রামের দরিদ্র তোতা মিয়ার কন্যা। নিজের অদম্য ইচ্ছার কাছে চরম দারিদ্র্যকেও হার মানিয়েছে স্বর্ণা। সে এখন গাজীপুরের ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজের প্রাণীবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। স্বর্ণার স্বপ্ন, গ্রামের গণ্ডি পেরিয়ে দেশের অবহেলিত শিশু ও নারীদের পাশে দাঁড়ানোর। স্বর্ণা বর্তমানে প্ল্যান বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল শিশু সুরক্ষা দলের সদস্য ও যুব নারী সংঘের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছে। গত ৭ই অক্টোবর তিন দিনব্যাপী নরওয়ের অসলোতে অনুষ্ঠিত শিশু ও নারী বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনেও অংশ নেয় সে। সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী ইর্না সোলবার্গ। সম্মেলনে স্বর্ণা তার জীবনের দুঃখগাথা তুলে ধরে। স্বর্ণার বাড়ি গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। জানা গেল, পাশের গ্রামে শিশুদের নিয়ে স্বর্ণা সচেতনতামূলক ‘উঠোন বৈঠক’ করছে। শিশুদের ওই বৈঠকে গিয়ে কথা হয় তার সঙ্গে। সে জানায়, তার বাবা তোতা মিয়া স্বাক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন মানুষ। মা শরিফুন নেছা পড়ালেখা করেননি। তার বাবা সব সময়ে একটি পুত্রসন্তান কামনা করেছেন। কন্যাসন্তান ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত। পুত্রসন্তানের আশায় একেক করে তারা পাঁচ বোন জন্ম নেয়। পুত্রসন্তান জন্ম দিতে ব্যর্থ হওয়ায় তার মাকে অবর্ণনীয় নির্যাতন করতেন বাবা তোতা মিয়া। বোনদের সঙ্গেও চরম দুর্ব্যবহার করতেন। পড়ালেখার খরচ দিতে পারবেন না বলে তাঁদের শিশু বয়সেই বিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন তোতা। প্রথমে বড় বোন মোক্তারা আক্তারকে বাল্যবিবাহ দেন তার বাবা। এরপর মাত্র ১৪ বছর বয়সে তার ছোট বোন ইসমত আরাকেও জোরপূর্বক বিয়ে দেয়া হয়। জোরপূর্বক বিয়ে দেয়ায় ইসমত আরা কয়েকদিন পরই স্বামীর বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে মাওনা চৌরাস্তা এলাকায় পোশাক কারখানায় চাকরি নিয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করে। দ্বিতীয় কন্যা রাশিদা আক্তারকেও বাল্যবিবাহ দেন তোতা মিয়া। একপর্যায়ে গত ২০০৫ সালে তার মা শরিফুন নেছাকে ‘অপয়া’ আখ্যা দিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেন তোতা মিয়া। তখন সে মাওনা ইউনিয়নের বারোতোপা আফসার উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্রী। স্বর্ণা জানায়, নবম শ্রেণীর ছাত্রী থাকাকালে পাশের চকপাড়া গ্রামের এক নির্মাণ শ্রমিকের সঙ্গে তাকে না জানিয়ে তার বিয়ের দিন-ক্ষণ ঠিক করে তার বাবা। বিয়ের কথা জানতে পেরে প্রথমে সে অস্বীকৃতি জানায়। তাতে কাজ না হলে সিংদিঘী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি রেজাউল করিম রুবেল, স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) সদস্যসহ গ্রামের শিক্ষকদের ঘটনা জানায়। তার বাবা সিদ্ধান্ত না বদলালে সে তার নানাবাড়ি গিয়ে বাবার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার আকুতি জানায়। এতে তার বাল্যবিবাহ ভেঙে যায়। এরপর তার পড়ালেখার খরচ দিতে না চাইলে সে প্রতিবেশীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিশুদের পড়িয়ে তার পড়ালেখার খরচ যোগাতে থাকে। ২০১০ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে এসএসসি পাস করে স্বর্ণা। এরপর আবারও তাকে বিয়ে দিতে উঠেপড়ে লাগে তার বাবা। পোশাক কারখানার এক শ্রমিকের সঙ্গে তার বিয়ের দিন-ক্ষণও ঠিক করা হয়। এবার তার বাবার সঙ্গে যোগ দেয় তার বড় ভগ্নিপতি। সে রাজি না হওয়ায় তার বাবা তাকে মারধরও করে। কিন্তু তার অমতে বিয়ে দিলে সে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকি দেয়। এতে পিছু হটে তার বাবা ও ভগ্নিপতি। দুই দফা সে নিজের বিয়ে পণ্ড করায় গ্রামে নানা কথা রটে। কেউ বলেন, মেয়ের অন্য কারও সঙ্গে গভীর প্রেম রয়েছে। কেউ বা বলেন এ কেমন জাতের মেয়ে! এরই মধ্যে প্রতিবেশী এক শিশুর বাল্যবিবাহের খবর জেনে সে ছুটে গিয়ে অভিভাবকদের বিয়ে বন্ধ করার আহ্বান জানায়। সে ব্যর্থ হওয়ার পর শ্রীপুর উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তাকে ঘটনা জানায়। পরে উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা বিলকিস নাহার পুলিশসহ ঘটনাস্থলে গিয়ে বাল্যবিবাহ ভেঙে দেন। স্বর্ণা জানায়, এভাবে গ্রামে একের পর এক বাল্যবিবাহ পণ্ড করে দেয় সে। কিন্তু গ্রামে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য সিংদিঘী গ্রামে শিশুদের নিয়ে গড়ে তোলে ‘সূর্যমুখী শিশু ক্লাব’। পাশাপাশি সে অন্তর্ভুক্ত হয় প্ল্যান বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল’র শিশু সুরক্ষা প্রকল্পে। প্ল্যান বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল’র উদ্যোগে গত ২০১২ সালে মাওনা ইউনিয়ন শিশু ফোরামের সভাপতি নির্বাচিত হয় সে। প্ল্যান বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল’র উদ্যোগে গত ৭ই অক্টোবর সাহিদা আক্তার স্বর্ণা নরওয়ের অসলোতে অনুষ্ঠিত শিশু ও নারী বিষয়ক সম্মেলনে যোগ দেয়। ওই সম্মেলনে ১৩টি দেশের ৩২ জন শিশু ও নারী প্রতিনিধি অংশ নিয়েছিলেন। প্ল্যান বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল’র মিডিয়া অফিসার বিপ্লবী রায় জানায়, দিনভর উপোস দিয়ে বিদ্যালয়ে যাওয়াসহ নিজের পড়ালেখার খরচ জোগানোর সংগ্রামী জীবন বেছে নিয়েছে স্বর্ণা। দারিদ্র্য আর ঘরের নিপীড়ন তাকে সংগ্রামী হিসেবে গড়ে তুলেছে বলেও সম্মেলনে জানায় সে। স্বর্ণার দুঃখগাথা শুনে সম্মেলনে যোগ দেয়া সকল শিশু ও নারী আবেগআপ্লুত হয়ে পড়েন। সম্মেলনে  সাহিদা আক্তার স্বর্ণাকে বিশ্বের সবচেয়ে কনিষ্ঠ নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী মালালা ইউসুফজাইয়ের সঙ্গে তুলনা করে নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী ইর্না সোলবার্গ বলেন, ‘স্বর্ণা হলো বাংলার মালালা ইউসুফজাই।’ নরওয়ের অসলোতে অনুষ্ঠিত স্বর্ণার সফরসঙ্গী ছিলেন প্ল্যান বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল’র শিশু সুরক্ষা প্রকল্পের সমন্বয়কারী নার্গিস বেগম।

No comments

Powered by Blogger.