চূড়ান্ত রায়েও মৃত্যুদণ্ড কামারুজ্জামানের

জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রেখেছে আপিল বিভাগ। আপিল বিভাগের বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। বেঞ্চের অপর তিন সদস্য হলেন বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্‌হাব মিঞা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী। ট্রাইব্যুনালে দাখিলকৃত তৃতীয় অভিযোগে (সোহাগপুর বিধবাপল্লীতে গণহত্যা) মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল কামারুজ্জামানকে। আপিল বিভাগে চার বিচারপতির বেঞ্চ মৃত্যুদণ্ডের এ রায় বহাল রেখেছেন। এ অভিযোগে তাকে দোষী সাব্যস্ত ও সাজা দেয়ার ক্ষেত্রে আপিল বিভাগ একমত হলেও সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদ- দেয়া হয় বিচারপতিদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে। গতকাল এই রায়ের মধ্য দিয়ে জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হল অপেক্ষাধীন রাখার এক মাস ১৬ দিন পর। এটি আপিল বিভাগে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তৃতীয় রায়। এর আগে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা ও দলটির নায়েবে আমীর মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর করা আপিলের নিষ্পত্তি হয়েছে। কামারুজ্জামানের রায়ে সন্তোষ ও স্বস্তি প্রকাশ করে এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, কামারুজ্জামানের রিভিউ করার সুযোগ নেই। সরকার ও কারা কতৃপক্ষ চাইলে একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যে কোন সময় রায় কার্যকর করতে পারে। অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী ও কামারুজ্জামানের পরিবারের সদস্যরা বলছেন তারা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তারা এ রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ পিটিশন দাখিল করবেন। এদিকে আইনমন্ত্রী এডভোকেট আনিসুল হক জানিয়েছেন, আগামী তিন থেকে চার সপ্তাহের মধ্যেই কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় কার্যকর করতে হবে। ৭ দিনের মধ্যে তিনি প্রেসিডেন্টের কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করতে পারবেন। তা না করলে দ্রুতই মৃত্যুদ- কার্যকর করা যাবে। কামারুজ্জামানের ফাঁসির আদেশ বহাল থাকায় শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের বিভক্ত অংশ সন্তোষ প্রকাশ করে কর্মসূচি পালন করেছে। সন্তোষ প্রকাশ করেছে বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন। তারা দ্রুত ফাঁসির রায় কার্যকর করার দাবি জানিয়েছেন। রায়ের প্রতিবাদে জামায়াত আগামী বুধ ও বৃহস্পতিবার হরতাল আহবান করেছে।
সোমবার সকালে কামারুজ্জামানের চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করা হচ্ছে- এ তথ্য পাওয়ার পর থেকেই সুপ্রিম কোর্টের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। র‌্যাব, পুলিশ, আর্মড পুলিশ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা সুপ্রিম কোর্ট ও তার আশপাশ এলাকা ঘিরে রাখে। বন্ধ করে দেয়া হয় হাইকোর্ট থেকে দোয়েল চত্বর যাওয়ার রাস্তা। অন্যান্য রাস্তায়ও যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয়। সোমবার সকাল ৯টার আগেই আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট আদালতে ভিড় বাড়তে থাকে। গণমাধ্যম কর্মী, মুক্তিযোদ্ধা সাংস্কৃতিক কর্মী, রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, পর্যবেক্ষকসহ অনেকে ভিড় করতে থাকেন আদালতে।
সকাল নয়টায় জ্যেষ্ঠ বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে আরও তিন বিচারপতি তাদের নিজ নিজ আসন গ্রহণ করেন। আদালতে তখন পিনপতন নীরবতা। বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা মাত্র কয়েক মিনিটে পঠিত সংক্ষিপ্ত রায়ে কামারুজ্জামানের আপিল নিষ্পত্তির সমাপ্তি টানেন। গত বছরের ৯ই মে ট্রাইব্যুনালের আদেশে ৩রা নম্বর অভিযোগে শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ি থানার সোহাগপুরে গণহত্যার যে অভিযোগে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়েছিল আপিলে তা বিচারকদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে বহাল রাখা হয়। আবার চতুর্থ অভিযোগে গোলাম মোস্তফা নামে একজনকে হত্যার দায়ে ট্রাইব্যুনাল কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদ- দিলেও আপিল বিভাগে মৃত্যুদ-ের সাজা কমিয়ে তাকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়া হয়েছে। ফাঁসির আদেশ হওয়া অভিযোগে বলা হয়েছে- একাত্তরের ২৫শে জুলাই ভোরে কামারুজ্জামানের পরিকল্পনা ও পরামর্শে রাজাকার, আলবদরসহ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ি উপজেলার সোহাগপুর গ্রাম ঘিরে ফেলে। এরপর তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ১২০ জন পুরুষকে ধরে এনে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে। এ সময় অসংখ্য নারী ধর্ষণের শিকার হন। আপিলের রায়ে যাবজ্জীবন কারাদ- পাওয়া ৪ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে-১৯৭১ সালের ২৩শে আগস্ট মাগরিবের নামাজের সময় গোলাম মোস্তফা তালুকদারকে ধরে নিয়ে যায় আলবদর বাহিনীর সদস্যরা। কামারুজ্জামানের নির্দেশে তাকে সুরেন্দ্র মোহন সাহার বাড়িতে বসানো আলবদর ক্যাম্পে রাখা হয়। মোস্তফার চাচা তোফায়েল ইসলাম এরপর কামারুজ্জামানের সঙ্গে দেখা করে তার ভাতিজাকে ছেড়ে দেয়ার অনুরোধ করেন। কিন্তু ওই রাতে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা গোলাম মোস্তফা ও আবুল কাশেম নামের আরেক ব্যক্তিকে মৃগি নদীর ওপর শেরি ব্রিজে নিয়ে গিয়ে গুলি করে। গুলিতে গোলাম মোস্তফা নিহত হলেও হাতের আঙুলে গুলি লাগায় নদীতে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণে বেঁচে যান আবুল কাশেম। ট্রাইব্যুনালে দাখিলকৃত প্রথম অভিযোগে বদিউজ্জামানকে হত্যার দায়ে কামারুজ্জামানকে যাবজ্জীবন কারাদ- দিয়েছিলে ট্রাইব্যুনাল। আপিলের রায়ে তাকে এ অভিযোগ থেকে খালাস দেয়া হয়েছে। প্রথম অভিযোগে বলা হয়, কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে একাত্তর সালের ২৯শে জুন শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী থানার কালীনগর গ্রামে ফজলুল হকের ছেলে বদিউজ্জামানকে রামনগর গ্রামের আহম্মদ মেম্বারের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায় আলবদর বাহিনীর সদস্যরা। এরপর তাকে নির্যাতন করে আহম্মদনগরের রাস্তার ওপরে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে লাশ টেনে নিয়ে কাছাকাছি কাঠের পুলের নিচে পানিতে ফেলে দেয়া হয়।
এছাড়া ৭ নম্বর অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল থেকে যাবজ্জীবন কারাদ- পাওয়া কামারুজ্জামানের এ সাজা আপিল বিভাগে বহাল রেখেছেন চার বিচারপতি। এ অভিযোগে বলা হয়েছে ১৯৭১ সালের ২৭ রোজার দিন দুপুরে শেরপুরের টেপা মিয়ার বাড়ি ঘেরাও করে আলবদর বাহিনী। এরপর কামারুজ্জামানের নির্দেশে টেপা মিয়ার ছেলেসহ ৫ জনকে হত্যা করা হয়। ট্রাইব্যুনালে দাখিলকৃত দুই নম্বর অভিযোগে ১০ বছরের সাজা হয়েছিল কামারুজ্জামানের। আপিল বিভাগের এ রায়ও বহাল রাখা হয়েছে। ২ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের মে মাসের মাঝামাঝি এক দুপুরে শেরপুর কলেজের তৎকালীন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রভাষক সৈয়দ আবদুল হান্নানকে নির্যাতনের ঘটনায় ১০ বছরের কারাদ- দেয়া হয়। এদিকে ৫ ও ৬ নম্বর অভিযোগ থেকে ট্রাইব্যুনালের রায়ে খালাস পাওয়া কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে কোন আপিল করেনি রাষ্ট্রপক্ষ। এ কারণে আপিলের রায়ে ৫ ও ৬ নম্বর অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেয়া হয়েছে। পঞ্চম অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরে রমজান মাসের মাঝামাঝি সময়ে এক সন্ধ্যায় শেরপুরের চকবাজারের বাসা থেকে মো. লিয়াকত আলীসহ ১১ জনকে আটক করে ঝিনাইগাতী আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে যায় আলবদর বাহিনীর সদস্যরা। এরপর তিনজন ছাড়া বাকি সবাইকে গুলি করে হত্যা করা হয়। গুলি করার সময় আসামি কামারুজ্জামান ও তার সহযোগী কামরান সেখানে উপস্থিত ছিলেন বলে অভিযোগ করেছে প্রসিকিউশন। খালাশ পাওয়া ষষ্ঠ অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরে নভেম্বর মাসে দিদারসহ কয়েকজনকে ময়মনসিংহ শহরের জেলা পরিষদ ডাকবাংলোয় ধরে নিয়ে যায় আলবদর বাহিনী। পাকিস্তানের পক্ষে বক্তব্য দিতে বাধ্য করতে সেখানে নির্যাতন চলে তাদের ওপর।
এর আগে, গত বছরের ৯ই মে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে মৃত্যুদ-ের রায় ঘোষণা করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। গত বছরের ৬ই জুন ফাঁসির আদেশ থেকে খালাস চেয়ে আপিল করেন কামারুজ্জামান। সুপ্রিমকোর্টে আপিল দাখিলের পর এ বছরের ৫ই জুন শুনানি শুরু হয়ে ১৭ই সেপ্টেম্বর তা শেষ হয়। পরে এই আপিলের রায় যে কোন দিন ঘোষণা করা হবে মর্মে তা অপেক্ষমাণ রাখেন বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে গঠিত ৪ সদস্যের এ বেঞ্চ।
প্রসঙ্গত, ২০১০ সালের ১৩ই জুলাই কামারুজ্জামানকে হাইকোর্ট এলাকা থেকে একটি মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। একই বছর ২রা আগস্ট তাকে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ২০১২ সালের ৪ঠা জুন তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ৭টি অভিযোগ গঠন করে। সাক্ষ্য গ্রহণ ও যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে ২০১৩ সালের ৯ই মে কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করে ট্রাইব্যুনাল-২।
রায়ের কপি পেয়েছে জেলা প্রশাসন
আপীল বিভাগে মৃত্যুদ-াদেশপ্রাপ্ত মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের রায় ঘোষণার এক ঘণ্টার মধ্যে পূর্ণাঙ্গ ‘রায়ের কপি’ হাতে পেয়েছে ঢাকা জেলা প্রশাসন। ডিসি অফিসের এক কর্মকর্তা জানান, বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বিশেষ বাহক মারফত রায়ের কপি পাঠানো হয়। কারাবিধি অনুসারে পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি তাদের কাছে পাঠানো হয়েছে। এখন সহসাই পরবর্তী পদক্ষেপ নেবেন তারা।
‘রিভিউয়ের সুযোগ নেই’
জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগের দেয়া মৃত্যুদ-ের রায়ে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তিনি জানিয়েছেন, রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদনের সুযোগ নেই। রায়ের পর তার কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, আমরা সন্তুষ্ট হয়েছি। এই রায়টি আমাদের জন্য পরম স্বস্তিদায়ক। কামারুজ্জামানের মৃত্যুদ- বহাল রয়েছে এতেই আমরা স্বস্তি পেয়েছি। সোহাগপুরের বিধবাপল্লীর জনগণ, মুক্তিকামী মানুষ, যারা আইনের শাসন চান- তারা এবং ক্ষতিগ্রস্তরা এ রায়ে স্বস্তি পেয়েছে। তিনি বলেন, কখন ফাঁসি কার্যকর হবে তা সরকার ও কারা কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের বিষয়। আপিলের এই রায়ের বিরুদ্ধে কামারুজ্জামানের রিভিউ আবেদন করার সুযোগ আছে কিনা সংবাদকর্মীদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি আগেও বলেছি আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩ একটি বিশেষ আইন। সাধারণ ফৌজদারি আইন এক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কামারুজ্জামানের রিভিউ করার আর কোন সুযোগ রয়েছে বলে আমি মনে করি না। এর আগে কাদের মোল্লার পক্ষ থেকে রিভিউ করেছিল, তা খারিজ করে দিয়েছিল আদালত। এক্ষেত্রে রিভিউয়ের আর কোন সুযোগ নেই। সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদ কামারুজ্জামানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না বলেও মন্তব্য করেন মাহবুবে আলম। তিনি বলেন, আসামিপক্ষের নানা ধরনের আবেদন থাকতে পারে। এসব আবেদনের কিছু আইনি ভিত্তি থাকতেও পারে, আবার নাও পারে। এ নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। চূড়ান্ত রায়ের সংক্ষিপ্ত কপি পাওয়ার জন্যে তিনিও আবেদন করেছেন জানিয়ে মাহবুবে আলম বলেন, এ রায়ের ফাঁসি কার্যকর হবে ট্রাইব্যুনাল আইন অনুযায়ী। রায়ের প্রতিক্রিয়ায় হরতাল আহ্বান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হরতাল ডাকা আদালত অবমাননার শামিল। হরতাল হতে পারে রাজনৈতিক ইস্যুতে। আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হরতাল ডাকা চরম ধৃষ্টতা। আদালতের প্রতি তাদের শ্রদ্ধাবোধ না থাকার প্রমাণ এই হরতাল। এটি সম্পূর্ণভাবে আদালত অবমাননা। রায়ের প্রতিক্রিয়ায় প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম বলেন, আমরা সন্তুষ্ট। এই রায়ের মাধ্যমে দেশবাসী শহীদ পরিবার সবার প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। এত দিন দেশে বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি ছিল তা থেকে আমরা বেরিয়ে আসছি। রায় দ্রুত কার্যকরের আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, ট্রাইব্যুনাল আইনে রিভিউ পিটিশনের কোন সুযোগ নেই। প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ বলেন, আজ আমাদের অত্যন্ত আনন্দের দিন। এটি একটি বিশেষ রায় ছিল। শেরপুরের সোহাগপুরের বিধাবপল্লীতে যে গণহত্যা হয়েছিল আজকের রায়ের মাধ্যমে তার বিচার হলো। তিনি বলেন, আমার মনে হয় না কামারুজ্জামানের এই রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ পিটিশন দাখিলের সুযোগ রয়েছে। এদিকে বিকালে আইনমন্ত্রী এডভোকেট আনিসুল হক জানিয়েছেন, তিন থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে ফাঁসির রায় কার্যকর করতে হবে। আগামী সাত দিনের মধ্যে কামারুজ্জামান আপিল করার সুযোগ পাবেন।
রিভিউ আবেদন করা হবে
জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের আপিলের রায়ে হতাশা প্রকাশ করে তার আইনজীবী তাজুল ইসলাম বলেছেন, সর্বোচ্চ আদালতের আপিলে কামারুজ্জামান ন্যায়বিচার পাননি। আমাদের জন্য এর চেয়ে বেদনাহত ও মর্মাহতের ঘটনা আর হতে পারে না। তাজুল বলেন, আইনজীবী হিসেবে দক্ষতার যতটুকু ছিল তা দেয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, রিভিউ করার সুযোগ নেই। এটা ভ্রান্ত বক্তব্য। আবদুল কাদের মোল্লার আপিলের রায়ের পর রিভিউ করেছিলাম। এবারও রিভিউ করবো। রিভিউ আবেদন করা একজন আসামির সাংবিধানিক অধিকার। কামারুজ্জামান প্রেসিডেন্টের কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাইবেন কিনা- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রেসিডেন্টের কাছে ক্ষমা চাইবেন কিনা সেটা কামারুজ্জামানের ব্যক্তিগত বিষয়। কামারুজ্জামানের অপর আইনজীবী এসএম শাহজাহান বলেন, আমরা হতাশ। এই রায়ের বিষয়ে কোন প্রতিক্রিয়া হয় না। তারপরও এই রায়ের বিরুদ্ধে আমরা রিভিউ পিটিশন দাখিল করবো।
রায় ঘোষণার পর কামারুজ্জামানের ছেলে হাসান ইকবাল ওয়ামী তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, বাবা ন্যায়বিচার পাননি। রায়ের সার্টিফাইড কপি পাওয়ার পর রিভিউ পিটিশন দাখিল করা হবে। তিনি বলেন, শেরপুরের সোহাগপুরের নিরপরাধ মানুষকে হত্যার যে অভিযোগে বাবাকে মৃত্যুদ-  দেয়া হয়েছে সেই ঘটনার বর্ণনায় ইতিহাসে কোথাও আমার বাবাকে দায়ী করা হয়নি। আপনার পিতা প্রেসিডেন্টর কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাইবেন কিনা- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে হাসান ইকবাল ওয়ামী বলেন, সে প্রসঙ্গে এখনই কিছু বলতে পারবো না। আমরা আগে রিভিউ পিটিশন করবো। তারপর দেখা যাবে।
কনডেম সেলে বিমর্ষ কামারুজ্জামান
স্টাফ রিপোর্টার, গাজীপুর থেকে জানান, মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামান আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায়ের পর খুবই বিমর্ষ হয়ে পড়েছেন। গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারের পার্ট ২-এর কনডেম সেলে রয়েছেন তিনি। কারাগারে টেলিভিশনের মাধ্যমেই তিনি তার চূড়ান্ত রায় ঘোষণার খবর শুনেছেন। রায়কে ঘিরে কারাগারের আশপাশেও নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। কারা সূত্র জানায়, কাশিমপুর কারাগারের ফাঁসির কনডেম সেলে কয়েদির পোশাকেই বন্দি রয়েছেন জামায়াত নেতা কামারুজ্জামান। অন্যান্য দিনের মতো সোমবার ভোরে ঘুম থেকে উঠে তিনি ফজরের নামাজ আদায় করেন। সকালে নাস্তা খাওয়ার পর অনেকটা স্বাভাবিক ছিলেন তিনি। অন্য বন্দিদের সঙ্গে কথাবার্তাও বলছিলেন। এ সময় তিনি তেমন একটা চিন্তিত ছিলেন না। কিন্তু রায় শোনার পর একেবারে চুপসে যান। সময় কাটাচ্ছেন বিমর্ষ অবস্থায়।
কামারুজ্জামানের রায় নিয়ে মন্ত্রিসভায় স্বস্তি
মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত কামারুজ্জামানের রায়ে স্বস্তি প্রকাশ করেছে মন্ত্রিসভা। গতকাল সচিবালয়ে মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকের শুরুতে নিজেদের স্বস্তির কথা জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, আজ (গতকাল) ইতিহাসে একটি কলঙ্কময় দিন। জেলহত্যা দিবসে জাতির সেরা সন্তানদের স্মরণ করছি। এদিনে একটি খুশির খবরও রয়েছে। সর্বোচ্চ আদালত মৃত্যুদ-প্রাপ্ত কামারুজ্জামানের ফাঁসির আদেশ বহাল রেখেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সোহাগপুর গ্রামের সেই সব বিধবারা নিশ্চয়ই আজ আনন্দে কাঁদবেন। আমাদের জন্য দোয়া করবেন। এক মন্ত্রী জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুদ্ধাপরাধের রায় নিয়ে বলেন, কোন বাধার কাছেই মাথা নোয়াব না। যত কষ্ট হোক রায় কার্যকরের পদক্ষেপ নেয়া হবে। এনিয়ে কয়েক জন মন্ত্রী কথা বলতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী সম্মতি না দেয়ায় আলোচনা বেশিদূর এগোয়নি বলে জানা গেছে।
রায় দ্রুত কার্যকরের দাবি গণজাগরণ মঞ্চের
কালক্ষেপণ না করে মানবতা বিরোধী অপরাধে ফাঁসির দ-প্রাপ্ত জামায়াত নেতাদের রায় দ্রুত কার্যকরের দাবি জানিয়েছে গণজাগরণ মঞ্চ। গতকাল সকালে জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের আপিলের রায় প্রকাশ হওয়ার পর সন্তোষ প্রকাশ করে এমন মন্তব্য করেছেন মঞ্চের সঙ্গে জড়িতরা। এর আগে রায় পুনর্বহাল রাখার দাবিতে সকাল থেকে শাহবাগ অবস্থান নেয় মঞ্চের বিভিন্ন পক্ষ। স্লোগানে স্লোগানে মাতিয়ে রাখে পুরো এলাকা। জাতীয় জাদুঘরের মূল ফটকের বামপাশে অবস্থান নেয় মঞ্চের সরকারপন্থি বলে পরিচিত কামাল পাশা চৌধুরী পক্ষ। ডানপাশে অবস্থান নেয় মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার পক্ষ। আর মাঝে অবস্থান নেয় মঞ্চের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছাত্র সংগঠনগুলো। আপিল বিভাগ রায় পুর্নবহাল রেখেছে এমন খবর শাহবাগে পৌঁছালে খুশিতে ফেটে পড়েন মঞ্চের নেতাকর্মীরা। এরপর মুখপাত্র ডা. ইমরান পক্ষের কর্মীরা শাহবাগ থেকে একটি আনন্দ মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যারয়ের রাজুভাস্কর্য ঘুরে আবার শাহবাগে এসে শেষ করেন। এসময় ডা. ইমরান বলেন, রায়ে বাংলার প্রতিটি মানুষ খুশি হয়েছে। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হয়েছে। তবে রায় দ্রুত কার্যকর করতে হবে। এ নিয়ে কোন কালক্ষেপণ চলবে না। এদিকে জামায়াতের ডাকা হরতাল প্রতিহতের ঘোষণা দিয়েছে মঞ্চ। ডা. ইমরান বলেন, বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে শাহবাগে অবস্থান করা হবে। হরতাল বিরোধী মিছিল করা হবে। সারা দেশের গণজাগরণ মঞ্চ এই কর্মসূচি পালন করবে বলে ঘোষণা দেন তিনি।

No comments

Powered by Blogger.