রাজনৈতিক শক্তির পরিবর্তন ছাড়া প্রতিক্রিয়াশীল শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন সম্ভব নয় by বদরুদ্দীন উমর

প্রত্যেক দেশের শাসক শ্রেণী ও সরকারের চরিত্র স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয় তার শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে। বাংলাদেশও এদিক দিয়ে কোনো ব্যতিক্রম নয়। শিক্ষাক্ষেত্রে নিজেদের অনেক কৃতিত্ব সম্পর্কে ঢেঁড়ি পেটালেও এবং শিক্ষামন্ত্রীর নিত্যনতুন দাবি সত্ত্বেও বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা আজ কোন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে সেটা জানার জন্য প্রাথমিক, মাধ্যমিকসহ উচ্চতর পর্যায়ের পাঠ্যক্রমের সঙ্গে পরিচয় আবশ্যক। উপরন্তু দেশের পত্রপত্রিকাগুলোতে শিক্ষা সম্পর্কিত যেসব রিপোর্ট প্রকাশিত হচ্ছে তার থেকেও এটা ভালোভাবেই বোঝা যায়। সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী তিনটি বিষয়ে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা সব থেকে শোচনীয়। এগুলো হচ্ছে বাংলা, ইংরেজি ও অংক। এর থেকে বিপজ্জনক ব্যাপার শিক্ষাক্ষেত্রে আর কিছু হতে পারে না। কারণ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে এ তিনটি বিষয়ে শিক্ষা যদি উপযুক্তভাবে না হয়, তাহলে উচ্চতর পর্যায়ে কোনো শিক্ষাই যথাযথভাবে হওয়া সম্ভব নয়।
অংক ও গণিত শিক্ষা যদি দুর্বল হয় তাহলে বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষা কখনোই ভালোভাবে হতে পারে না। এবং ভাষা জ্ঞান যদি না থাকে তাহলে কোনো শিক্ষার মানই সন্তোষজনক হওয়ার কথা নয়। বাংলাদেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার পাঠ্যক্রমের দিকে তাকালে দেখা যাবে এখানে ভাষা ও অংকের সঙ্গে অনেক বিষয় ছাত্রছাত্রীদের ওপর চাপিয়ে দেয়া আছে। এ বিষয়গুলো প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রে শুধু অনাবশ্যকই নয়, এগুলোর ভার বহন করতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবে ছাত্রদের ভাষা ও অংকের পাঠ সুষ্ঠুভাবে হতে পারে না। ভাষা ও অংকের ওপর গুরুত্ব না দিয়ে এতগুলো বিষয় ছাত্রদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে এ দুই বিষয়কে অন্য বিষয়গুলোর সমপর্যায়ে ফেলার কারণে এ দুই বিষয়ের প্রতি প্রয়োজনীয় সময় ও গুরুত্ব দেয়া ছাত্র ও শিক্ষকদের পক্ষে সম্ভব হয় না। না হওয়ারই কথা। ছাত্রদের অনাবশ্যক কতগুলো বিষয় পড়তে বাধ্য করার কারণে তাদের বইয়ের সংখ্যাও বেশি। এর ফলে মানসিকভাবে যে ভার তাদের বহন করতে হয়, তার একটা চিত্র তাদের স্কুল যাওয়ার সময়েই চোখে পড়ে। বইপত্রে ভর্তি যে ব্যাগ
তাদের এ সময় ঘাড়ে ফেলে বহন করতে হয় সেটা বাস্তবিকই এক করুণ দৃশ্য।
বাংলা ভাষা নিয়ে প্রত্যেক বছর একুশে ফেব্র“য়ারি এ দেশের বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাব্যবস্থার প্রণেতা ও তদারককারীসহ সাধারণ মধ্যবিত্তদের অনেক চোখের পানি ফেলতে দেখা যায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাংলা শিক্ষার কী বেহাল দশা বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলোতেও হয়েছে, সেটা বোঝা যায় বাংলা শিক্ষার মান বিষয়ে রিপোর্ট থেকে। ইংরেজি শিক্ষার ব্যবস্থা এই স্কুলগুলোতে থাকলেও আসলে এই শিক্ষার মান বলতে যে কিছু নেই এটা মাত্র কয়েকদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগের ভর্তি পরীক্ষার রিপোর্ট থেকে দেখা যায়। জিপিএ-৫ পাওয়া কয়েকশ ছাত্র এই পরীক্ষা দিয়েছিল। তার মধ্যে মাত্র দুজন পাস করেছে! এ পরিস্থিতিতে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হওয়ার পর যেভাবে এই ফল লাভ করা ছাত্রছাত্রীদের দুহাত তুলে উল্লাস প্রকাশ করতে দেখা যায় তাকে এক মস্ত ট্র্যাজেডি ছাড়া আর কী বলা যায়?
বাংলাদেশে কোনো একক (uniform) সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থা নেই, যেমন আছে যে কোনো আধুনিক সমাজে, অন্যান্য দেশে। সাধারণ বাংলা মাধ্যম শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে এখানে আছে ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাব্যবস্থা এবং মাদ্রাসা শিক্ষা। তিন ভাগে বিভক্ত এই শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে একটা শ্রেণীবিন্যাসও চোখে পড়ার মতো। ব্যতিক্রম থাকলেও বাংলা মাধ্যম শিক্ষা ব্যবস্থার অধীনে শিক্ষা লাভ করে সাধারণভাবে মধ্যবিত্ত পরিবারের ছাত্ররা। অপেক্ষাকৃত অবস্থাপন্ন ও ধনী পরিবারের ছাত্ররা পড়ে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে এবং দরিদ্র পরিবারের ছাত্ররা পড়ে মাদ্রাসায়। যারা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ে তাদের ইংরেজি শিক্ষার মানও যে ভালো নয়, এটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল থেকে বোঝা যায়। মাদ্রাসায় যারা পড়ে তারা যে পাঠ্যক্রম অনুযায়ী পাঠ গ্রহণ করে তাতে তাদের কোনো প্রকৃত শিক্ষার সুযোগ নেই। এ কারণে তারা চাকরি এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু করতে পারে না। তাই অবস্থাপন্ন ও ধনী পরিবারের ছেলেমেয়েদের তো মাদ্রাসায় দেয়া হয়ই না, এমনকি কোনো সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরাও মাদ্রাসায় পড়ে না। অথচ মাদ্রাসা শিক্ষা বহাল রাখার প্রতি ধনী ও মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকজনের সমর্থন বেশ উচ্চকণ্ঠে শোনা যায়! মাদ্রাসাগুলোতে গরিব পরিবারের ছাত্ররাই পড়ে এবং এভাবে অনেক বছর পাঠ নেয়ার পরও শিক্ষা শেষে তারা নিজেরা জীবনে কোনো উন্নতি করতে পারে না এবং সমাজের কোনো ক্ষেত্রেই তারা অবদান রাখতে পারে না। তাদের মধ্যে অনেকে মসজিদে ইমাম বা মুয়াজ্জিনের কাজ করে, মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করে, কিছু ব্যবসা-বাণিজ্য করে। অনেকে বেকারও থাকে। এভাবে দেশের মানব সম্পদের যে অপচয় হয় সেটা যে কোনো সমাজ ও জাতির পক্ষেই এক ভয়াবহ ব্যাপার। কিন্তু মাদ্রাসা শিক্ষার সব থেকে ভয়াবহ দিকটি বর্তমানে যেভাবে দেখা যায়, আগে সেটা দেখা যেত না। অকেজো শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামোর মধ্যে বন্দি থাকলেও তারা কোনো ক্রিমিনাল বা অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে জড়িত থাকত না। কিন্তু বিগত দু-তিন দশক ধরে মাদ্রাসার ছাত্রদের ধর্ম রক্ষার নামে ধাপ্পা দিয়ে গুণ্ডাপাণ্ডা ও সন্ত্রাসীতে পরিণত করা হচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদী, বিশেষত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত এক্ষেত্রে বিশ্বজুড়ে এই তৎপরতার জন্ম কীভাবে দিয়েছে এবং এখনও মধ্যপ্রাচ্য এবং এশিয়া-আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে দিচ্ছে, এ নিয়ে কোনো বিশদ আলোচনা এখানে সম্ভব নয়। তবে এটা এক বাস্তব ব্যাপার ও কঠিন সত্য। ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার ব্যাপকভাবে শুরু করা এবং চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তারা মাদ্রাসাগুলোকে ব্যবহার করছে। এ কারণে এ দেশেও অনেক মাদ্রাসা এখন পরিণত হয়েছে সন্ত্রাসীদের আখড়ায়। সুশিক্ষার পরিবর্তে ছাত্রদের ধর্মের নামে সন্ত্রাস করার শিক্ষাই এগুলোতে দেয়া হচ্ছে। অর্থাৎ সেই মাদ্রাসাগুলোকে এখন পরিণত করা হয়েছে চরম রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াশীলতার এক একটি কেন্দ্রে। তাদের প্রতিক্রিয়াশীল তৎপরতা যে এখানে প্রগতিশীল, বিপ্লবী ও সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির বিকাশের ক্ষেত্রে একটা বড় প্রতিবন্ধক, এ নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। মাদ্রাসা শিক্ষার এই দিকটি শাসক শ্রেণীকে মজবুত রাখার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। এটাই একটা কারণ যে জন্য শাসক শ্রেণীর লোকেরা নিজেদের ছেলেমেয়েদের মাদ্রাসায় না দিলেও এরা মাদ্রাসা শিক্ষা কায়েম রাখার প্রবল সমর্থক।
শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক শক্তির সম্পর্ক যে অবিচ্ছেদ্য, এটা আগেই বলা হয়েছে। কাজেই মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা এবং সেই সঙ্গে শিক্ষাক্ষেত্রে যে নৈরাজ্য এখন দেখা যাচ্ছে এর কোনো পরিবর্তন দেশের বর্তমান রাজনৈতিক শক্তি কাঠামোর মধ্যে সম্ভব নয়। এই শক্তি কাঠামোর ধ্বংস এবং জনস্বার্থের অনুকূলে রাজনৈতিক শক্তির উদ্ভব এবং তার দ্বারা রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনার পরিস্থিতি যতদিন না সৃষ্টি হচ্ছে, ততদিন সামগ্রিকভাবে এই শিক্ষাব্যবস্থার গণতন্ত্রীকরণ এবং সুশিক্ষার ব্যবস্থা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এটা করার জন্য জনগণকেই এগিয়ে আসতে হবে, কারণ একমাত্র জনগণের সংগঠিত শক্তির প্রয়োগ ছাড়া এই পরিবর্তন কিছুতেই হতে পারে না।
০৮.১১.২০১৪
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল

No comments

Powered by Blogger.