সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য by ড. একেএম শাহনাওয়াজ

আটচল্লিশ
বাংলার লোকধর্ম একটি নির্দিষ্ট কাঠামো পেল আর্যদের আগমনের পর। আর্যরা ধর্মগ্রন্থ বেদ নিয়ে প্রবেশ করেছিল। বেদ নির্দেশিত তাদের ধর্ম বৈদিক ধর্ম নামে প্রতিষ্ঠা পায়। বৈদিক ধর্ম বাংলায় প্রবেশ করেছিল অনেকটা বিলম্বে। কারণ আর্যরা ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ভারতে প্রবেশ করে। পাঞ্জাব ও আশপাশের অঞ্চলে তাদের প্রভাব বিস্তৃত হয়। বাংলার স্থানীয় অধিবাসীদের প্রতিরোধে প্রায় দেড় শতক বাংলায় প্রবেশ করতে পারেনি তারা। বাংলার উত্তরাঞ্চল ভারতীয় মৌর্য রাজাদের অধিকারে আসার সূত্রে তারা বাংলায় প্রবেশ করে। বাংলায় আর্য অবস্থান প্রতিষ্ঠিত হলেও শুরুতে আর্য ধর্ম প্রবলভাবে জেঁকে বসতে পারেনি। বৈদিক ধর্মের নামাবরণে আদি ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ভারতে প্রতিষ্ঠা পেতে থাকে আর্য আগমনের প্রাথমিক পর্যায় থেকেই। তিন শতকে পূর্ব-ভারতে গুপ্ত সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বাংলায় ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ক্রমে তার অবস্থান শক্ত করে নেয়। তবে ইতিমধ্যে তার ধরন-ধারণে কিছু রূপান্তর এসেছিল। বৈদিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মের চেয়ে বাংলায় প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মণ্য ধর্মে পৌরাণিক ধর্মের আচরণই ছিল স্পষ্ট। কিন্তু পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে বাংলা সুস্পষ্ট ও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মচিন্তার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে। এ পথ ধরেই বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আজীবিক, জৈন ও বৌদ্ধধর্ম।
খ্রিস্টপূর্ব ছয় থেকে চার শতকের মধ্যে ভারতীয় উপমহাদেশে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সংস্কারবাদী চেতনা লক্ষ্য করা যায়। ভারতীয় ধর্মের ইতিহাসে এই কালপর্বের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এ সময় ব্রাহ্মণ্য ধর্ম সংস্কারের জরুরি প্রয়োজন দেখা দেয়। ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের একাধিপত্য আর কেউ মানতে চাচ্ছিল না। ক্ষমতাধর বৈদিক ব্রাহ্মণরা যাগযজ্ঞের নামে নানাভাবে করারোপ করে সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন করে তুলেছিল। এ প্রেক্ষাপটে বৈদিক ধর্মের দার্শনিক গ্রন্থ ‘উপনিষদ’ মানুষের সামনে প্রকাশিত হয়। উপনিষদের মুক্তচিন্তা নিপীড়িত জনগণকে আলোড়িত করে। ফলে যাগযজ্ঞ আর পশুবলিতে মানুষের আগ্রহ কমে যায়। ধর্মীয় চিন্তায় সাধারণ মানুষের মর্যাদা বাড়তে থাকে। এর ভেতর থেকে ভক্তিবাদী আন্দোলন জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই ভক্তিবাদী সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে স্বাতন্ত্র্য থাকলেও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি।
এ প্রেক্ষাপটের ভেতর থেকেই পূর্ব-ভারতে ধর্মক্ষেত্রে একটি ভিন্ন আলোড়ন সৃষ্টি হয়। যা সরাসরি প্রভাব ফেলে বাংলার ধর্মচিন্তায়। নতুন চিন্তার অনুসারীরা বৈদিক ধর্মের অনেক কিছুই অস্বীকার করে। বেদের দর্শন সব ক্ষেত্রেই তারা গ্রহণ করেনি। তারা সমাজে পুরোহিতদের কর্তৃত্ব অস্বীকার করে। ধর্মীয় যজ্ঞ হিসেবে পশুবলি, রক্তপাত ইত্যাদি ঘৃণার চোখে দেখতে থাকে। ঈশ্বর সম্পর্কেও তারা হয়ে পড়ে নীরব। এই নতুন ধর্ম-দর্শনের অনুসারীদের প্রধান নীতি ছিল সৎকর্মের মধ্য দিয়ে অহিংস নীতি প্রতিষ্ঠা করা। এভাবে ধর্মক্ষেত্রে যে নতুন আলোড়ন সৃষ্টি হয়, তার অনুপ্রেরণা ছিল উপনিষদ। উপনিষদ জীবনের মৌল সমস্যা সম্পর্কে মানুষকে কৌতূহলী করে তুলেছিল। তাই অনেক রক্ষণশীল বৈদিক ধ্যান-ধারণা তারা মেনে নিতে পারেননি। বৈদিক ধর্ম মূলত জটিল আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকলাপ ও যাগযজ্ঞের বিধানে পূর্ণ ছিল। এসব অনুষ্ঠান ক্রমে মানুষের কাছে অযৌক্তিক মনে হতে থাকে। এই আধ্যাত্মিক আলোড়নের ভেতর থেকেই আজীবিক, জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের উদ্ভব ঘটেছিল।

No comments

Powered by Blogger.