বালাগঞ্জে ইমাম ও চালক খুন- সন্ধান দাবিতে মানববন্ধনেও অংশ নিয়েছিল খুনিরা by ওয়েছ খছরু

অনুশোচনায় পুড়ছে না মা আফিয়া বেগম ও ছেলে মারজানুল আলম শিমুল। তাদের মনে নেই কোন হা-হুতাশও। এ জন্য রাতে খুনের পর দিনে আবার খালু ও সিএনজিচালককে খুঁজতে বের হয় শিমুল। এমনকি খালু ও চালকের সন্ধান দাবিতে বালাগঞ্জ সদরে আয়োজিত মানববন্ধন কর্মসূচিতেও অংশ নিয়েছিল সে। ঘুণাক্ষরেও যেন কেউ তাকে খুনি হিসেবে ঠাহর করতে না পারে সে জন্য সে এসব কাণ্ড করেছে। বালাগঞ্জ পূর্ববাজার জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা আবদুল হামিদ শুকুর ও সিএনজিচালক আরশ আলীর খুনের ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া মা আফিয়া বেগম ও ছেলে মারজানুল আলম শিমুল পুলিশের কাছে এসব তথ্য জানিয়েছে। দিয়েছে খুনের ঘটনার বিবরণও। আর খুনের ঘটনার বিবরণ শুনে আঁতকে উঠেছে পুলিশও। সিলেট জেলা পুলিশের একাধিক সিনিয়র কর্মকর্তা গতকাল মানবজমিনকে জানিয়েছেন, ওরা ঠাণ্ডা মাথায় খুন করে ইমাম ও গাড়িচালককে। আর খুনের ঘটনার পর তারা অনর্গল সবকিছু বলেও যাচ্ছে। আদালতের কাছে সে কথা বলবে বলে আশ্বাস দেয়ায় গতকাল বিকালে পুলিশ মা ও ছেলের ১৬৪ ধারা জবানবন্দি রেকর্ড করতে আদালতে পাঠিয়েছে। সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলা সদরের মসজিদের ইমাম মাওলানা আবদুল হামিদ শুকুর পরিচিত সিএনজিচালক আরশ আলীকে নিয়ে শনিবার রাতে তাজপুরের উদ্দেশে রওনা দেন। পথিমধ্যে তারা হঠাৎ করে গুম হয়ে যান। এরপর থেকে তাদের কোন খোঁজ নেই। ঘটনার পর বালাগঞ্জ থানা পুলিশ পুরো বিষয়টি তদন্ত শুরু করে। বালাগঞ্জ থানার ওসি অকিল উদ্দিন আহমদ ও সাব-ইন্সপেক্টর অরূপ কুমার তালুকদার তাদের খুঁজে বের করতে তদন্তের ডালপালা বিস্তৃত করেন। তদন্তের প্রথম পর্যায়েই তারা অনুমান করেন গুম হওয়ার স্থলে আশপাশে কোন আত্মীয়স্বজন রয়েছে কিনা। সেই সূত্র ধরে তারা জানতে পারেন গুম হওয়া স্থলের আশপাশেই রয়েছে মাওলানা শুকুরের শ্যালিকার বাড়ি এবং ওই বাড়িতে সব সময় যাতায়াত ছিল মাওলানার। সে ধারণায় পুলিশ ইলাশপুর গ্রামে শ্যালিকার বাড়িতে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলে বেরিয়ে আসে দু’জন গুম হওয়ার রহস্য। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় পুলিশ মাওলানা শুকুরের শ্যালিকার বাড়ির বাথরুমের ভেতরে পুঁতে রাখা অবস্থায় উদ্ধার করে মাওলানা শুকুর ও গাড়িচালক আরশ আলীর লাশ। দু’টি লাশ উদ্ধারের পর সব বিষয় খোলাসা হয়ে যায়। ধরা পড়ে আসামিরা। খুনের ঘটনায় পুলিশ মাওলানার শ্যালিকা আফিয়া বেগম ও তার ছেলে শিমুলকে গ্রেপ্তার করেছে। তাদের নামে বালাগঞ্জ থানায় হত্যা মামলা হয়েছে। মামলা করেন নিহত মাওলানা শুকুরের ভাই আবদুল খালিক। গতকাল সকালে মামলা রেকর্ড করা হয়েছে জানিয়েছেন বালাগঞ্জ থানার ওসি অকিল উদ্দিন আহমদ। এ ঘটনায় আটক আফিয়ার মেয়ে শিরিন ও শাকিলকে অভিযুক্ত করা হয়নি। ইলাশপুর গ্রামের সৌদি প্রবাসী ফিরোজ মিয়ার স্ত্রী আফিয়া বেগম। ফিরোজ মিয়া সৌদি আরবে রয়েছেন। পুলিশ জানায়, বৃহস্পতিবার রাতে আফিয়া, শাকিলসহ চারজনকে আটক করে সিলেট জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয়। ওখানে প্রথমে চারজনকেই আলাদাভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরে আফিয়া ও তার ছেলে শিমুলকে যৌথভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে আফিয়া ও শিমুল খুনের ঘটনা স্বীকার করে। লোমহর্ষক খুনের বর্ণনা দিয়ে তারা জানায়, শনিবার মধ্যরাতে তারা প্রথমে দা দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপায় মাওলানা শুকুরকে। কয়েকটি কোপ দেয়ার পর মাওলানা শুকুর মাটিতে লুটে পড়েন। পরে জবাই করে তাকে খুন করে লাশ বাথরুমে নিয়ে রাখা হয়। এরপর গাড়িচালক আরশ আলীকেও একই কায়দায় খুন করা হয়। দা দিয়ে শাকিলকে কোপানোর পর গলা কেটে হত্যা করা হয়। পুলিশ জানায়, তাদের দেয়া তথ্যমতো সুরতহাল রিপোর্টকালে দু’জনের গলায় দেড় ইঞ্চি পরিমাণ কাটার দাগ রয়েছে বলে প্রমাণ পায়। দু’জনকে হত্যার পর লাশ বাথরুমে রেখে আফিয়া ও শিমুল লাশ গুম করার পরিকল্পনা করে। এ সময় শিমুলদের বাড়ির উঠোনে ছিল চালক আরশের গাড়ি। খুনের ঘটনার পর শিমুল নিজেই গাড়ি চালিয়ে পার্শ্ববর্তী লামাপাড়ায় ফেলে আসে। বাড়ি ফিরে শিমুল তার হাতে কাটা অংশে ব্যান্ডেজ করে। এরপর তারা ঘরের মেঝেতে থাকা রক্ত পরিষ্কার করে। মেঝের কিছু অংশে রক্তের দাগ স্থায়ীভাবে লেগে থাকায় সে অংশটি উঠিয়ে নেয়া হয়। পরে তারা ঠিক করে নিজেদের বাথরুমেই গুম করে রাখবে। সে অনুযায়ী তারা বাথরুমে গর্ত করে সেখানেই পুঁতে রাখে দু’জনের লাশ। এরপর সেখানে মাটি দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। রাতেই আফিয়া ও শিমুল মিলে পুঁতে রাখা অংশে ইট দিয়ে দেওয়াল তোলে এবং সিমেন্ট দিয়ে লেপ্টে দেয়। তবে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছে, সিমেন্ট দিয়ে তারা একদিনে পুরো অংশ ঢাকতে পারেনি। তিন দিনে তারা পুরো অংশটি সিমেন্ট দিয়ে আস্তরণ করে দেয়। বৃহস্পতিবার ইলাশপুর গ্রামে শিমুলের আশপাশের বাড়ির লোকজন জানিয়েছেন, শনিবার রাতে তারা শিমুলদের ঘরের ভেতরে চিৎকারের আওয়াজ শুনেছেন। কিন্তু বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি সে আওয়াজ। এ কারণে তারা সেদিকে নজর দেননি। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে শিমুল জানায়, লাশ গুমের পর সে অনেকটা স্বাভাবিক ছিল। হাতে ব্যান্ডেজ ছাড়া কোন চিহ্নই তার ছিল না। এ কারণে রোববার সকাল থেকে সেও মাওলানা শুকুর ও গাড়িচালক আরশ আলীর সন্ধানে বের হয়। আত্মীয়দের বাড়িতে সে খোঁজাখুঁজি করে। এমনকি মঙ্গলবার বালাগঞ্জ উপজেলা সদরে আয়োজিত বিশাল মানববন্ধনেও সে অংশ নেয়। এ সময় সে মিছিলও করে। ইউএনও অফিসে গিয়ে স্মারকলিপি দেয়। এরপর বাড়ি ফিরে আসে। আফিয়া বেগম জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, খুনের ঘটনার পর তারা বেশ স্বাভাবিকই ছিল। বাড়িতেই তারা স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করেছে। ভাত রেঁধেছে। টানা ৬ দিন সবাই একসঙ্গে মিলে খেয়েছেও। তবে খুনের ঘটনার মূল কারণ সম্পর্কে আফিয়া ও শিমুল দু’জনই উল্লেখ করেছে অনৈতিক সম্পর্কের কথা। শুক্রবার পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদেও আফিয়া জানিয়েছে, মাওলানা শুকুরের সঙ্গে তার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ছিল। স্বামী বিদেশে থাকার সুবাদে মাওলানা শুকুর প্রায়ই তার বাসায় যেতেন এবং মেলামেশা করতেন। একপর্যায়ে তার মেয়ে শিরিনের ওপর নজর পড়ে এবং শিরিনের সঙ্গেও অনৈতিক সম্পর্ক গড়ার প্রস্তাব দেয়। এ নিয়ে শনিবার রাতে দ্বন্দ্ব হয়। কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে দা দিয়ে কুপিয়ে খুন করা হয় মাওলানা শুকুরকে। পরে গাড়িচালককেও খুন করা হয়। তবে, জিজ্ঞাসাবাদে আফিয়া ও শিমুল টাকা-পয়সা লেনদেনের কোন বিষয়টি উল্লেখ করেনি। এ ব্যাপারে তারা কোন কথা বলেনি। পারিবারিক সূত্র জানিয়েছে, মায়ের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক থাকায় শিমুলকে বশে আনতে যৌথ অ্যাকাউন্টে টাকা রাখতেন মাওলানা শুকুর। আর শুকুরকেও তিনি সব সময় টাকা-পয়সা দিয়ে রাখতেন। এমনিভাবে ব্যাংকে থাকা ৫০ লাখ টাকা নিয়ে দ্বন্দ্বের জের ধরে খুন হন মাওলানা শুকুর। আর পরিস্থিতির শিকার হন গাড়িচালক আরশ আলী। সিলেট পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার গোপাল চন্দ্র মানবজমিনকে জানিয়েছেন, তাদের দেয়া সব তথ্য যাচাই-বাছাই হচ্ছে। পুলিশকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে কিনা সেটিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তিনি বলেন, এখনই সুনির্দিষ্ট কিছু বলা যাবে না। তদন্তের পর সবকিছু খোলাসা হবে। তবে, তিনি বলেন, আফিয়া বেগম ও মারজানুল আলম শিমুল খুনের ঘটনা স্বীকার করেছে। এদিকে, বৃহস্পতিবার উদ্ধার হওয়া মাওলানা শুকুর ও আরশ আলীর লাশের ময়দাতদন্ত শেষে গতকাল বিকালে পরিবারের কাছে সমঝে দেয়া হয়। এরপর রাতে বালাগঞ্জ উপজেলা সদরে ও বোয়ালজুর বাজারে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। দুই খুনের ঘটনায় গোটা বালাগঞ্জে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। দু’টি গ্রামে চলছে বুকফাটা আর্তনাদ। বালাগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দাল মিয়া জানিয়েছেন, বালাগঞ্জের ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা এবার প্রথম। নির্মম এ ঘটনা নাড়া দিয়েছে গোটা উপজেলাবাসীকে। সবাই শোকাচ্ছন্ন। একই সঙ্গে গাড়িচালকরা রয়েছেন আতঙ্কে। এ অবস্থা কাটানোর জন্য প্রশাসনকে আরও বেশি উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

No comments

Powered by Blogger.