এগিয়ে যাওয়ার ১৬ বছর- কালকের পৃথিবীটা আমাদের হবে by মতিউর রহমান

কী অপরূপ এই হেমন্তের সকালগুলো! গাছের পাতা সবুজ, সকালের রোদ এসে পড়ে পাতায় পাতায়, শিশিরবিন্দু ঝিকমিকিয়ে ওঠে। যেন রবীন্দ্রনাথের ‘আলোর নাচন পাতায় পাতায়’। হেমন্তের এমনই একদিনে, ১৬ বছর আগে যখন আমরা ঠিক করেছিলাম, একটা নতুন কাগজ করব, তখন রবীন্দ্রনাথের গান ‘প্রথম আলোর চরণধ্বনি উঠল বেজে যেই’ থেকে কাগজের নামটা চয়ন করেছিলাম ‘প্রথম আলো’।
আমরা আসলে প্রথম আলোর পাতাগুলোও আলোয় আলোয় সাজাতে চাই। কাজটা সহজ নয়, কঠিন। উড়োজাহাজ যখন ঠিকভাবে অবতরণ করে, সেটা খবর নয়, ভেঙে পড়লেই খবর। তবু দুঃসংবাদে আকীর্ণ পৃথিবীতে ও স্বদেশে পাঠকেরা সুখবরই পড়তে চান। বিশেষ করে বাংলাদেশের পাঠকেরা। মুক্তিযুদ্ধে জয়ী এ জাতি জীবনের নানা ক্ষেত্রে বিজয়ের জন্য আকুল হয়ে আছে। ব্যক্তিজীবন থেকে জাতীয় জীবন—যেখানেই সাফল্যের খবর পাই, গভীর আগ্রহ নিয়ে সেটা আমরা পড়ি।
১৬ বছর আগে থেকেই আমরা বলতাম, ‘যা কিছু ভালো, তার সঙ্গে প্রথম আলো’। সেই কথাটা, আপনারা, প্রথম আলোর পাঠকেরা, আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেছিলেন। সব সময়ই আমাদের চেষ্টা থাকে, একটা ভালো খবরের কাগজ হয়ে ওঠার, সুসাংবাদিকতা দিয়ে, পেশাদারি দক্ষতা, নিরপেক্ষতা, দেশপ্রেম আর গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ধারণ করে; সততা ও সাহস দিয়ে—কোনো চাপের কাছে নতিস্বীকার না করে। অন্যায়-অবিচার, বঞ্চনা-দুর্নীতি, সাম্প্রদায়িকতা-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সচল রাখতে চেষ্টা করেছি আমাদের কলম, যাতে মানুষ প্রতিকার পায়। যাতে অন্ধকার কাটিয়ে সমাজ এগোতে পারে আলোর দিকে।

খুবই পরিকল্পিতভাবে, সচেতন সিদ্ধান্ত নিয়ে সাংবাদিকতা দিয়েই ভালোর সঙ্গে আমাদের থাকার চেষ্টা ছিল অবিরাম। শনিবারের বিশেষ প্রতিবেদন, যেখানে ছাপা হয় দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের আশাজাগানিয়া ইতিবাচক খবর। সেখান থেকে শুরু করে ‘আমিই বাংলাদেশ’। জাতিসংঘের শান্তি মিশনে বাংলাদেশের অবদান থেকে শুরু করে নারী বৈমানিক—আলোর খোঁজেই ছুটে চলেছি আমরা। পলান সরকারের মতো ‘আলোর ফেরিওয়ালা’, যিনি মাইলের পর মাইল হেঁটে মানুষকে বই বিতরণ করেন, তার খবর আমরা প্রকাশ করেছি। কার্তিক পরামানিকের গাছ লাগানোর খবর আমরা পরিবেশন করেছি যত্নের সঙ্গে। নিয়মিত প্রকাশ করেছি অদম্য মেধাবীদের কথা, শত প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে যারা অর্জন করেছে ভালো ফল।
সাংবাদিকতার পাশাপাশি নানা রকম ভালো উদ্যোগের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত রাখার চেষ্টা করেছি। তার মধ্যে রয়েছে অ্যাসিড-সন্ত্রাসবিরোধী আন্দোলন থেকে গণিত অলিম্পিয়াড, সিডর-আইলায় ত্রাণ কর্মসূচি থেকে সেরা বইয়ের পুরস্কার, অদম্য মেধাবীদের পাশে থাকা কিংবা সেরা ক্রীড়াবিদের পুরস্কার।
আমরা জানি, বিন্দু থেকেই সিন্ধু, ব্যক্তি থেকেই জাতি। তাই বলেছি নিজেকে বদলানোর কথা, তার মাধ্যমে সমাজকে, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ের কথা।
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ নানা রকম সৃজনশীল কাজ করে করে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, সেখানেই আমাদের এই প্রত্যয়, এই আশাবাদ বাস্তবের ভিত্তি পেয়েছে। গত বছর রাজনীতিতে যখন ঘোর দুর্বিপাক, তখনো আমরা বলেছি, পথ হারাবে না বাংলাদেশ। কারণ, আমরা আস্থা রেখেছি সেই সব কৃষকের ওপরে, যাঁরা বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছেন, সেই সব প্রবাসী ও স্বদেশবাসী শ্রমিকদের ওপরে, যাঁরা আমাদের অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছেন, অতন্দ্র তারুণ্যের ওপরে, যাঁরা আমাদের প্রগতির চাকাকে পেছনে ঘুরতে দেবেন না। আমাদের সে বিশ্বাস বৃথা যায়নি।
বাংলাদেশের মানুষ ছড়িয়ে পড়েছেন সারা বিশ্বে। ইন্টারনেটে দেখা যাচ্ছে, প্রথম আলো পড়েন সারা বিশ্বের ২১০টি দেশ ও অঞ্চলের বাংলাভাষীরা। জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্র ১৯৪। সেই দিক থেকে প্রথম আলোর পাঠকদের সংঘ আরও বড়। প্রতিদিন ৬০ লাখ পাঠক, মাসে এক কোটি ৩৫ লাখ মানুষ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রথম আলো পড়ছেন। প্রথম আলো ডটকম আজ পৃথিবীর এক নম্বর বাংলা ওয়েব পোর্টাল। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক ব্যবহারকারীদের মধ্যে প্রথম আলোর ফ্যানসংখ্যা ৩৪ লাখেরও বেশি।
সম্প্রতি প্যারিসে (২৪ থেকে ২৬ সেপ্টেম্বর) হয়ে গেল স্পার্ক নিউজের আয়োজনে ‘ইন্টারন্যাশনাল ইমপ্যাক্ট জার্নালিজম ডে’র আন্তর্জাতিক আসর। সেখানে বিশ্বের ৪০টি দেশের বিখ্যাত ৪০টি পত্রিকার সম্পাদক-সিনিয়র সম্পাদকেরা একত্র হন। লন্ডনের সানডে টাইমস, প্যারিসের লা মদঁ, টোকিওর আসাহি শিম্বুন-এর মতো বিশ্বের ৪০টি বিখ্যাত পত্রিকার সারিতে ছিল বাংলাদেশের প্রথম আলো। এসব কাগজে ছাপা হয় বিভিন্ন দেশের প্রেরণাদায়ী খবর। প্রথম আলো থেকে পাঠানো ‘আলোর ফেরিওয়ালা’ পলান সরকারের ছবি ও খবর। সেটা ছাপা হয় বিভিন্ন ভাষার সংবাদপত্রে। প্যারিসের আলোচনায় প্রথম আলোর পক্ষ থেকে আমি হাজির ছিলাম। বিভিন্ন ভাষার কাগজে প্রথম আলোর লোগোটা দেখে অনুপ্রাণিত বোধ করেছি।
আর হন্ডুরাসের একটি পত্রিকার সম্পাদক যখন আমাকে বললেন, দেখো, তোমাদের পলান সরকারের খবর পড়ে আমার গায়ের রোম খাড়া হয়ে গেছে, তখন নিজেই শিহরিত হয়েছি। বাংলাদেশের পলান সরকারের খবর পড়ছেন বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ। কারণ, ইমপ্যাক্ট জার্নালিজম ডে উপলক্ষে প্রকাশিত বিশেষ ক্রোড়পত্রের মাধ্যমে বিশ্বের নানা প্রান্তের ১০ কোটি পাঠক জেনেছেন প্রথম আলো সম্পর্কে। এর কয়েক দিন পর যেতে হলো কাতারে। কাতারের প্রকাশনা সংস্থা দার আশ্শারকের সহযোগিতায় দোহা থেকে বাংলায় বেরোচ্ছে প্রথম আলোর সাপ্তাহিক উপসাগরীয় সংস্করণ। পাঠক, প্যারিস আর কাতারের অভিজ্ঞতা লিখেছি আরেকটু বিস্তারিতভাবে—আজকের ক্রোড়পত্রে সেটা পড়ে নিতে পারেন।
এই যে বাংলা ভাষা আর বাংলাদেশের খবর ছড়িয়ে পড়ছে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে, তার মূলে কিন্তু রয়েছেন দেশের সাধারণ মানুষ আর আমাদের দেশপ্রেমিক অভিবাসীগণ।
এ দেশের মানুষ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশকে, আমরা সেই অগ্রযাত্রার খবর পৌঁছে দিচ্ছি পৃথিবীব্যাপী। আমাদের প্রধান কাজ আশা জাগিয়ে রাখা। স্বপ্ন ছাড়া একটি জাতি এগোতে পারে না। আমাদের মানুষেরা আমাদের স্বপ্নগুলোর ভিত তৈরি করছেন। আমরা সেই স্বপ্নের কথা অক্ষরের মাধ্যমে প্রকাশ করছি। বাংলাদেশের মানুষ যেখানেই যাচ্ছেন, ভালো করছেন, দেশের মুখ উজ্জ্বল করছেন। আমরা সেই উজ্জ্বল বাংলাদেশের ছবি এঁকে চলেছি। দ্রুত অগ্রসরমাণ সময়ের চাহিদার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে প্রথম আলো ক্রমাগত নিজেকে সাজাচ্ছে নতুন রূপে—নতুন বিভাগ চালু করতে হচ্ছে, নতুন অবয়ব কিংবা আয়োজনের পসরা সাজাতে হচ্ছে। সে মোবাইল অ্যাপসই হোক, কিংবা ম্যাগাজিন আকারে বর্ণিল বৈশাখ বা কিশোর আলো প্রকাশের মাধ্যমেই হোক—সংযোজন-পরিবর্তনে আমরা ক্লান্তিহীন। আর এসব কিছুর মূলে আছেন আপনারা, প্রথম আলোর পাঠকেরা, যাঁরা এই কাগজের প্রাণ।
আমরা স্বপ্ন দেখছি, আগামীকালের পৃথিবীটা আমাদের হবে। জ্ঞান-বিজ্ঞানে, শিল্প-সংস্কৃতিতে, ব্যবসা-বাণিজ্যে আমরা অর্জন করব আন্তর্জাতিক মান। পৃথিবীর সর্বত্র আমরা ছড়িয়ে আছি, সবখানেই আমরা ভালো করব আর ভালোর খোঁজে বিশ্ববাসীকে আসতে হবে এই বাংলাদেশেই।
১৬টা বছর পেরিয়ে আজ আমরা প্রকাশনার ১৭ বর্ষে উন্নীত হলাম। এই ১৬ বছরের পথচলা সব সময় মসৃণ, বাধাহীন ছিল না। চড়াই-উতরাই ছিল। ‘সত্য যে কঠিন’, কঠিনকে আমরা ভালোবেসেছি। বাধা-বিপত্তি, প্রতিকূলতা তো আসবেই। কিন্তু বিপুল মানুষের ভালোবাসা নিয়ে আমরা আমাদের নীতি ও আদর্শ নিয়ে এগিয়ে চলেছি। অন্যায়-অসত্যের কাছে আমরা কখনো মাথা নত করিনি, করবও না।
প্রিয় পাঠক, প্রথম আলোর ষোড়শ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এই আলোকিত ভোরে আপনি আমাদের ভালোবাসা, কৃতজ্ঞতা, ধন্যবাদ আর অভিনন্দন গ্রহণ করুন। এই দিনে প্রথম আলোর ঘোষণা, আমাদের প্রতিদিনের চেষ্টা থাকবে ইতিবাচক খবরকে আরও গুরুত্ব দেওয়া। ভালোই ডেকে আনবে আরও ভালোকে। আলো এনে দেবে আলোর উৎসব। ‘প্রথম আলোর চরণধ্বনি’ গানে রবীন্দ্রনাথ স্বপ্ন দেখেছেন, ‘দেশ-বিদেশের সকল ধারা সেইখানে হয় বাঁধনহারা/ কোণের প্রদীপ মিলায় শিখা জ্যোতিসমুদ্রেই।’ প্রথম আলো নামের যে প্রদীপটি আমরা বাংলাদেশে প্রজ্বলিত করেছি, তা এখন দেশ-বিদেশে আলো ছড়াচ্ছে। বাংলাদেশও সম্মানের আসন লাভ করছে বিশ্বসভায়। তাই তো আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস—কালকের পৃথিবীটা আমাদের হবে।

No comments

Powered by Blogger.