বিনা ভোটের সাংসদদের বিশ্বজয়! by কামাল আহমেদ

ভোটারবিহীন নির্বাচন থেকে পাওয়া দশম সংসদের স্পিকার এবং একজন বহুল পরিচিত সাংসদ পার্লামেন্টারিয়ানদের দুটি বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষপদে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন, যাঁকে প্রধানমন্ত্রী ‘গণতন্ত্রের বিশ্বজয়’ বলে অভিহিত করেছেন। গণতন্ত্রের বিশ্বজয় তো বটেই, কেননা তাঁরা সেখানে নির্বাচনে গোপন ব্যালটে জিতেছেন। তাঁদের মধ্যে সাবের হোসেন চৌধুরীকে প্রথম দফায় দুবার জিততে হয়েছে, কেননা প্রথমবারের ব্যবধানটা যথেষ্ট ছিল না। তাঁরা দুজনে নিজ দেশে অটো-সাংসদ বা বিনা ভোটে পদস্থ হলেও বৈশ্বিক ওই দুই প্রতিষ্ঠানে নির্বাচিত হতে সেখানকার সদস্যদের ভোট তাঁদের প্রয়োজন হয়েছে। তাঁদের এই ঈর্ষণীয় সাফল্য উদ্যাপনে সরকার এবং জাতীয় সংসদ কেউ কোনো কার্পণ্য করেনি। অন্যের সাফল্যকে খাটো করার জন্য ঈর্ষাকাতর বাঙালির যে দুর্নাম আছে, এ ক্ষেত্রে তা যে আরও বিস্তৃত হয়নি, সেটা নিশ্চয়ই একটা স্বস্তির বিষয়। শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. ইউনূসের তিক্ত অভিজ্ঞতার পটভূমিতে এই কথাটি মনে আসা নিশ্চয়ই অস্বাভাবিক নয়।

>>প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সিপিএর সভানেত্রী শিরীন শারমিন চৌধুরী ও আইপিইউর সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী
দেশে ‘অনির্বাচিত’ কিন্তু বিদেশে নির্বাচিত আমাদের এই দুই গুণী সাংসদের সাফল্য উদ্যাপনে ক্ষমতাসীন দলের উৎসাহের রাজনৈতিক তাৎপর্য খুবই স্পষ্ট। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বেশ জোরগলায় বলছেন যে বৈশ্বিক পরিসরে তাঁদের এই সাফল্য বর্তমান সংসদের প্রতি বহির্বিশ্বের স্বীকৃতির প্রতিফলন। ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনকে বিশ্ব পরিসরে গ্রহণযোগ্য করে তোলার লক্ষ্যে সরকার যেসব কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক উদ্যোগ নেয়, তার একটি কৌশল ছিল বিভিন্ন বৈশ্বিক ফোরামে নির্বাচনে অংশগ্রহণ।
অবশ্য, সমালোচকের বক্তব্য আন্তর্জাতিক পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের সভাপতি পদে সাবের হোসেন চৌধুরীর নির্বাচনটি হচ্ছে সরকারের বাড়তি পাওয়া। যুক্তিটা হচ্ছে, এই পদটি সরকারের হিসাবে থাকলে স্পিকারকে কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনে প্রার্থী না করে আন্তর্জাতিক পার্লামেন্টারি ইউনিয়নে (আইপিইউ) তাঁকে দাঁড় করানোটাই হতো যুক্তিযুক্ত। বৈশ্বিক পরিসরে সংগঠন হিসেবে কমনওয়েলথ এবং ইন্টার-পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের কার গুরুত্ব কতটা, তা নিশ্চয়ই কারও বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। সাফল্যের ভাগীদার অনেকেই হয়, কিন্তু সাফল্য অর্জনের পেছনে যে কাঠখড় পোড়াতে হয়, সেটার শরিক খুব বেশি একটা পাওয়া যায় না।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা যায়, কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচনে স্পিকারের পক্ষে নানা জায়গায় লবিংয়ে সরকারিভাবে যতটা তৎপরতা চালানো হয়েছে, সাবের চৌধুরীর জন্য ততটা তৎপরতা দৃশ্যমান ছিল না। কমনওয়েলথ ফোরামে স্পিকারের প্রার্থিতার কথা কয়েক মাস আগেই সংসদ সচিবালয় এবং সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল। কিন্তু সাবের চৌধুরীর প্রার্থিতার কথা প্রথম জানা যায় আইপিইউর ৯ অক্টোবরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে, সংস্থাটির বার্ষিক সম্মেলনের তিন দিন আগে, যা পরদিন ১০ অক্টোবরের প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয়। তখন পর্যন্ত সরকারিভাবে কিংবা সংসদ সচিবালয় থেকে তাঁর প্রার্থিতার বিষয়ে ঢাকায় কোনো তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। ২০০৭ সালের সেনা–সমর্থিত সরকারের আমলে আওয়ামী লীগের যে কয়জন নেতা সংস্কারপন্থী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে দলীয় প্রধানের বিরাগভাজন হয়েছিলেন, সাবের চৌধুরী তাঁদের একজন। বাতাসে কথা চালু আছে, ওই কারণে ঢাকায় মেয়র পদে তাঁর দলীয় মনোনয়নের সম্ভাবনা তিরোহিত হয়েছে। অথচ বিজয়ী হতে পারেন এমন সম্ভাব্য বিকল্প প্রার্থী দলে না থাকায় সংস্কারের অজুহাতে ছয় বছর ধরে ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন ঠেকিয়ে রাখা হয়েছে। একই কারণে বাংলাদেশের ক্রিকেটের উন্নয়ন ও প্রসারে তাঁর উত্তরসূরিদের তুলনায় তিনি অনেক বেশি কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখার পরও বোর্ডের সভাপতি পদে গত নির্বাচনে তিনি সরকারের আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত হন। পেছনের সারির সাংসদেরা পতাকা বা পদ ছাড়াও যে অনেক কিছু করতে পারেন বলে সাবের চৌধুরী সংসদ প্লাজায় অনুষ্ঠিত সংবর্ধনায় মন্তব্য করেছেন, তা কি কিছুটা ইঙ্গিতপূর্ণ নয়?
স্পিকার এবং সাংসদ চৌধুরীর সাফল্যকে ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি ও দশম সংসদের গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক সুবিধা নিতে চাইতেই পারে। কিন্তু বাস্তবতা কি তাই? সংগঠন হিসেবে কমনওয়েলথের পরিধি যেহেতু ততটা বিস্তৃত নয়, তাই ওই প্রতিষ্ঠানটির বিষয়ে বিশদ আলোচনা না করলেও তেমন একটা ক্ষতি নেই। তবে প্রশ্নটির উত্তর পাওয়া যায় আইপিইউর ওয়েবসাইটে। সংগঠনটির সদস্য কারা থাকতে পারেন বা পারেন না, তা নির্ধারণের দায়িত্ব হচ্ছে এর পরিচালনা পরিষদ বা গভর্নিং কাউন্সিলের। ২০১২ সালের ২৪ অক্টোবর এই পরিচালনা পরিষদের ১৯১তম অধিবেশনে আইপিইউর সদস্যপদ নিয়ে যে আলোচনা হয়, তার ধারাবিবরণীতে দেখা যায় যে বলা হচ্ছে, ‘যদিও নির্বাচন গণতন্ত্রের একটি মৌলিক উপাদান, তা সত্ত্বেও সংগঠনটির সদস্যপদের জন্য মৌলিক চাহিদা হিসেবে পার্লামেন্টটি নির্বাচিত হতে হবে, এমন শর্তের অন্তর্ভুক্তি থেকে আইপিইউ বিরত থাকছে। সুতরাং সদস্যপদের জন্য এটি কোনো আবশ্যকতা হিসেবে বিবেচিত হবে না।’ ওই একই সভার বিবরণীতে সংগঠনটির সদস্যপদ স্থগিত বা বাতিলের বিষয়ে আলোচনার বিস্তারিত লেখা আছে। তাতে দেখা যায়, অসাংবিধানিক পন্থায় পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়া হলে সেই দেশের সদস্যপদ স্থগিতের বিধান তারা প্রয়োগ করতে পারে। আইপিইউর সাধারণ নীতি হচ্ছে, কোনো দেশে কোনো ধরনের সামরিক অভ্যুত্থান হলে তার সদস্যপদ স্থগিত করে দেওয়া। কিন্তু সম্প্রতি সেই অবস্থান থেকেও তারা সরে এসেছে। মিসর, লিবিয়া ও তিউনিসিয়ার ক্ষেত্রে অসাংবিধানিক পন্থায় পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার পরও সংগঠনটি তা করেনি এবং যুক্তি দিয়েছে যে গণতন্ত্রায়ণ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ওই সব পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়া হয়েছে। গণতন্ত্র সমুন্নত রাখার কৃতিত্বের স্বীকৃতি দেওয়ার মতো কোনো সার্টিফিকেট জারির অবস্থানে যে প্রতিষ্ঠানটি আছে, তা বলার অবকাশ নেই।
সোয়া শ বছরের এই বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানটি নিঃসন্দেহে অনেক মর্যাদাপূর্ণ এবং ঐতিহ্যের অধিকারী। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের প্রায় ৪৫ হাজার এমপির প্রতিনিধিত্ব করে এই সংগঠন। তাই একজন বাংলাদেশির এই সংগঠনটির নেতৃত্বের আসন লাভে সব বাংলাদেশিই যে আনন্দিত হবেন, সেটাই স্বাভাবিক। তবে বিষয়টিকে ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির বিজয় হিসেবে দেখানোর চেষ্টা আসলে তাঁদের রাজনৈতিক দৈন্যের কথাই সবাইকে মনে করিয়ে দেবে। বিশ্ব পরিসরে ভোটের বিজয় দেশের ভেতরে ভোটহীন ক্ষমতার দম্ভ প্রকাশের উপলক্ষ বা মাধ্যম কোনোটিই হতে পারে না। সাবের চৌধুরীর বিজয়ের পর আইপিইউর আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে অ্যামনেস্টির ঘোষিত ‘বিবেকের বন্দী’ সংস্থাটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। ২০০২ সালে সাবের চৌধুরী বিনা বিচারে আটক থাকার সময়ে তাঁকে মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি বিবেকের বন্দী বলে অভিহিত করেছিল। এখন তিনি যে সংগঠনটির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন, সেই সংগঠনের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কোনো সভায় উপস্থিতি অর্ধেকের কম হলে সেই সভা কোনো সিদ্ধান্তের বিষয়ে ভোট নিতে পারে না। আশা করা যায়, বৈশ্বিক পরিসরে গণতান্ত্রিক আচার-রীতির এসব ধারা প্রয়োগ করার সময় নিজ দেশের জন্য তাঁর বিবেক নিশ্চয় দীর্ঘকাল নির্বিকার থাকবে না এবং তিনি জাতীয় রাজনীতিতে সুস্থ গণতান্ত্রিক চর্চা ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় তাঁর ক্ষমতা ও প্রভাবকে কাজে লাগাবেন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির যে করুণ অবনতি দৃশ্যমান, তা নিয়ে দেশে-বিদেশে সমালোচনা ও বিতর্কের শেষ নেই। কিন্তু এসব সমালোচনার মধ্যেই মঙ্গলবার বাংলাদেশ অন্য ১৫টি দেশের সঙ্গে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের সদস্য হিসেবে আগামী তিন বছরের জন্য নির্বাচিত হয়েছে। ওই নির্বাচনের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী বলেছেন যে বাংলাদেশ যে সঠিক পথে রয়েছে, এসব নির্বাচনের সাফল্য তার প্রমাণ (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২২ অক্টোবর, ২০১৪)। জাতিসংঘ এবং তার সহযোগী সংস্থাগুলো জাতিসংঘ সনদ এবং অন্যান্য বৈশ্বিক সনদ ও নীতিমালা অনুযায়ী কাজ করছে কি না, তার ওপর নজরদারি করার একটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ইউএন ওয়াচ। মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য ব্যাপকভাবে সমালোচিত ও নিন্দিত দেশগুলোর জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ ও রেকর্ডের তালিকা এই ইউএন ওয়াচ নিয়মিত প্রকাশ করে থাকে। নিকট অতীতে ইরান, সিরিয়া, পাকিস্তান, সৌদি আরব ও সুদানের মতো দেশগুলোর মানবাধিকার পরিষদ ও তার বিভিন্ন কমিটিতে নির্বাচিত হওয়ার কঠোর সমালোচনার বিষয়টি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে বহুবার খবরের শিরোনাম হয়েছে।
জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে নির্বাচিত হলেই দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে—এই ধারণা নিয়ে মানবাধিকারবিষয়ক উদ্বেগগুলো নিরসনের চেষ্টা না করলে তাতে নিজেদের রেকর্ডে যে উন্নতি ঘটবে না, সেটা নিশ্চয়ই আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানেন। কেননা, তাঁকেই তো বহির্বিশ্বে এসব বিষয়ে অপ্রীতিকর প্রশ্নগুলোর মুখে পড়তে হয়।
কামাল আহমেদ: সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.