লতিফ সিদ্দিকীর ভুল সিদ্ধান্ত: কাফফারা কে দেবে? by মোহাম্মদ রেজাউল করিম

পাট রপ্তানি বন্ধ রাখার একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তৎকালীন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। তাঁর নির্দেশে ২০০৯ সালের ৭ ডিসেম্বর এক প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে কাঁচা পাট রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কাঁচা পাট ব্যবসায়ী ও রপ্তানিকারকদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএ) সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ব্যতিরেকে স্বার্থান্বেষী মহলের প্ররোচনায় তিনি এই সিদ্ধান্ত নেন। শুধু তা-ই নয়, একই প্রজ্ঞাপনে রপ্তানির লক্ষ্যে বন্দরে আনা কিন্তু এখনো জাহাজীকরণ হয়নি, এরূপ পাটও (কাঁচা ও পাকা বেল) নিষেধাজ্ঞার আওতাভুক্ত করা হয়েছে।
আকস্মিকভাবে এই প্রজ্ঞাপনটি ছিল পাট রপ্তানিকারক তথা আমদানিকারক দেশগুলোর ক্রেতাদের কাছে বিনা মেঘে বজ্রপাতের শামিল। কেননা, কাঁচা পাট ব্যবসায়ী ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএ) সঙ্গে কোনো রকম আলাপ-আলোচনা ছাড়া বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের এই হঠকারী সিদ্ধান্ত তাদের হতবাক করেছে। যে সংগঠনের সদস্য ব্যবসায়ী ও রপ্তানিকারকেরা অভ্যন্তরীণ পাটকলগুলোর চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে পাট রপ্তানি করে হাজার কোটি টাকার ওপর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে থাকে, এমনকি রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা জারির আগে ২০০৯ সালের জুলাই-নভেম্বর সময়ে বিশ্বের ২০টি দেশে আট লাখ ৭৭ হাজার বেল কাঁচা পাট রপ্তানি করে ৫২৯ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছে, সে সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে এ ব্যাপারে একটিবারের জন্যও আলাপ-আলোচনা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী। পাট ব্যবসায়ীরা প্রতিবছর মৌসুমের শুরুতে কৃষকদের কাছ থেকে উপযুক্ত দাম দিয়ে লাখ লাখ মণ কাঁচা পাট কিনে থাকেন, যখন সরকারি-বেসরকারি পাটকলগুলো পাট কেনায় এগিয়ে আসতে পারে না।
এ রকম একটি হঠকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল আজ থেকে ৩০ বছর আগে, যার খেসারত আমরা এখনো দিয়ে যাচ্ছি। ১৯৮৪ সালের ১৯ অক্টোবর বিজেএর সঙ্গে কোনো আলাপ-আলোচনা ছাড়া হঠাৎ পাট রপ্তানি বন্ধ করা হয়। তখন কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল বন্যার দরুন পাটের উৎপাদন হ্রাসের কথা। কিন্তু বছর শেষে দেখা যায়, প্রায় ১০ লাখ বেল পাট উদ্বৃত্ত রয়েছে। সেই সময় পাট রপ্তানি বন্ধের ফলে ডান্ডিসহ বিশ্বের বহু জুট মিল পাটের অভাবে বন্ধ হয়ে যায় এবং পরবর্তী সময়ে সিনথেটিকের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এ-দেশীয় পাট ব্যবসায়ী ও রপ্তানিকারকদের অনেকে কোটি কোটি টাকা লোকসান দিয়ে অনেকে দেউলিয়া হয়ে যান, অনেকে ব্যাংকের দেনায় জর্জরিত হয়ে পথে বসে পড়েন। কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত পাট ব্যবসায়ী ও রপ্তানিকারকদের চূড়ান্তভাবে সাহায্য বা সহযোগিতা কোনো সরকারের আমলেই পাওয়া যায়নি।
২৫ বছর পর আবারও সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল ২০০৯ সালে। এর ফলে পাট রপ্তানিকারকদের আর্থিক ক্ষতিসহ সব দায়দায়িত্ব কি তৎকালীন পাটমন্ত্রীর ওপর বর্তায় না? যিনি আমাদের বলেছেন, এ সিদ্ধান্ত তিনি নিজ দায়িত্বে নিয়েছেন এবং প্রধানমন্ত্রীর কোনো অনুমোদন নেননি। তাহলে প্রশ্ন হলো, যে দোহাই দিয়ে তিনি পাট রপ্তানি বন্ধের নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন, তা কোন তথ্যের ভিত্তিতে? বলা হয়েছে কাঁচা পাটের সরবরাহ নিশ্চিত করতে। ২০০৯ সালের ৭ ডিসেম্বর প্রজ্ঞাপন জারি করা হয় একটি জাতীয় দৈনিকে বিজেএমসির এক কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে, যাতে বলা হয়েছে, দেশে পাট উৎপাদন এ বছর ৫৫ লাখ বেল হয়েছে। তাহলে উৎপাদন হ্রাস কোথায় হলো? বিজেএর সূত্রমতে, ২০০৮-২০০৯ মৌসুমে উদ্বৃত্ত পাট আনুমানিক সাত লাখ বেল, ২০০৯-১০ মৌসুমের পাট উৎপাদন ৫৭ লাখ বেল, মোট সম্ভাব্য প্রাপ্যতা ৬৪ লাখ বেল, মোট অভ্যন্তরীণ বাজারজাত এ পর্যন্ত ৩৮ লাখ বেল, মোট মজুত রয়েছে ২৬ লাখ বেল, জুট মিলের জন্য প্রয়োজন ১৬ লাখ বেল, অভ্যন্তরীণ গৃহস্থালি ব্যবহার দুই লাখ বেল, উদ্বৃত্ত থাকবে আট লাখ বেল। তাহলে পাট রপ্তানি বন্ধের যুক্তিই নেই।
কাঁচা পাট রপ্তানি বন্ধের কারণে বিশ্বের প্রধান প্রধান ক্রেতা ভারত, চীন, পাকিস্তানসহ অন্যান্য দেশে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে এবং ওই দেশের মিলগুলো সংগত কারণে বাংলাদেশের কাঁচা পাটের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলবে এবং পুনরায় সিনথেটিক বা অন্য বিকল্প কোনো পণ্যের দিকে ঝুঁকে পড়লে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই, এসব উল্লেখ করে ২০০৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর সামগ্রিক প্রতিক্রিয়া/ক্ষতি কী হবে, সব বিস্তারিত জানিয়ে বিজেএর পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে লিখিতভাবে অবহিত করা হয়। প্রধানমন্ত্রী এর বিরূপ ফলাফল জানতে পেরে কাঁচা পাট রপ্তানি বন্ধের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেন এবং নির্দেশে তিনি উল্লেখ করেন, ‘পাট রপ্তানি বন্ধ রাখার যুক্তি নাই। রপ্তানি শুরু করা যায়।’
কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সুস্পষ্ট নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও বিভিন্নভাবে টালবাহানা করে তৎকালীন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী কাদের স্বার্থ রক্ষার্থে নির্দেশ বাস্তবায়নে বিলম্ব করেন, জানা নেই। ২০১০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি তাঁর মন্ত্রণালয় থেকে জারীকৃত প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে কাঁচা পাট রপ্তানির ওপর ২০০৯ সালের ৭ ডিসেম্বর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। কাঁচা পাট রপ্তানি বন্ধের এ ভ্রান্ত সিদ্ধান্তে শতাধিক কাঁচা পাট ব্যবসায়ী ও রপ্তানিকারকের শত শত কোটি টাকা লোকসানের দায়দায়িত্ব কি তৎকালীন পাটমন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীর ওপর বর্তায় না?
বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী থাকা অবস্থায় লতিফ সিদ্দিকী আরও একটি মারাত্মক ক্ষতি করেছেন পাট ব্যবসায়ী ও রপ্তানিকারকদের তথা দেশ ও জাতির, তা হলো, নবম সংসদে তাঁর প্রস্তাবে ভুলভাবে আইন পাস হয়েছিল। ২০০৯ সালের ১২ অক্টোবর সংসদে ‘দ্য জুট’ (সংশোধন) বিল পাস করা হয়। ‘মণ’কে ‘কেজিতে’ রূপান্তরের জন্য ওই বিল আনা হয়। বিলে পাঁচ মণের পরিবর্তে ১৫০ কেজি করা হয়। বাস্তবে যা হওয়ার কথা ১৮২ দশমিক ২৫ কেজি। বিলটি পাসের পর নয় মাস গুদামে পাটের বেল বাঁধার কাজ বন্ধ থাকে। কারণ, বেল বাঁধার যন্ত্রগুলো পাঁচ মণের উপযোগী। এতে পাট রপ্তানি ও সরবরাহের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। অতঃপর ২০১০ সালের ৭ জুন নতুন করে বিল উত্থাপন হয় সংশোধনের জন্য, যা ১৩ জুলাই পাস হয়।
লতিফ সিদ্দিকীর এ খামখেয়ালিপনা ও একগুঁয়েমি মনোভাবের দরুন এবং ভ্রান্ত সিদ্ধান্তের কারণে পাট ব্যবসায়ী ও রপ্তানিকারকদের শত শত কোটি টাকা লোকসানের দায়ভার কে নেবে? শুধু তা-ই নয়, দেশও বঞ্চিত হয়েছে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন থেকে।
মোহাম্মদ রেজাউল করিম: সাবেক চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশন (বিজেএ) ও চেয়ারম্যান, শিপার্স কাউন্সিল অব বাংলাদেশ।
SN_JUTE@HOTMAIL.COM

No comments

Powered by Blogger.