চট্টগ্রামে সব টেন্ডার ছাত্রলীগ-যুবলীগের by নাসির উদ্দিন রকি ও আহমেদ মুসা

চট্টগ্রামের একাধিক সরকারি প্রতিষ্ঠানের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করছে ছাত্রলীগ-যুবলীগ নামধারী ক্যাডাররা। এসব ক্যাডারের ভয়ে তটস্থ থাকেন সংশ্লিষ্ট দফতরের কর্মকর্তারা। এতে প্রকৃত ঠিকাদাররা থাকেন অসহায়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রামে টেন্ডার সন্ত্রাসে নেতৃত্ব দিচ্ছেন চট্টগ্রাম কমার্স কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি দিদারুল আলম দিদার, মহানগর যুবলীগ নেতা ও শীর্ষ সন্ত্রাসী মশিউর রহমান দিদার, হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর, আবদুল কাদের ওরফে মাছ কাদের, মহানগর ছাত্রলীগ নেতা নুরুল আলম মিয়া, সাইফুল আলম লিমন এবং ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা মহিউদ্দিন সোহেল। তারা রেলওয়ে, পিডিবি, পানি উন্নয়ন বোর্ড, সিটি কর্পোরেশন ও কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিসহ বিভিন্ন দফতরে স্থানীয় গ্র“পগুলোকে টেন্ডার সন্ত্রাসে সহায়তা করে থাকে। এদের অধিকাংশের বিরুদ্ধে নগরীর বিভিন্ন থানায় রয়েছে একাধিক মামলা। আবদুল কাদের ওরফে মাছ কাদের সম্প্রতি একটি মামলায় কারাগারে রয়েছেন।
সিটি কর্পোরেশন: চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের পুরো টেন্ডার প্রক্রিয়াটি জিম্মি করে রেখেছে ক্ষমতাসীন দলের একটি সিন্ডিকেট। ওই সিন্ডিকেটকে সহায়তা করছে কর্পোরেশনের তিন ক্ষমতাধর কাউন্সিলর। কর্পোরেশনে তালিকাভুক্ত ২৩শ’ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তবে চসিকে টেন্ডারবিহীন যেসব কাজ হয় তা নির্দিষ্ট কিছু ঠিকাদারকে ভাগবাটোয়ারা করে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। ঠিকাদারকে চসিক ঠিকাদার সমিতির সভাপতি ও উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মঞ্জুরুল আলম মঞ্জু জানান, চসিকে টেন্ডার প্রক্রিয়া নিয়ে এখনও অনেক সমস্যা রয়েছে। তবে অন্যান্য স্থানে যে রকম টেন্ডার সন্ত্রাস চলছে এখানে তুলনামূলকভাবে সমস্যা কম হচ্ছে। প্রধান নর্বাহী কর্মকর্তা আলী আহমেদ জানান, টেন্ডার সন্ত্রাস চসিকে অনেক কম। বন গবেষণা ইন্সটিটিউট: সম্প্র্রতি ৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের টেন্ডার নিয়ে তুলকালামকাণ্ড ঘটিয়েছে ছাত্রলীগ নামধারী ক্যাডাররা। তাদের বাধায় টেন্ডারে কেউ অংশ নিতে পারেনি। জলবায়ু পরিবর্তন তহবিলের আওতায় সিমেন্ট বন্ডেড পার্টিকেল বোর্ড কারখানা নির্মাণ সংক্রান্ত প্রকল্পটির টেন্ডার জমা দিতে না পারায় পুরো প্রকল্পটি এখন বন গবেষণা ইন্সটিটিউটের হাতছাড়া। নিচু অঞ্চলে লোকজনের বাড়িঘর বন্যার হাত থেকে রক্ষায় সিমেন্ট বন্ডেড পার্টিকেল বোর্ড কারখানা নির্মাণ সংক্রান্ত এ প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। এ প্রকল্পের মোট ব্যয় ৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। নগরীর কালুরঘাটে বনশিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশনের জায়গায় এ কারখানা স্থাপনের কথা ছিল। তবে ছাত্রলীগ ক্যাডারদের ভয়ে ওই প্রকল্পে কেউ টেন্ডার জমা দিতে পারেনি। পরবর্তী সময়ে প্রকল্পটি বাতিল হয়ে যায়। চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের সাবেক ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে এখানে টেন্ডার সন্ত্রাস চলছে বলে স্থানীয় লোকজন অভিযোগ করেছে। তবে তিনি বন গবেষণা ইন্সটিটিউটে ঠিকাদারি করেন না বলে দাবি করেন। কর্মকর্তারা জানান, বন গবেষণা ইন্সটিটিউটের ছোটখাটো সব কাজ নিয়ন্ত্রণ করে ছাত্রলীগ নামধারী ক্যাডাররা। বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম জানান, বন গবেষণা ইন্সটিটিউটে কাজ তেমন একটা হয় না। যেগুলো হয় তা কম টাকায় ছোট প্রকল্প। জলবায়ু ফান্ডের আওতায় প্রায় ৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প ঝামেলার কারণে হয়নি। পরে কাজটি বাতিল হয়ে যায়।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল: রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল চট্টগ্রাম কার্যালয়ের বেশিরভাগ টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করছে ছাত্রলীগ-যুবলীগ নামধারী চারটি গ্র“প। এসব গ্রুপে নেতৃত্ব দিচ্ছেন মহানগর যুবলীগের সদস্য হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর, ছাত্রলীগের সাইফুল আলম লিমন, অজয় ও অসীম। তারা পূর্বাঞ্চল রেল কার্যালয়ে ফোর স্টার হিসেবে পরিচিত। তাদের সঙ্গে আঁতাত না করে কেউ টেন্ডারে কাজ পেয়েছে এমন নজির গত ৬ বছরে সিআরবিতে ঘটেনি। প্রতি কাজের ২০ থেকে ৩০ শতাংশ টাকাই তাদের দিয়ে দিতে হয়। আর তা না হলে কাজ পাওয়া তো দূরে থাক টেন্ডারের শিডিউলও জমা দিতে পারেন না সাধারণ ঠিকাদাররা। এসব ক্যাডার বাহিনীর সঙ্গে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের এক শ্রেণীর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা জড়িত থাকারও অভিযোগ দীর্ঘদিনের। কোনো ঠিকাদার টেন্ডার ফরম সংগ্রহ করলে কিংবা জমা দেয়ার চেষ্টা করলে তা মোবাইল ফোনে সন্ত্রাসীদের অবহিত করে দেন রেলের কতিপয় কর্মকর্তা। আগামী ৮ নভেম্বর প্রধান প্রকৌশলীর দফতর এবং ১২ নভেম্বর সিসিএম দফতর থেকে আরও কয়েকটি উন্নয়ন কাজের টেন্ডার জমা দানের শেষদিন রয়েছে। ওইসব টেন্ডার নিয়ে ভাগিয়ে নিতে সন্ত্রাসীরা সংশ্লিষ্ট দফতরের সামনে মহড়া দেয়া শুরু করেছে। পূর্বাঞ্চল রেলে তালিকাভুক্ত প্রায় এক হাজারের বেশি ঠিকাদার রয়েছে। কমার্স কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি দিদারুল আলম দিদার জানান, আমি কোনো প্রকার টেন্ডার সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত নই। রেলে ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করেন হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর। প্রতিটি কাজে তাকে ১০ শতাংশ করে টাকা দিতে হয় বলে শুনেছি। এ প্রসঙ্গে হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর জানান, রেলে টেন্ডারের সঙ্গে আমি কখনও জাড়িত ছিলাম না, এখনও নই। এগুলো মানুষের অপপ্রচার ছাড়া আর কিছুই নয়। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী আবদুল হাই জানান, চট্টগ্রামে কাজ করাটা খুব কষ্টকর। আমি নতুন এসেছি। তারপরও এখানকার টেন্ডার নিয়ে পুরনো ইতিহাস অন কর্মকর্তাদের কাছে শুনেছি।
চট্টগ্রাম পলিটেকনিক: চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে টেন্ডার সন্ত্রাস এখন মহামারি আকার ধারণ করেছে। প্রতিষ্ঠানটির উন্নয়ন কাজের যে কোনো টেন্ডারকে ঘিরে বিবধমান গ্রুপগুলোর মধ্যে প্রায় সময় ঘটছে সহিংস ঘটনা। টেন্ডার সন্ত্রাসের মূল হোতা ছাত্রলীগ নেতা শামীম। বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। শামীম কারাগারে থাকলেও তার অনুসারী আবদুল্লাহ, মাসুদ ও শরীফসহ আরও কয়েকজনের নেতৃত্বে টেন্ডার সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি চলছে। এছাড়া পলিটেকনিক ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন নামে অপর এক সাবেক ছাত্রলীগ নেতার নেতৃত্বে একটি সিন্ডিকেট টেন্ডার সন্ত্রাসে সক্রিয়ভাবে নেতৃত্ব দিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। মহিউদ্দিন দাবি করেন, আমি ঠিকাদারি করলেও পলিটেকনিকে টেন্ডার নিয়ে কখনও মারামারি করিনি। পলিটেকনিক ক্যাম্পাসে আজ পর্যন্ত টেন্ডার নিয়ে কোনো মারামারি হয়নি। যা হয়েছে তা আধিপত্য বিস্তার নিয়ে।
কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন: কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিেিটডে ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। ওই সিন্ডিকেটের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের লোকজনের পাশাপাশি রয়েছে বিরোধী রাজনৈতিক দলের ক’জন নেতাও। এ প্রতিষ্ঠানে ২শ’ তালিকাভুক্ত ঠিকাদার রয়েছেন। এর মধ্যে উন্নয়ন কাজ পায় হাতেগোনা মাত্র কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। সাধারণ ঠিকাদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় টেন্ডার সিন্ডিকেটের মধ্যে জড়িত রয়েছেন মুজিব, খোরশেদ, ফারুক, জসিম উদ্দিন, মাকসুদুর রহমান ও সেলিম উদ্দিন। কাজ তারা করুক কিংবা বাইরের অন্য কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান করুক তাদের দিতে হয় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ করে কমিশন। এ প্রসঙ্গে মাকসুদুর রহমান জানান, আমি দীর্ঘদিন ধরে সিবিএর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছি। কোনো সময়ে টেন্ডারবাজিতে জড়িত ছিলাম না, এখনও নই।
অভিযুক্তদের বক্তব্য: মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক নুরুল আলম মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি টেন্ডারের বিষয়ে কোনো কথা বলতে অপরাগতা প্রকাশ করেন। আবদুল কাদের ওরফে মাছ কাদেরের মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন করে বন্ধ পাওয়ায় তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি ইমরান আহমেদ ইমু জানান, টেন্ডার, চাঁদাবাজিতে ছাত্রলীগ জড়িত নয়। ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করে অন্য কেউ এসব করছে। ছাত্রলীগের কোনো নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে থাকার প্রমাণ মিলে তাহলে নিয়ম অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

No comments

Powered by Blogger.