আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশের নিরাপত্তা চাই by এবনে গোলাম সামাদ

ভারতের একজন সাবেক প্রেসিডেন্ট আবুল পাকির জয়নুলাবেদিন আবদুল কালাম ঢাকায় এসে বক্তৃতা দিতে গিয়ে বললেন, বাংলাদেশ ভারতের প্রাকৃতিক বন্ধু। ‘প্রাকৃতিক’ কথাটা বলতে ঠিক কী বুঝতে হবে, সেটা অনেকের কাছেই স্পষ্ট করতে পেরেছেন বলে মনে হচ্ছে না। কেননা, ভারতের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে বয়ে আসছে ছোট-বড় প্রায় ৫৪টি নদী। ভারত একতরফাভাবে এসব নদী থেকে নিয়ে নিচ্ছে পানি। ফলে বাংলাদেশ ভুগছে পানির অভাবে। তাই ভারতকে বাংলাদেশ এখন কতটা প্রাকৃতিক বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতে পারে, সেটা নিয়ে দেখা দিচ্ছে প্রশ্ন। বাংলাদেশের অনেকের কাছে ভারত এখন প্রাকৃতিক বন্ধু হিসেবে বিবেচিত না হয়ে, প্রতিভাত হতে পারে প্রাকৃতিক বৈরী শক্তি হিসেবে। আমরা জানি, ভারত ১৯৫১ সাল থেকে গঙ্গার ওপর নির্মাণ আরম্ভ করে বিখ্যাত ফারাক্কা ব্যারাজ। ১৯৭৫ সালে আরম্ভ হয় ফারাক্কা ব্যারাজের কার্যকারিতা। আমরা জানি, এর ফলে বিশেষভাবে নষ্ট হয়েছে পদ্মা নদীর নাব্যতা। পদ্মা নদীতে আগের মতো পানি আসছে না বলে এতে ধরা পড়ছে না আগের মতো মাছ। যেহেতু পদ্মা নদীতে স্রোতের মাত্রা কমে গেছে, তাই পদ্মা এবং তার শাখানদীতে এখন আর আগের মতো বেগে পানি প্রবাহিত হতে পারছে না। ফলে ঊষর হয়ে উঠছে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের কৃষিভূমি। কেননা, সমুদ্র থেকে জোয়ারের পানি লবণ বহন করে আনছে। আগের মতো তা আর ধুয়ে যেতে পারছে না পানির স্রোতে। ফলে বাংলাদেশে ঘনিয়ে উঠছে বিশেষ প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপর্যয়। শোনা যাচ্ছে, গঙ্গার উজানে ভারত নাকি গড়তে যাচ্ছে আরো ১৬টি ব্যারাজ। ভারতের এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে পদ্মায় আর কোনো পানি আসবে বলে মনে হয় না। এ রকম এক পরিস্থিতিতে ঢাকায় এসে কালাম সাহেব বললেন, ভারত হলো বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বন্ধু। কথাটিকে আমাদের মনে হচ্ছে একটা বিরাট প্রহসন। কালাম সাহেব এ দেশে বক্তৃতা দিতে আসার আগে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে যদি যথাযথভাবে জেনে আসতেন, তবে মনে হয়, তার বক্তৃতার ধরন হতে পারত অনেক পৃথক। আর তা আমাদের কাছে হতে পারত অনেক যুক্তিসহ। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রাকৃতিক বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে হলে ভারতকে দিতে হবে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশের নিরাপত্তা। আমরা আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশের নিরাপত্তা চাই।
এপিজে আবদুল কালাম ভারতের একাদশতম প্রেসিডেন্ট। এর আগে যারা প্রেসিডেন্ট হয়েছেন, তারা কেউই ছিলেন না প্রযুক্তিবিদ। কিন্তু কালাম সাহেব হলেন ভারতের প্রথম প্রযুক্তিবিদ প্রেসিডেন্ট। তিনি রকেট নির্মাণের েেত্র একজন বিশেষ পারদর্শী ব্যক্তি। বাংলাদেশে এসে কালাম সাহেব বোঝাতে চেয়েছেন, ভারত হলো একটি শান্তিবাদী দেশ। কিন্তু তিনি যখন ঢাকায় বক্তৃতা করছিলেন, তখন ভারত আকাশে উৎপেণ করছিল ক্রুজ মিসাইল (পেণাস্ত্র), যা পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সম। ভারত এক দিকে বলছে শান্তির কথা, সেই সাথে আবার করে চলেছে সমরায়োজন। ভারতে চলেছে আত্মরার নামে আক্রমণের প্রস্তুতি। ভারতে অনেক নেতা ভাবছেন বৃহত্তর ভারত গড়ার কথা। এই বৃহত্তর ভারত গড়ার পরিকল্পনার মধ্যে কেবল যে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান দখলের কথাই আসছে, তা নয়। থাকছে দণি-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোকে ভারতের নিয়ন্ত্রণে আনার স্বপ্ন। ভারত ইতোমধ্যে নিকোবার দ্বীপপুঞ্জে গড়ে তুলেছে পারমাণবিক অস্ত্রসংবলিত নৌঘাঁটি, যা ইন্দোনেশিয়ার প্রায় লাগোয়া। ইন্দোনেশিয়া ভারত জয়ের কোনো স্বপ্ন দেখছে না। তাই তার গা ঘেঁষে এ রকম নৌঘাঁটি নির্মাণ সমর্থনীয় নয়।
এপিজে আবদুল কালাম ঢাকায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে যখন ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে মৈত্রী বন্ধন গড়ে তোলার কথা বলছিলেন, তখন আমাদের কাছে এসে পৌঁছাল জয়রাম জয়ললিতার জামিনলাভের কথা। তিনি এখন কারাবন্ধনমুক্ত। কালাম সাহেব জয়ললিতার ভক্ত নন। তিনি দল হিসেবে হলেন ভারতের ইন্দিরা কংগ্রেসের সাথে সংশ্লিষ্ট। তিনি জন্মেছেন তামিলনাড়–তে। তামিলনাড়–র মানুষ এখন চাচ্ছে ভারত থেকে যেন পৃথক হয়েই যেতে। ভারতে প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে আর্য-দ্রাবিড় বিরোধ। ভারতের একতা বজায় রেখেছিল কংগ্রেস। এখন তার স্থলে বিজিপি এই একতা কতটা বজায় রাখতে সম হবে, সেটা অনুমান করা সম্ভব হচ্ছে না। সব দ্রাবিড় ভাষাভাষী অঞ্চলে বিজিপি মোটেও জনপ্রিয় নয়। আর্য-দ্রাবিড় সঙ্ঘাত বর্তমান ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্র যথেষ্ট বদলে দিতেই পারে। বাংলাদেশের মানুষের সংস্কৃতি যতটা না মেলে উত্তর ভারতের আর্য সংস্কৃতির সাথে, তার চেয়ে অনেক বেশি মেলে দণি ভারতের দ্রাবিড় ভারতের সাথে। দ্রাবিড় ভারত যদি একটা পৃথক রাষ্ট্রে পরিণত হয়, তবে অনেক সহজ হবে তার সাথে বাংলাদেশের স্বাভাবিক মৈত্রী। মুঘল শাসনামল থেকেই বাংলাদেশের মানুষের মনে বিরাজ করছে দিল্লিবিরোধী মনোভাব। এটা এখনো হয়ে আছে বেশ সুস্পষ্ট। ‘জাতি’ বলতে বোঝায়, ইতিহাসের ধারায় গড়ে ওঠা একটি জনসমষ্টিকে। আমাদের ইতিহাসের ধারা এবং হিন্দিভাষী উত্তর ভারতের ইতিহাসের ধারা এক নয়। একসময় বাংলাদেশে ছিল একটি পৃথক স্বাধীন মুসলিম সালতানাত। সে আমলে মুসলিম সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠেছিল বাংলা ভাষা। সৃষ্টি হতে পেরেছিল একটি পৃথক স্থাপত্যরীতি, যা হলো বাংলাদেশের বিশেষ সংস্কৃতির পরিচয়। আমাদের সংস্কৃতি দিল্লিনির্ভর ভারতীয় সংস্কৃতি নয়।
এ পি জে আবদুল কালাম বলছেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে রয়েছে সাংস্কৃতিক ঐক্য। কিন্তু তিনি এটা বলতে পারছেন বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস না জানার কারণে। কালাম সাহেবের বক্তব্যের সাথে যথেষ্ট মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে ভারতের বর্তমান প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জির চিন্তাচেতনার। প্রণব মুখার্জি সম্প্রতি বলেছেন, ভারত ও বাংলাদেশ আসলে নাকি একই দেশ। কিন্তু তিনি যেটা ভুলে গেছেন তা হলো, ভারতের রাষ্ট্রভাষা হলো হিন্দি আর বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। হিন্দি আর বাংলা এক ভাষা নয়। কালাম সাহেব বলছেন, বাংলাদেশকে জোর দিতে হবে গ্রামীণ অর্থনীতির ওপর। এ কথা আমরা স্বীকার করি। বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতি আমাদের কাছে যথেষ্ট বিবেচনা পাচ্ছে। আমাদের অর্থনীতি এখনো হয়ে আছে মূলত কৃষিভিত্তিক। বাংলাদেশের মানুষ কৃষিকাজকে কখনো খাটো করে দেখেনি বা এখনো দেখে না। বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ ধান উৎপাদক দেশ। প্রথম ধান উৎপাদক দেশ হলো চীন। তারপর হলো ভারত। এর পরে আসে জাপানের নাম। জাপানের পরেই বাংলাদেশের স্থান। বাংলাদেশের কৃষকেরা ধনী নন। এ দেশের কৃষকেরা ধান উৎপাদন করেন অনেক কম খরচে। এর প্রশংসা না করে পারা যায় না। আমাদের গ্রাম্য অর্থনীতি ভারতের তুলনায় কম অগ্রসর নয়। বরং ভারতের গ্রামীণ জনসমষ্টির চেয়ে বাংলাদেশের গ্রামীণ জনসমষ্টি বেশি খেয়ে পরেই জীবনধারণ করছে। কালাম সাহেবের বক্তব্য তাই আমাদের কাছে মোটেও প্রাসঙ্গিক নয়।
ভারত চাচ্ছে শিল্প অর্থনীতি জোরদার করতে। ব্রিটিশ শাসনামল থেকেই ভারতে চলেছে এই প্রয়াস। ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে টাটা কোম্পানির মতো ইস্পাত উৎপাদন প্রতিষ্ঠান। যে অঞ্চল নিয়ে বাংলাদেশ গঠিত, সেখানে ছিল না লৌহ আকর; সেখানে ছিল না লোহা গলানোর জন্য কয়লার খনি। পাকিস্তান হওয়ার পর পূর্ব পাকিস্তানে আবিষ্কৃত হয় প্রাকৃতিক গ্যাস। এ গ্যাস ব্যবহার করে ফেঞ্চুগঞ্জে প্রস্তুত হতে থাকে নাইট্রোজেনঘটিত সার। এর প্রয়োগে বাড়তে পারে বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন। কৃষি উৎপাদন এই দেশে হয়নি অবহেলিত। পাকিস্তান আমলেই আরম্ভ হয় এ েেত্র যথেষ্ট গুরুত্বারোপ। আর এখনো আমরা আমাদের কৃষি অর্থনীতিকে করতে চাচ্ছি না অবহেলা। তাই কালাম সাহেবের উপদেশ আমাদের অনেকের কাছেই মনে হয়েছে একান্তভাবেই অবান্তর। তিনি যেসব কথা বলেছেন, আমাদের অর্থনীতিবিদেরা সে সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন হয়েই আছেন।
ভারত হয়ে উঠতে চাচ্ছে একটি সমরবাদী দেশ। ভারত এখন প্রচুর অর্থ ব্যয় করছে সমরাস্ত্র নির্মাণে। কিন্তু যুদ্ধ কেবল সমরাস্ত্রনির্ভর নয়। যুদ্ধকে অনেকে তুলনা করেন একটি সমত্রিবাহু ত্রিভুজের সাথে। এর একটি বাহুকে বলা যায়, সুবিন্যস্ত সেনাবাহিনী। আর একটি বাহুকে বলা যায়, প্রয়োজনীয় রণসম্ভার। আর অপর একটি বাহুকে বলতে হয়, যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মতো অর্থনৈতিক সঙ্গতি। এই তিন বাহুর যেকোনো একটি দুর্বল হলেই যুদ্ধে ঘটতে পারে একটি দেশের পরাজয়। দু-দু’টি বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের একটি বড় কারণ হলো খাদ্যাভাব। জার্মানি বৃদ্ধি করতে পারেনি তার খাদ্যশস্যের উৎপাদন। ফলে যুদ্ধের সময় তাকে রুটি তৈরির ময়দার সাথে মেশাতে হয় করাতের গুঁড়ো, যা খেয়ে সৈন্যরা হয়ে পড়তে থাকে অসুস্থ। ভারত তার সমরায়োজনে সৈন্যবল বৃদ্ধি করছে, বাড়ছে সমর উপকরণ। কিন্তু সেভাবে বাড়াতে পারছে না তার খাদ্যশস্যের উৎপাদন। তাই ভারত যদি কোনো প্রলম্বিত যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, তাবে সে তার সেনাবাহিনীকে যথাযথভাবে রসদ সরবরাহ করতে পারবে বলে মনে হয় না। ভারত আকাশে ক্রুজ মিসাইল ছুড়ছে। কিন্তু তার এই অস্ত্রসম্ভার বৃদ্ধি সম্ভাব্য কোনো যুদ্ধে তাকে জয়ের নিশ্চয়তা দেবে, এ রকম কোনো ভবিষ্যদ্বাণী করা চলে না। ১৯৭১ সালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় বাহিনী যুদ্ধে জয়ী হয়েছিল। এই জয়ী হওয়ার একটি কারণ হলো, তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের একটি বিরাট অংশ তখন ছিল ভারতের প।ে কিন্তু এখন অবস্থার অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। জনমত এখন ভারতের পে নয়। বাংলাদেশের মানুষ চাচ্ছে বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাখতে; ভারতের সাথে মিশে যেতে নয়। তা বাংলাদেশের সম্পর্কে ভারতের নেতারা যতই এক জাতি, এক প্রাণ একতার কথা বলেন না কেন।
এ পি জে কালাম একজন প্রথম শ্রেণীর প্রযুক্তিবিদ। কিন্তু একটি দেশের মানুষের জাতীয়তাবোধ কেবল তার প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করে না। নির্ভর করে তার জাতীয় মনমানসিকতার ওপর। ভারতের জাতীয়তাবাদ আর বাংলাদেশের মানুষের জাতীয়তাবাদ একসূত্রে বাঁধা পড়েনি। ১৯৭১-এর অবস্থা ও আজকের অবস্থা বিশেষভাবেই হয়ে উঠেছে ভিন্ন।

No comments

Powered by Blogger.