নিকটজনেরাই শিশু রাব্বীর ঘাতক

তিন বছরের শিশু রাব্বীর খুনি কে? উত্তর খুঁজে পায়নি দু-সপ্তাহেও পুলিশ। তবে পুলিশ বলছে, তারা এটুকু নিশ্চিত হয়েছে রাব্বীর ঘাতক তার কাছের স্বজনরাই। তার চাচারাই এ খুনের সঙ্গে জড়িত। এক চাচাকে ৩ দিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। মীর মিথিল নামে রাব্বীর ওই চাচাতো চাচা ধরা পড়ার পরই পালিয়ে গেছে মিথিলের অন্য দুই ভাই এবং তাদের আরেক আত্মীয়। এ ছাড়া পালিয়ে বেড়াচ্ছেন আরও কয়েকজন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সুলতানপুরের মীর মো. সজীবের একমাত্র সন্তান রাব্বীকে খুনের পর লাশ বস্তাবন্দি করে ইট বেঁধে পুকুরের পানিতে ডুবিয়ে দেয়া হয়। হত্যাকাণ্ডের সময় চিৎকার যাতে না করতে পারে সে জন্য কাগজ পুঁটলি করে মুখে গুঁজে দেয়া হয়। লাশ উদ্ধারের পর কাগজের ওই পুঁটলি পাওয়া যায় তার মুখে। পৈশাচিক শিশু খুনের এ ঘটনা স্তম্বিত করে সবাইকে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে ওই গ্রামজুড়ে। গত ১১ই অক্টোবর বাড়ির পাশের পুকুর (মনাইয়ের বাড়ির পুকুর) থেকে উদ্ধার হয় রাব্বীর লাশ। এর আগে ৯ই অক্টোবর বাড়ির আঙিনা থেকে নিখোঁজ হয় শিশু রাব্বী। সকাল ১০টা থেকে সাড়ে ১০টার মধ্যে নিখোঁজ হয় সে। নিখোঁজের মিনিট পনেরো আগে রাব্বীকে বাড়িতে দেখেছেন তার স্বজনরা। পরিবারের কেউ একজন ওই সময় তাকে আইসক্রিমও কিনে দেয়। এর উল্লেখ করে পুলিশ বলছে, ১০-১৫ মিনিট সময়ের মধ্যে বাইরে থেকে কেউ এসে তাকে অপহরণ করেনি। সে হিসেবে আমরা নিশ্চিত বাড়ির লোকজনই তার অপহরণকারী ও খুনি। রাব্বীর লাশ উদ্ধারে পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে রাব্বীর দাদা কুতুব মিয়া তার ছোট ভাই সোনা মিয়ার ছেলে মীর আবুল বাশার (৫৫) ও তার দুই ছেলে মীর মানিক (২৫) ও মীর রতন (২২)-কে সন্দেহ করছে পুলিশ। রাব্বীর পিতা সজীব মিয়াও এ ৩ জনকেই তার সন্দেহ হয় বলে জানায় পুলিশকে। এর পরই পুলিশ তাদের আটক করে নিয়ে আসে। পরে এ ৩ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দেন রাব্বীর পিতা মীর মো. সজীব। এদিকে ঘটনার প্রায় এক সপ্তাহ পর মামলার বাদী সজীব মিয়ার আরেক চাচাতো ভাই মীর মো. মিথিল (২৬) পুলিশের হাতে আটক হলে ঘটনা অন্যদিকে মোড় নেয়। গত ১৯শে অক্টোবর মিথিলের ৭ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানিয়ে আদালতে পাঠায় পুলিশ। তার রিমান্ড আবেদনে বলা হয়, মিথিল তার অজ্ঞাতনামা সহযোগীদের নিয়ে রাব্বীকে কৌশলে অপহরণ করে এবং পূর্বশত্রুতার জের ধরে নৃশংসভাবে হত্যা করে। পরে লাশ গুম করার জন্য বস্তাবন্দি করে পুকুরের পানিতে ফেলে দেয় বলে বিভিন্ন তথ্য রয়েছে। তাকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদে অন্য আসামিদের শনাক্ত ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে বলে রিমান্ড আবেদনে বলা হয়। চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত মিথিলের ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। এদিকে মিথিল আটক হওয়ার পর তাকে ছাড়িয়ে নিতে বাদী তৎপর হয়ে ওঠেন। তাকে সন্দেহ করছেন না বলে বাদী আদালতে আবেদন করেন। এর আগে পুলিশ সুপারের কাছে একই আবেদন করেন বাদী। বাদীর এ তৎপরতা রহস্যের সৃষ্টি করেছে। এর আগে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মিথিলকে থানায় ডেকে নিলে তাকে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা চালানো হয়। এক প্রভাবশালী ওসির সঙ্গে এ নিয়ে দরজা বন্ধ করে প্রায় দুই ঘণ্টা বৈঠক করেন। ১ লাখ টাকায় মিথিলকে ছাড়ার রফাদফা হয়েছে বলে তখন খবর ছড়িয়ে পড়ে। এদিকে মিথিলকে পুলিশ আটক করার পরই পালিয়ে যায় তার অন্য দু-ভাই সাথিল ও সবুজ। পালিয়ে যায় ওই বাড়িতে বসবাসকারী শাহআলম নামের তাদের এক আত্মীয়। এ ছাড়া পলাতক রয়েছে আরেকজন। সূত্র জানায়, মিথিলকে আটক করার আগে তার পিতাসহ অন্য ভাইদের এবং বাদীর পিতা ও ভাইদের দু-দিন থানায় ডেকে এনে কয়েক ঘণ্টা করে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। যে পুকুর থেকে রাব্বীর লাশ উদ্ধার হয়েছে এর পাড়ে একটি ঘরে বসবাসকারী পাহারাদার হাবিব মিয়া ও তার স্ত্রী জায়েদা বেগমকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। বৃহস্পতিবার ফুল মিয়া, তার নাতি রাজিব, ঘাটিয়ারা গ্রামের শোভা মোল্লা ও হাবিব নামের আরও ৪ জনকে থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ।
কেন এ খুন: সুলতানপুর দক্ষিণপাড়ার মনাইবাড়ীর কুতুব মিয়া, সোনা মিয়া ও ফুল মিয়া আপন ৩ ভাই। তাদের মধ্যে মেঝো ভাই সোনা মিয়া জীবিত নেই। সোনা মিয়ার ছেলে আবুল বাশারের সঙ্গে জায়গা-সম্পত্তি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছে ফুল মিয়া আর তার ছেলেদের। কোরবানির ঈদের পরদিন এ নিয়ে গ্রামে সালিশও বসে। সেখানে একটি ফয়সালাও হয়। সালিশের রায় মেনে বাশারের ছেলেরা ফুল মিয়ার ছেলেদের বিরুদ্ধে থানায় করা অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেয়। কিন্তু সালিশের এ সিদ্ধান্ত মানা নিয়ে গড়িমসি শুরু করে ফুল মিয়া আর তার ছেলেরা। তারা বাশার মিয়া ও তার ছেলেদের বিরুদ্ধে থানায় করা অভিযোগও প্রত্যাহার করেনি। এ সালিশ হওয়ার ৩ দিন পরই গত ৯ই অক্টোবর সকাল ১০টা থেকে সাড়ে ১০টার মধ্যে নিখোঁজ হয় রাব্বী। এর দু-দিন পর মিলে তার বস্তাবন্দি লাশ। ঘটনার পরই আবুল বাশার আর তার সন্তানদের ফাঁসাতে এ খুনের ঘটনা ঘটানো হয়েছে বলে গ্রামের লোকজনের মধ্যে আলোচনা ছড়িয়ে পড়ে। নিহত রাব্বীর দাদা কুতুব মিয়া জমি বিক্রি করে সম্প্রতি ১৩ লাখ টাকা পান। সেই টাকা তার ছেলে সজীব মিয়ার নামে ব্যাংকে গচ্চিত রেখে দেন। এ নিয়ে কুতুব মিয়ার অন্য ৪ ছেলে ও ৩ মেয়ের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। হত্যার পেছনে এ কারণও আলোচনায় আসে। তবে শুরু থেকেই গ্রামের মানুষের সন্দেহের তীর ছিল ফুল মিয়ার সন্তানদের দিকে। ফুল মিয়ার ছেলে মিথিল ও সাথিল মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তাদের বাড়িতে থেকে মাদক ব্যবসায় সহায়তা করতো টানচক গ্রামের শাহআলম। মিথিলকে আটক করার পরই পালিয়ে গেছে সাথিল, তার ভাই সবুজ ও শাহআলম। মিথিল, সাথিল ও শাহআলম ঘটনার দিন দিবাগত রাত আড়াইটা-তিনটার দিকে পুকুর পাড়ে অবস্থান করছিল পুলিশ- এমন তথ্য পেয়ে পুকুরের পাহারাদার হাবিব ও তার স্ত্রী জায়েদা বেগমকে থানায় ডেকে এনে দু-দিন জিজ্ঞাসাবাদ করে। গ্রামে আলোচনা আছে রাতে পুকুর পাড়ে গিয়ে শিকলে বাঁধা নৌকা খুলে নেয়ার শব্দে ঘুম ভেঙে যায় পাড়ের একটি ঘরে বসবাসকারী হাবিব মিয়া ও তার স্ত্রীর। এর পরই মিথিল-সাথিল তার কাছে এসে লাশটি পানিতে গুম করতে সহায়তা চাই। ২০ হাজার টাকা দেয়ারও প্রস্তাব দেয়। এ বিষয়ে হাবিব আর তার স্ত্রী জায়েদা বেগমের কাছে জানতে চাইলে বলেন, আমরা কোন কিছুই দেখিনি। তবে থানায় ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর থেকে হাবিব আর পুকুর পাহারা দিতে যাচ্ছেন না। এ বিষয়ে খোঁজখবর নিতে সুলতানপুর মনাইয়ের বাড়িতে গেলে কথা হয় ফুল মিয়ার সঙ্গে। তিনি বাশার মিয়া ও তার ছেলেদের সঙ্গে কোন বিরোধ নেই বলে জানান। তবে অনেক প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যান তিনি। জায়গা-সম্পত্তি নিয়ে কোন সালিশ হয়নি বলেও জানান। তার সঙ্গে কথা বলার সময় সেখানে আসেন বাশার মিয়ার স্ত্রী লুৎফা বেগম। তিনি পাশের ৮ শতক আয়তনের একটি জলাশয় দেখিয়ে বলেন, এটি ফুল মিয়া তার ছেলেদের নিয়ে দখল করে রেখেছেন। পাশের বিলে তাদের এককুনি জমি চাষ করতে দিচ্ছে না। তার দাবি, এ নিয়ে সালিশ বৈঠকে হওয়া রায় মেনে না নিয়ে তার স্বামী ও সন্তানদের ফাঁসাতে ফুল মিয়ার ছেলেরা খুনের ঘটনা ঘটিয়েছে। তিনি জানান, যে সময় রাব্বী নিখোঁজ হয় তখন তার ছেলে মানিক থানায় গিয়েছিলেন জিডি প্রত্যাহার করতে। আরেক ছেলে গিয়েছিলেন এক আত্মীয়ের পাত্রী দেখতে। রাব্বীর আপন দাদা কুতুব মিয়া বলেন, আল্লাহ জানে কে খুন করেছে। আমি তাদের নাম দিয়েছি সন্দেহমূলকভাবে। জায়গা-সম্পত্তি নিয়ে তাদের ৩ বাড়ির মধ্যে বিরোধ থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেন এ বৃদ্ধ। কুতুব মিয়া আর ফুল মিয়া থাকেন বাড়ির দক্ষিণ খণ্ডে। আর মেঝো ভাই সোনা মিয়া উত্তর পাশের খণ্ডে। সোনা মিয়ার বাড়ির উত্তরে বিশাল পুকুর। যেটিতে পাওয়া গেছে রাব্বীর লাশ। লাশের বস্তা পানিতে ডুবিয়ে দিতে যে ৫টি ইট ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলোও নেয়া হয়েছে সোনা মিয়ার বাড়ির সামনের ইটের স্তূপ থেকে। এটিকে ফাঁসানোর কৌশল হিসেবে মনে করা হচ্ছে। নাম প্রকাশ না করে মনাইবাড়ীর আশপাশের অনেকে বলেছেন, লাশ উদ্ধার হওয়ার পরই মিথিল-সাথিলেরা চিৎকার করে বলতে থাকে বাশার আর তার ছেলেরা খুন করেছে বলে। রাব্বির পিতা সজীবের চেয়ে তাদের আহাজারিই ছিল বেশি। সরজমিন খোঁজ নেয়ার সময় জানা যায়, ফুল মিয়ার বাড়ির বাইরের সীমানায় গোয়ালঘর লাগোয়া একটি কক্ষ রাব্বী নিখোঁজ হওয়ার পর দিনভর তালাবদ্ধ ছিল। ধারণা করা হচ্ছে, রাব্বীকে উঠোন থেকে ধরে নিয়ে ওই ঘরটিতে প্রথমে আটকে রাখা হয়। রাব্বী হত্যা ঘটনায় পুলিশ এ পর্যন্ত ৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এর মধ্যে লাশ উদ্ধারের সময় আটক মীর আবুল বাশারকে থানায় নিয়ে যাওয়ার পরপরই তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। পরে স্থানীয় লোকজনের জিম্মায় তাকে পুলিশ মুক্তি দিলে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। তার দুই ছেলে আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে এমবিএ অধ্যয়নরত মানিক, আরেক ছেলে সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির এলএলবি’র ছাত্র রতন জেলহাজতে রয়েছেন। এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আকুল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, যতটুকু মনে হচ্ছে জমিজমা নিয়ে বিরোধের কারণেই এ খুনের ঘটনা হয়ে থাকতে পারে। আর ঘাতকরা ৩ ফ্যামিলির মধ্যে রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.