আশুরার ইতিবৃত্ত ও গুরুত্ব by মাওলানা ফয়সল আহমদ জালালী

‘আশুরা’ শব্দটি আরবি ‘আশারাহ’ ধাতু থেকে এসেছে। ‘আশারাহ’ শব্দের অর্থ হলো, মহররমের দশ।  দশম দিবসে পালিত হয় বলে একে আশুরা বলে। কেউ কেউ মনে করেন, এই দিন আল্লাহ তায়ালা দশজন নবীকে সম্মানিত করেছিলেন বলে একে আশুরা নামে অভিহিত করা হয়। আশুরা দিবসটি প্রাচীনকাল থেকে বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে আসছে। ইহুদিরা আশুরা দিবসে রোজা রাখত। কারণ এই দিন নবী মুসা আ: ফেরাউনের কবল থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। মক্কার মুশরিকেরাও আশুরা দিবসে সাওম পালন করত। কারণ  নিজেদের দাবি করত ইবরাহিম আ:-এর অনুসারী। হজরত ইবরাহিম আ: এই দিনে জন্মলাভ করেছিলেন; এই দিনেই তিনি নমরুদের আগুন থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। আশুরা দিবসে আর যেসব বিস্ময়কর ঘটনা ঘটেছিল তা হলো : এ দিন আদি পিতা হজরত আদম আ:-এর তওবা কবুল হয়েছিল। হজরত নূহ আ:-এর জাহাজ তীরে ভিড়েছিল। ঈসা আ:-এর জন্ম এই দিনে এবং আসমানে এই দিনেই তাকে উত্তোলন করা হয়েছিল। ইউনুস আ:কে মাছের পেট থেকে মুক্ত করা হয়েছিল এবং তার কওমকে আজাব থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছিল একই দিনে। হজরত ইউসুফ আ:কে কুয়া থেকে উঠানো হয়েছিল এই দিন। হজরত আইয়ুব আ: দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে এই দিন আরোগ্য লাভ করেছিলেন। এই দিনে হজরত ইদরিস আ:কে আসমানে উত্তোলন করা হয়েছিল। হজরত সুলায়মান আ: এই দিন সিংহাসনে পুনরায় অধিষ্ঠিত হন।
আশুরা দিবসে সাওম পালনের জন্য রাসূলুল্লাহ সা: নির্দেশ দিয়েছেন। ফলে ইসলামের প্রাথমিক যুগে আশুরার সাওম ফরজ ছিল বলে ধারণা করা হয়। দ্বিতীয় হিজরি সনে রমজানের সাওম ফরজ হওয়ার বিধান নাজিল হলে আশুরার সাওম ঐচ্ছিক হিসেবে বিবেচিত হয়। তবুও তার সাওয়াবে কমতি নেই। আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘রমজানের পর সর্বাধিক উত্তম সিয়াম হলো মহররম মাসের সিয়াম। আর ফরজের পরে সর্বাধিক উত্তম সালাত হলো তাহাজ্জুদের সালাত’ (মুসলিম আস-সাহিহ, ১ম খণ্ড, ৩৫৮)। আরো বর্ণিত আছে, ‘আশুরা দিবসের সাওম সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সা:কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেছিলেন, ‘এর ফলে পূর্ববর্তী বছরের গোনাহ মাফ করে দেয়া হয়’ (মুসলিম, প্রাগুক্ত)।
আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘জাহিলিয়া যুগে কুরাইশরা আশুরা দিবসে সাওম পালন করত। রাসূলুল্লাহ সা:ও সে কালে সাওম পালন করতেন। মদিনায় এসেও তিনি সাওম পালন করতে লাগলেন এবং অন্যদেরও নির্দেশ দিলেন। রমজানের সাওমের আদেশ নাজিল হলে আশুরা দিবসকে বর্জন করা হয়। এখন কেউ চাইলে তা পালন করুক আর চাইলে তা বর্জন করুক’ (বুখারি, আস-সাহিহ, ১ম খণ্ড, ২৬৮)।
হজরত আবু মুসা আল আশআরি রা: থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘আশুরা দিবসকে ইহুদিরা ঈদ হিসেবে গণ্য করত। নবী কারিম সা: তা দেখে মুসলমানদের নির্দেশ দিলেন, তোমরা এই দিন সাওম পালন করো’ (বুখারি, প্রাগুক্ত)।
আশুরা সাওমের অবস্থান সম্পর্কে খোদ সাহাবায়ে কেরামের যুগে বিতর্ক জমে উঠেছিল। কেউ একে ওয়াজিব, কেউ সুন্নত আবার কেউ এর বিপরীত একে হারাম বা মাকরুহও আখ্যায়িত করেছিলেন। এক হজের মওসুমে মুআবিয়া রা: বিশেষ করে মদিনার আলেমদের ডেকে বললেন, (কারণ এদের মাঝে এর চর্চা ছিল বেশি) হে মদিনাবাসী, তোমাদের আলেমেরা কোথায়? আমি রাসূলুল্লাহ সা:কে বলতে শুনেছি তিনি এ দিবসের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, ‘এটি আশুরা দিবস। আল্লাহ এ দিবসের সিয়াম তোমাদের ওপর ওয়াজিব করেননি। তবে আমি এই দিনে সাওম পালনকারী কারো ইচ্ছা হলে সাওম পালন করবে আর কারো ইচ্ছা হলে তা বর্জন করবে’ (বুখারি, প্রাগুক্ত, সাওম অধ্যায়)।
আশুরার দিবস কোনটি : আশুরা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে কিছু মতানৈক্য রয়েছে। হাদিস শাস্ত্রের প্রসিদ্ধ ভাষ্যকার আল্লামা আইনি বলেন, সাহাবায়ে কেরাম, তাবিয়িন ও পরবর্তীকালের জমহুর ওলামার মতে, আশুরা হলো মহররম মাসের দশম দিবসে। তবে আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রা:-এর মতে, তা হলো, নবম দিবসে। কোনো কোনো সাহাবির মতে, তা হলো, মহররমের একাদশ দিবসে। আবু ইসহাক উপরিউক্ত তিন দিনই সাওম পালন করতেন। আর বলতেন, আশুরা ছুটে যাওয়ার আশঙ্কায় এ তিন দিন সাওম পালন করি। (পাদটীকা সহিহ বুখারি, ১ম খণ্ড, ২৬৮)।
বর্ণিত আছে আশুরায় মদিনার ইহুদিদের সাওম পালন করা দেখে রাসূলুল্লাহ সা: এর কারণ জানতে চেয়েছিলেন। তারা বলেছিল, এটি একটি পুণ্যময় দিবস। বনু ইসরাইলকে আল্লাহ তায়ালা এই দিন শত্রুদের কবল থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন বলে মুসা আ: এই দিন সাওম পালন করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ সা: শুনে বললেন, ‘তোমাদের থেকে আমি মুসার অনুসরণের উপযুক্ত বেশি’ (বুখারি, প্রাগুক্ত)।
তবে হুবহু ইহুদিদের অনুকরণ রাসূলুল্লাহ সা: পছন্দ করতেন না। তাই তিনি মুসলমানদের বলেছিলেন, ‘তোমরা আশুরা দিবসে সাওম পালন করো। সেই সাথে এর আগে এক দিন অথবা পরে এক দিন সাওম পালন করো। সাওম পালনে তোমরা ইহুদিদের সাথে সামঞ্জস্য বিধান করো না’ (তাহাবি, শারহু মাআনিল আছার, ১ম খণ্ড, ২৮৬)। এ কারণে আল্লামা ইবনুল আবিদিন শামি ও ইবনুল হুমামের মতে, শুধু আশুরা দিবসে সাওম পালন মাকরুহে তানজিহি (ইদাহুল মিশকাত, ২য় খণ্ড, ৬৭৭)।
হোসাইন রা:-এর শাহাদত : আশুরার মহিমা বহু আগ থেকে চলে আসছে। কিন্তু ইসলামি ইতিহাসের একটি অত্যন্ত মর্মান্তিক ঘটনা শাহাদতে হোসাইন রা: এ মহান দিনেই সংঘটিত হয়েছিল। ঘটনাটি ছিল মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি মহা বিষাদময়। আশুরার মহিমাকে এ হৃদয়বিদারক ঘটনা কালিমাযুক্ত করে দিয়েছে। বাতিলের বিরুদ্ধে আপসকামী না হওয়ায় ইরাকের কারবালা প্রান্তরে হজরত ইমাম হোসাইনকে শির দিতে হয়েছিল। আজ অনেকের কাছে আশুরা বলতে কারবালার এ নির্মম ঘটনাকেই বোঝায়। আল্লাহর লীলাও বোঝা বড় কঠিন। যে দিন বিশ্বের মহা প্রতাপশালী জালিম ফেরাউনের হাত থেকে আল্লাহ তায়ালা সত্য ও ন্যায়ের প্রতীক মুসা আ:কে নিষ্কৃতি দিলেন, সেই দিনই ঘটল ইসলামের ইতিহাসের এই ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ড। ফেরাউন ও মুসা আ:-এর দ্বন্দ্ব ছিল আল্লাহর রুবুবিয়্যাত নিয়েÑ আল্লাহকে স্বীকার করা ও অস্বীকার করা নিয়ে। আর হোসাইন রা:-এর লড়াই ছিল মুসলিম নামধারী জালিমশাহির বিরুদ্ধে।
তবে আশুরা দিবসে ইয়াজিদকে গালাগাল করার মধ্যে কোনো সওয়াব নেই। বরং হোসাইনি চেতনা ধারণ করার মধ্যে রয়েছে ঈমানি শক্তির উপাদান। এ উপলক্ষে বিশিষ্ট সাহাবি মুআবিয়া রা:কেও কিছু লোক সমালোচনার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে থাকে। কারণ তিনি ছিলেন ইয়াজিদের পিতা। সাহাবিদের গালমন্দ করা থেকে বিরত থাকতে রাসূলুল্লাহ সা: স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন। তাজিয়া মিছিল সর্বজনগ্রহণযোগ্য সংস্কৃতি নয়।
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের আকিদা, কারবালা ও এ ধরনের ঘটনার ব্যাপারে মধ্যপন্থী। অনেককে দেখা যায়, আশুরা দিবসে সাওমের পরিবর্তে খিচুড়ি খাওয়ার অনুষ্ঠান করে তা বিলিয়ে দেন। এটিও সুন্নাহর বিপরীত ।
লেখক : সিনিয়র মুহাদ্দিস, গবেষক ও ইসলামী বিশ্বকোষের অন্যতম প্রণেতা, ই.ফা.বা

No comments

Powered by Blogger.