কামারুজ্জামানের বিচারপ্রক্রিয়া ত্রুটিপূর্ণ : হিউম্যান রাইটস ওয়াচ

জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিচারপ্রক্রিয়া ভয়াবহ রকমের ত্রুটিপূর্ণ অভিহিত করে তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ অবিলম্বে স্থগিত করার আহ্বান জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। এছাড়া মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত সব মৃত্যুদণ্ড স্থগিত করারও আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি। সংস্থাটি রোববার তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ আহ্বান জানায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ডাদেশ অবিলম্বে স্থগিত করে তাকে এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার অধিকার দেয়া উচিত।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকার কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করার প্রস্তুতি গ্রহণ করার জন্য ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয়ার খবরে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। আপিল রায়ের পর কামারুজ্জামানকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তর করায় তার ফাঁসি কার্যকর অত্যাসন্ন বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। কামারুজ্জামান এবং তার আইনজীবী এখনো চূড়ান্ত রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি পাননি। অথচ যেকোনো মৃত্যুদণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে সাধারণ নিয়ম অনুসারে ৩০ দিনের মধ্যে রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ পিটিশন দাখিল করার জন্য পূর্ণাঙ্গ কপি পাওয়া জরুরি। সরকারি কর্মকর্তারা ইঙ্গিত দিচ্ছেন, পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগেই ফাঁসি কার্যকর করা সম্ভব, যা মৃত্যুদণ্ডের ক্ষেত্রে নীতিমালা পরিপন্থী।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়াবিষয়ক পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস বলেন, ‘মৃত্যুদণ্ড অসংশোধনযোগ্য, মর্যাদাহানিকর এবং নির্মম শাস্তি হওয়ায় হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সকল পরিস্থিতিতে মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী। যখন বিচারপ্রক্রিয়া নিরপেক্ষ বিচারের মানদণ্ড অনুসরণ করা হয় না এবং মৃত্যুদণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে নিরপেক্ষ আদালতে আপিল করার অধিকার থাকে না, তখন এটা বিশেষভাবে সমস্যাপ্রবণ।’
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানায়, রাষ্ট্রপতির ক্ষমার বিষয়টি তাত্ত্বিকভাবে সম্ভব হলেও এসব রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অভিযোগের ক্ষেত্রে তা মঞ্জুরের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
এতে বলা হয়, কামারুজ্জামানকে ২০১০ সালের জুলাই মাসে গ্রেফতার করা হয়। তাকে তার গ্রেফতারের কোনো কারণ না জানানোয় নির্বিচার গ্রেফতার বিষয়ক জাতিসঙ্ঘ ওয়ার্কিং গ্রুপ (ইউএন ওয়ার্কিং গ্রুপ অন আরবিট্রারি ডিটেনশন) তার গ্রেফতারকে বিধি-বহির্ভূত এবং আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হিসেবে অভিহিত করে। মারাত্মক ক্রুটিপূর্ণ বিচারপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন বিচারে ২০১৩ সালের মে মাসে কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়া হয়। গত ৩ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্ট ওই দণ্ডাদেশ বহাল রাখে। এক সপ্তাহেরও কম সময়ে যুদ্ধাপরাধ মামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশ ছিল যুদ্ধাপরাধ মামলায় তৃতীয় মৃত্যুদণ্ড।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানায়, কামারুজ্জামানের মামলাটিসহ আইসিটির মামলাগুলো ত্রুটিপূর্ণ। কামারুজ্জামানের মামলায় সাক্ষী এবং নথি দাখিল, আসামিপক্ষের সাক্ষী ছিল বিধিবহির্ভূতভাবে সীমিত। গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীদের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সাক্ষ্যগুলোতে থাকা অসামঞ্জস্যতাগুলো আদালত প্রত্যাখ্যান করে, আসামিপক্ষকে প্রসিকিউশনের সাক্ষীদের চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ দিতে অস্বীকার করে।
হিউম্যান রাইটস জানায়, অন্যান্য মামলাতেও এই ধরনের বিশৃঙ্খলার নজির দেখা গেছে। ২০১৩ সালে আবদুল কাদের মোল্লাকে তাড়াহুড়া করে পূর্ববর্তী সময় থেকে কার্যকর (রেট্রোস্পেক্টিভ) বিধানে ফাঁসি দেয়া হয়, যা আন্তর্জাতিক আইনে নিষিদ্ধ। আরেক অভিযুক্ত দেলওয়ার হোসাইন সাঈদীর ক্ষেত্রে দেখা যায়, রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সদস্যদের হাতে এক গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীকে অপহরণ করার বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগও নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি উপেক্ষতি হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্তদের মৌলিক অধিকার রক্ষার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি বারবার আহ্বান জানিয়েছে।
অ্যাডামস বলেন, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ১৯৭১ সালে সংঘটিত নৃশংস অপরাধের বিচার ও জবাবদিহিতাকে সমর্থন করে। তবে এসব বিচার অবশ্যই আন্তর্জাতিক মানে নিরপেক্ষভাবে হতে হবে।
তিনি বলেন, বিশেষ করে জীবনের ব্যাপার সংশ্লিষ্ট থাকলে রায় প্রদানে সর্বোচ্চ মানদণ্ড অনুসরণ করা প্রয়োজন। মৃত্যুদণ্ড অসংশোধনযোগ্য ও নৃশংস। বাংলাদেশের উচিত এ থেকে চিরতরে সরে আসা।

No comments

Powered by Blogger.