খুন করেই স্ত্রীকে ফোন, রেডি হও মালয়েশিয়া যাব

‘তুমি রেডি হও। আজ রাতেই মালয়েশিয়া যেতে হবে। হাতে সময় খুবই কম। কোনোভাবে দেরি করো না। আমার ডলার ভাঙার কাজ শেষ হয়েছে। এক্ষনি চলে আসব।’ রফিকের এমন কথার জবাবে স্ত্রী সামিয়া বলেন, ‘আমার তো বসুন্ধরা শপিংমলে যাওয়ার কথা ছিল। কেনাকাটা বাকি আছে।’ রফিক বলেন, ‘কুয়ালালামপুরে তোমায় শপিং করে দেব। এখন আর বেশি কথা বলা যাবে না। মোবাইলে চার্জ নেই। আমার ফোন বন্ধ।’
১৩ অক্টোবর রাজধানীর গুলশানের হোটেল আমারিতে মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ী নজরুল ইসলামকে খুনের পর রফিকুল ইসলাম তার স্ত্রীর সঙ্গে এসব কথা বলেন। বিকালে খুনের পর রাতে রফিক ও তার স্ত্রী-সন্তান মালয়েশিয়ার উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন।
খুনের ঘটনার পর প্রযুক্তিগত তদন্ত চালিয়ে র‌্যাব-১ এর গোয়েন্দারা রফিকের ছোট ভাই রকিবুল ইসলামের খোঁজ পান। তার মোবাইল ফোনের সূত্র ধরে মালয়েশিয়ার একটি ফোনকল খতিয়ে দেখেন র‌্যাবের গোয়েন্দারা। এরপর বেরিয়ে আসে সব তথ্য।
র‌্যাব সূত্র জানায়, মালয়েশিয়া পৌঁছে রফিক তার ভাই রকিবকে ফোন করে আত্মগোপনের পরামর্শ দেন। তখন রকিব জানতে চান, ‘কী কারণে আমি আত্মগোপন করব?’ রফিক বলেন, যার কাছে টাকা পেতেন সেই নজরুলকে তিনি খুন করেছেন। বিষয়টি বহুদূর যেতে পারে তাই ছোটভাইকে আত্মগোপনে থাকতে বলেন।
রকিবের কাছে পাওয়া তথ্যে নাম আসে হেলাল উদ্দিন নামে একজনের। পরে র‌্যাব অভিযান চালিয়ে হেলাল এবং একটি ওষুধের দোকানের কর্মচারী আমিনুল ইসলাম সোহাগকে গ্রেফতার করে। সোহাগের কাছ থেকে ২০ হাজার টাকায় চেতনানাশক কিনেছিলেন রফিক। গ্রেফতার তিনজনকে শনিবার রাজধানীর উত্তরায় র‌্যাব-১ এর কার্যালয়ে গণমাধ্যমের মুখোমুখি করা হয়। র‌্যাব জানায়, শুক্রবার বিকাল থেকে শনিবার ভোর পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে রকিবকে মহাখালী এলাকা থেকে, হেলালকে ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের মুক্তাপাড়া এবং সোহাগকে ফার্মগেট থেকে গ্রেফতার করা হয়।
র‌্যাবের হেফাজতে থাকা অবস্থায় হেলাল উদ্দিন যুগান্তরের কাছে খুনের ঘটনার বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, ঘটনার সাত দিন আগে রফিকুল তাকে বলেন, ‘তোর ভাবীকে নিয়ে বড় জ্বালায় আছি। এত টাকার জোগান দেয়া খুব কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তার ওপর গুলশানের এক ব্যবসায়ী জাল ডলার দিয়ে প্রতারণা করেছে।’ এ সময় হেলাল রফিককে বলেন, ‘আপনার মতো একজন চালাক মানুষকে জাল ডলার দিতে পারল ওই ব্যবসায়ী?’ তখন রফিক বলেন, ‘হেলাল তুই আমার সঙ্গে থাকবি, ওই ব্যবসায়ীর সঙ্গে দেখা হবে, ওরে সাইজ করতে হবে।’
হেলাল জানান, তাকে জানানো হয় ফোন করলেই সে যেন চলে আসে। ঘটনার আগের রাতে রফিকুল হেলালকে ফোন করেন। পরদিন সকালবেলা গুলশান-১ নম্বরের ডিসিসি মার্কেটের একটি রেস্তোরাঁয় তারা সকালের নাস্তা করেন। এরপর সেখান থেকে ‘আবদুস সালাম’ পরিচয়ে হোটেল আমারির কক্ষ বুকিং দেন রফিকুল ইসলাম। হোটেল কক্ষ বুকিং দেয়ার পর তিনি প্রাইভেট কার চালিয়ে গুলশান-২ নম্বরে নিয়ে আসেন রফিককে। গোলচত্বরে কিছু সময় অতিবাহিত করার পর ব্যবসায়ী নজরুলকে ফোন করে রফিক বলেন, ‘ভাই টাইমমতো চলে আসেন। ডলার একটু বেশি আনার চেষ্টা করবেন। আমি গুলশানে আছি একটা কাজ করছি। হোটেল আমারির একটি রুমে লেনদেন হবে। তার হাতে অনেক টাকা, এত টাকা নিয়ে থাকা নিরাপদ নয়।’
ঘটনার দিন (সোমবার) সকাল ১০টা ১৫ মিনিটে হোটেলের কক্ষ বুক করা হয়। বেলা ১টা ২২ মিনিটে হোটেল কক্ষে একাই প্রবেশ করেন রফিকুল। এর মিনিট দশেক পরে হেলাল ওই কক্ষে যান। হোটেল কক্ষে বসে রফিক ফোনে ব্যবসায়ী নজরুলের সঙ্গে কথা বলেন।
সিসি ক্যামেরার তথ্য অনুযায়ী, নজরুল বিকাল ৩টা ৩৮ মিনিটে হোটেলের কক্ষে প্রবেশ করেন। তখন মাথায় ক্যাপ পরা অবস্থায় রফিক তাকে রিসিভ করেন। এর কিছুক্ষণ পর রফিক ও নজরুল বাইরে বের হন। ৪টা ৪০ মিনিটে রফিক ও নজরুল দ্বিতীয়বার হোটেলে প্রবেশ করেন। ৫টা ১৭ মিনিট রফিক ও হেলাল বের হয়ে যান। শেষ ৩৭ মিনিটে নজরুলকে খুন করা হয়।
হেলাল যুগান্তরকে জানান, দ্বিতীয় দফায় হোটেলে প্রবেশের পর তারা তিনজন মেঝেতে বসেন। নজরুল তাদের মাঝখানে ছিলেন। নজরুলকে একটু বসতে বলে রফিক লাগেজ থেকে স্প্রে বের করেন। নজরুল তখন বাঁচার জন্য হেলালের ডান হাতের আঙুলে কামড় দেয়। পরে নজরুলকে টেনেহিঁচড়ে মেঝেতে ফেলে হাত-পা বেঁধে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন তারা। হত্যার পর নজরুল ইসলামের সঙ্গে থাকা বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে যান।
হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করার জন্য রফিকুল ইসলাম ও হেলাল উদ্দিন মিটফোর্ড রোডের একটি দোকানের কর্মচারী সোহাগের কাছ থেকে চেতনানাশক ক্রয় করেন। হত্যাকাণ্ডের পর পালানোর জন্য হত্যাকারীরা একটা সাদা টয়োটা গাড়ি নম্বর প্লেট বদল করে ব্যবহার করেন। র‌্যাব গাড়িটি জব্দ করেছে। র‌্যাব জানায়, রফিক গাড়ির প্লেট, জাতীয় পরিচয়পত্র সবই ভুয়া ব্যবহার করেছিল।
র‌্যাব-১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল তুহিন মোহাম্মদ মাসুদ যুগান্তরকে বলেন, হেলাল ছিলেন রফিকের আগের গাড়িচালক। রফিক আগে ঢাকায় জমিজমার দালালি করতেন। তার বিরুদ্ধে রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় প্রতারণা ও নারীঘটিত ৬টি মামলা আছে। হেলাল মোহাম্মদপুরের আদাবরের সফিউর রহমানের গাড়ি ভাড়া করেন। এই ভাড়া গাড়ি নিয়ে তারা হত্যাকাণ্ড ঘটান। তবে হত্যার পর মহাখালীতে গিয়ে আরেকটি গাড়িতে ওঠেন রফিকুল। ওই গাড়িটি নিয়ে তার ভাই রকিব অপেক্ষা করছিলেন।
দ্বিতীয় গাড়ির চালক আলমাস ভাণ্ডারী যুগান্তরকে জানান, তিনি ঘটনার দিন দুই ঘণ্টা ধরে মহাখালীতে অবস্থান করেন। ঘটনার দিন তিনি মোহাম্মদপুরে রফিকুল ও রকিবুলকে নিয়ে যান। সেখান থেকে ৩০ মিনিট পরই তারা শাহজালাল বিমানবন্দরের দিকে রওনা হন। গাড়ি চালানোর সময় রফিকুল ও তার স্ত্রী-সন্তান পেছনে ছিলেন। ছোট ভাই রকিবকে কিছু টাকা দিয়ে বিমানবন্দর থেকে বিদায় দেন রফিক।

No comments

Powered by Blogger.