মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত তালিকা যেন হয় by মো: মোস্তাফিজুর রহমান

সম্প্রতি মুক্তিযোদ্ধাবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধে ভূমিকা পালনকারী বীর ও বীরাঙ্গনাদের প্রকৃত তালিকা প্রকাশের ঘোষণা দিয়েছেন। দেশের সর্বশ্রেণীর জনগণ তার এ মহতী উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে। যদিও স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করা হয়েছে, কিন্তু প্রতিবারই তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। যেন কিয়ামত পর্যন্তও তা সঠিক ও যথার্থ হবে কি না, সন্দেহ রয়েছে। সে হিসেবে বর্তমান মন্ত্রী মহোদয়ের প্রণীত তালিকাও কি প্রশ্নাতীত হবে? হ্যাঁ, হতেই পারে; যদিও তিনি সমসাময়িক লেখক-গবেষকদের উদ্ধৃতি ও মতামতের ভিত্তিতেই তা প্রণয়ন করেন। এখানে অতি সংক্ষেপে উল্লিখিত ব্যক্তিদের বক্তব্য ও মতামত হুবহু উল্লেখ করছি, যেন এর আলোকে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত তালিকা প্রণয়ন করা হয়।
১৯৭১-এর ২৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি বক্তব্য মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত তালিকা প্রসঙ্গে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে। লেখক কামাল হোসেন তা হুবহু উল্লেখ করেছেন এভাবে, ‘তিনি বলেন, সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালী ঐক্যবদ্ধভাবে যে আন্দোলন শুরু করেছে, দেশমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত তা থামবে না। একজন বাঙ্গালীও জীবিত থাকা পর্যন্ত এ সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। বাঙ্গাালীরা শান্তিপূর্ণভাবে সে অধিকার আদায়ের জন্য চরম ত্যাগ স্বীকারেও তারা প্রস্তুত।’ ( কামাল হোসেন, ‘তাজউদ্দিন আহমদ বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং তারপর’, পৃষ্ঠা ২৪৫)।
মুক্তিযুদ্ধের অগ্রনায়ক তাজউদ্দীন আহমদের বক্তব্য থেকেও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত তালিকা স্পষ্ট হয়। লেখক মুহম্মদ নুরুল কাদির উদ্ধৃত করেছেন, ‘ঐ সময়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ এক ভাষণে বলেন, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রত্যেকেই মুক্তিযোদ্ধা এবং মাতৃভুমির প্রতি ইঞ্চি পবিত্র ভূমি উদ্ধারে তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’ ( মুহম্মদ নুরুল কাদির, দু’শ ছেষট্টি দিনে স্বাধীনতা, পৃষ্ঠা ৩০৭)।
রাশেদ খান মেননও তার গ্রন্থে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন, ‘দেশের মানুষের কার্যত সকল অংশই মুক্তিযুদ্ধে শরিক হয়েছিল। ক্যান্টনমেন্টের বিদ্রোহী সেনাবাহিনী, বিডিআর, পুলিশ থেকে একজন সাধারণ কৃষক পর্যন্ত কেউই বাদ থাকেনি এই মুক্তিযুদ্ধে।’ ( রাশেদ খান মেনন, রাজনীতির কথকতা, পৃষ্ঠা ১৫)।
মেজর জেনারেল (অব:) এম এ মতিন বীর প্রতীক উল্লেখ করেছেন, ‘এ দেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল এক মহত্তর ও পবিত্র জাতীয় সংগ্রাম। কোনো দলীয় কর্মী হিসেবে কোনো মুক্তিযোদ্ধা যেমন যুদ্ধক্ষেত্রে যাননি, তেমনি তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে যাননি কোনো গোষ্ঠী বা দলীয় স্বার্থরক্ষা তথা কোনো দলীয় আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে অর্জিত বিজয় এ জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ফসল তাই সমগ্র জাতির; মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যে বিজয়মাল্য আমরা ছিনিয়ে এনেছি, তা দেশমাতৃকারÑ এ বিষয়ে বিতর্কের বিন্দুমাত্র অবকাশ আছে বলে আমি মনে করি না।’ (মেজর জেনারেল (অব:) এম এ মতিন বীর প্রতীক, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারাবাহিকতা এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথা, পৃষ্ঠা ৭১)।
মুক্তিযোদ্ধা মতিয়ুর রহমান রেন্টু উল্লেখ করেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের মাত্র নয় মাসের মাথায় ভারতের সাথে পাকিস্তানের যুদ্ধ বেধে গেল। এক দিকে মুক্তিযোদ্ধা-জনগণ মিলে সাড়ে সাত কোটি মুক্তিবাহিনী, তার সাথে যোগ হলো ভারতীয় সেনাবাহিনী। মুক্তিবাহিনী আর ভারতীয় বাহিনী মিলেমিশে হলো মিত্রবাহিনী। ৬ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী সাঁড়াশি আক্রমণ শুরু করল। নির্বাসনে আসা দিশেহারা পাক হানাদার বাহিনী মাত্র দশ দিনের মাথায় ১৬ ডিসেম্বরে অসহায়ের মতো পরাজয় বরণ করলো।’ ( মুক্তিযোদ্ধা মতিয়ুর রহমান রেন্টু, আমার ফাঁসি চাই, পৃষ্ঠা ২৪)।
ইতিহাস গবেষক অধ্যাপক মুনতাসির মামুন উল্লেখ করেছেন,‘স্বাধীনতা কারো দান নয়, অশেষ আত্মত্যাগের বিনিময়ে তা অর্জিত এবং গুটিকয়েক মুক্তিযোদ্ধা, দেশত্যাগীর নয়, মুক্তিযুদ্ধ ছিল গোটা বাংলাদেশের আপামর বাঙ্গালীর।’ ( মুনতাসির মামুন, মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১, পৃষ্ঠা ১০১)।
অধ্যাপক আব্দুল গফুর উল্লেখ করেছেন, ‘একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ। আর এ যুদ্ধে অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করেছে তারা ছাড়াও প্রায় নয় কোটি মানুষ সবাই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নানা পর্যায়ে এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। কেউ খাবার দিয়ে, কেউ আশ্রয় দিয়ে, কেউ অর্থ দিয়ে, কেউ অস্ত্র দিয়ে, কেউ পরামর্শ দিয়ে, কেউ শত্রুর অবস্থান সম্পর্কে গোপন খবরাদি সরবরাহ করে এ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছে।’ ( অধ্যাপক আব্দুল গফুর, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম, পৃষ্ঠা ২০৩)।
অধ্যাপক আবু সাইয়িদ উল্লেখ করেছেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ। জনগণের যুদ্ধ। দেশপ্রেমিক প্রতিটি বাঙ্গালী এই যুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। এটা শুধুমাত্র এককভাবে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে অন্য একটি সামরিক বাহিনীর যুদ্ধ ছিল না।’ ( অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, মুক্তিযুদ্ধ : উপেক্ষিত গেরিলা, পৃষ্ঠা ৬৩)।
লেখক আতিউর রহমান উল্লেখ করেছেন, ‘সকল অর্থেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জনযুদ্ধ। খেটে-খাওয়া সাধারণ কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্ত, ছাত্র-জনতা সবাই একাত্তরে যুদ্ধে নেমেছিলেন মৌলিক কিছু আকাক্সা বুকে নিয়ে।’ (আতিউর রহমান, মুক্তিযুদ্ধের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন, পৃষ্ঠা ১৫৪)।
লেখিকা পপি চৌধুরী উল্লেখ করেছেন, ‘আমি যুদ্ধ দেখেছি, বিজয় দেখেছি। বাংলাদেশের সে স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ।’ ( পপি চৌধুরী, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা, পৃষ্ঠা ৪৮)।
এখানে বঙ্গবন্ধুসহ সব মুক্তিযোদ্ধা ও লেখকের বক্তব্যে বা উদ্ধৃতিতে স্পষ্টভাবে ১৯৭১ এর তৎকালীন সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীকেই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। ওই সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর মধ্যেই রয়েছেন ত্রিশ লাখ শহীদ ও দুই লাখ সম্ভ্রমহারা মা-বোন। এ বত্রিশ লাখ আত্মত্যাগী কি মুক্তিযোদ্ধা নন? একইভাবে বঙ্গবন্ধু ও মওলানা ভাসানীর মতো লাখ লাখ বাঙালি যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তান ও ভারতে অসহায় ও আবদ্ধ ছিলেন। এ যুদ্ধে জীবন দিয়েছেন অনেক ভারতীয় সেনা সদস্য। সমসাময়িক ভারতীয় প্রচার অনুযায়ী প্রায় এক কোটি বাঙালি ভারতে শরণার্থী হয়ে মানবেতর জীবন কাটিয়েছেন। এরাও কি মুক্তিযোদ্ধা নন? এমনিভাবে উপরিউক্ত উদ্ধৃতি অনুযায়ী, যুদ্ধ চলাকালে দেশে অবস্থানকারী আপামর জনতাই যে যেভাবে পেরেছে ভূমিকা পালন করেছে। এমনকি নারী-শিশু-বৃদ্ধ ও কয়েদিসহ সবাই যুদ্ধকালীন অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করে এ যুদ্ধে নিজেদের অবদানের স্বাক্ষর রেখেছেন। এসব শ্রেণীর মধ্যে কোনো শ্রেণীকে কি মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে বাদ দেয়া যায়? কখনো নয়। এদেরকে বাদ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা তালিকা করা হলে সঠিক হবে না।

No comments

Powered by Blogger.