নৌ রুটে মানব পাচার ভয়াবহ রূপ নিয়েছে- থাইল্যান্ড উপকূলে নিয়ে মুক্তিপণ আদায়ে নিষ্ঠুর নির্যাতন by জি এ এম আশেক উল্লাহ

‘বাংলাদেশ-থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়া’ নৌ রুটে মানব পাচার ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। কোনো কিছুতেই এই রুটে মানব পাচার প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। পাচারকাজে যুক্ত হয়েছে আন্তর্জাতিক শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেট বিনা খরচে মালয়েশিয়া গমনের প্রলোভন দেখিয়ে থাইল্যান্ড উপকূলে নিয়ে মুক্তিপণ আদায় করতে চালায় নির্মম নির্যাতন। নির্যাতনে অনেকের মৃত্যু হয়েছে এবং নিখোঁজ রয়েছেন অসংখ্য। কক্সবাজার জেলার প্রায় ২০০ যুবকের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। তা ছাড়া নিখোঁজ রয়েছেন অসংখ্য রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ। পাচার রোধে কক্সবাজার জেলা পুলিশ উপকূলে বেশ কয়েকটি অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করেছে। এ দিকে বিজিবি ও কোস্টগার্ডের সতর্ক পাহারা সত্ত্বেও কক্সবাজার উপকূল দিয়ে মানব পাচারের ধুম পড়েছে। রোহিঙ্গা এবং কক্সবাজার জেলার বাসিন্দা ছাড়াও এখন দেশের প্রায় ১৯টি জেলার মানুষও পড়েছে দালাল চক্রের খপ্পরে। কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো: রুহুল আমীন বিষয়টি স্বীকার করে জানান, নানাভাবে চেষ্টা করেও মালয়েশিয়া যাত্রার এই তৎপরতা বন্ধ করা যাচ্ছে না। তিনি আরো জানান, উখিয়া টেকনাফের দুইটি শিবিরে ৩০ হাজার শরণার্থী ছাড়াও জেলার পাহাড়-জঙ্গলে অবৈধভাবে বসবাস করছে মিয়ানমারের প্রায় চার লাখের বেশি অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা। কাজের সন্ধানে অথবা প্রতারণার শিকার হয়ে দালালের মাধ্যমে রোহিঙ্গারা মালয়োশিয়ার উদ্দেশে সাগরে নেমে বিপদে পড়ছেন।

>> কক্সবাজার উপকূল থেকে নৌপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে থাইল্যান্ড কোস্টগার্ডের হাতে আটকের পর অমানুষিক নির্যাতনের শিকার এরা। সম্প্রতি ছবিটি তুলেছেন ইউএনএইচসিআর-এর এক কর্মী
প্রাপ্ত তথ্য মতে, বর্তমানে সাগর শান্ত হয়ে উঠছে। এই সুযোগে কক্সবাজার উপকূলের বিভিন্ন স্পট থেকে সাগরপথে বিনা খরচে পাড়ি জমানোর কথা বলায় স্বপ্নের মালয়েশিয়া যাত্রায় যেন ঢল নেমেছে। তথ্য মতে, এখন দালালদের সাথে যুক্ত হয়েছে আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারী চক্র। তারা একেবারে বিনা খরচ অর্থাৎ মালয়েশিয়া পৌঁছে কাজ করে টাকা পরিশোধের সুবিধা দেয়ার কথা বলে লোকজন সংগ্রহ করছে। তাদের টার্গেট গরিব মানুষ। বিশেষ করে কক্সবাজার জেলায় অবৈধভাবে বসবাসকারী রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ। রোহিঙ্গা অবিবাহিত নারীদের বিয়ের মিথ্যা প্রলোভন দিয়ে তোলা হচ্ছে ট্রলারে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দালালেরা লোকজনকে ট্রলারে তুলে মালয়েশিয়ার কথা বলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে থাইল্যান্ড উপকূলে। সেখানে থাইল্যান্ডের কোস্টগার্ডের সহযোগিতায় মুক্তিপণ দাবি করা হচ্ছে জনপ্রতি দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা। তারপর মুক্তিপণ আদায়ে চলে নির্মম ও অমানবিক নির্যাতন। কক্সবাজারের জাতিসঙ্ঘের উদ্বাস্তু বিষয়ক হাইকমিশনের এক কর্মকর্তা থাইল্যান্ড সফরকালে তার ক্যামেরায় ভয়াবহ নির্যাতনের চিত্র ধারণ করেন। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, থাই উপকূলের কাছে গেলেই এখন শুধুই ভয়ার্ত মানুষের কান্নার শব্দ শোনা যায়। থাইল্যান্ড উপকূলে শত শত মানুষকে তপ্ত বালির ওপর শুইয়ে রেখে মুক্তিপণ আদায়ে নির্যাতন করা হয়। খাবার পানি কিংবা ওষুধ কিছুই দেয়া হয় না। মোবাইলে নির্যাতনের শব্দ শুনানো হয় বাংলাদেশে আত্মীয়স্বজনকে। নির্যাতন সইতে না পেরে তারা আকুতি জানান বাড়িঘর বিক্রি করে হলেও সংশ্লিষ্ট দালালের হাতে মুক্তিপণের টাকা তুলে দিতে। এভাবে চাওয়া টাকা দেশে দালাল নিয়োজিত প্রতিনিধির হাতে দিলেই কেবল মুক্তি মেলে নির্যাতন থেকে এবং শুরু হয় মালয়েশিয়ার উদ্দেশে যাত্রা। অপর দিকে যারা মুক্তিপণের টাকা দিতে পারেন না তাদের অনেকেরই নির্যাতনে মৃত্যু ঘটে। আবার কাউকে কাউকে বিক্রি করা হয় অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পাচারকারীদের কাছে।
এই ভয়াবহ নির্যাতন ও সমূহ বিপদের খবর জানা সত্ত্বেও নৌ পথে স্বপ্নের মালয়েশিয়া যাত্রা থামছে না। এসব কারণে সাগরপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়াগামী যাত্রীদের নিখোঁজের তালিকা দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে। মালয়েশিয়ায় যাত্রা করে কয়েক বছর ধরে নিখোঁজ রয়েছেন জেলার প্রায় ২০০ যুবক। ধারণা করা হচ্ছে তাদের বেশির ভাগই বেঁচে নেই। হয় দালালদের হাতে মৃত্যু হয়েছে, না হয় মুক্তিপণ আদায়কারীরা তাদের হত্যা করেছে। বিভিন্ন দেশের কারাগারে অনেকেই আটক থাকলেও কোনো খবর পাচ্ছেন না তাদের পরিবার। মহেশখালীর শাপলাপুরের খুরশিদা বেগম জানান, তার দুই ছেলে শওকত আলী ও রমজান আলী দীর্ঘ দুই বছর ধরে নিখোঁজ। চকরিয়া উপজেলার ঢেমুশিয়া ইউনিয়নের শাকিলা বেগম জানান, তার ছেলে জয়নাল থাইল্যান্ডের একটি কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে এক বছর পর দেশে ফিরেছে। জয়নাল জানান, ১৯০ জন যাত্রী নিয়ে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে যাত্রা করে সবাইকে থাইল্যান্ড উপকূলে নিয়ে যাওয়া হয়। এর আগে ট্রলারে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ৯ জনের মৃত্যু হয়। তাদের লাশ ভাসিয়ে দেয়া হয় সাগরে। পরে থাইল্যান্ড উপকূলে নিয়ে গিয়ে দাবি করা হয় মুক্তিপণের টাকা। অপারগ হলে তাদের হত্যা করার হুমকি দিয়ে শুরু হয় ব্যাপক নির্যাতন। তিনি জানান, আমরা ১৫ জন অজানা পথে পালাতে থাকলে কোস্টগার্ডের হাতে আটক হই এবং পরের ঠিকানা জেলখানায়। কক্সবাজার শহরতলির সমিতি পাড়ার আবদুর রহমান জানান, সাগর পথে মালয়েশিয়ার পথে যাত্রা করে থাইল্যান্ড উপকূলে টাকা দাবি করে দালালেরা। পরে দালালদের হাতে আমার পরিবারের সদস্যরা দুই লাখ ২০ হাজার টাকা দেয়ার পর আমার মুক্তি মেলে এবং দালালেরা আমাকে মালয়েশিয়া উপকূলে পে্যঁছে দেয়। মোবাইল ফোনে তিনি জানান, যারা টাকা দিতে পারেনি তাদের হত্যা করে লাশ সাগরে ফেলে দেয়া হয়েছে। থাইল্যান্ডে নির্যাতিত লোকজনের পরিবার যেন দ্রুত মুক্তিপণের টাকা পরিশোধ করে সে জন্য হত্যা করার আতঙ্ক সৃষ্টি করে। তিনি আরো জানান, প্রথমে কোনো টাকা দিতে হবে না জানিয়ে নৌকায় তুলে থাইল্যান্ডে এনে দাবি করা হয় আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা। পাচারকারীদের জিম্মিখানায় অসংখ্য বাংলাদেশী যুবক আটক আছে। পাচারকারীদের সাথে থাইল্যান্ডের পুলিশও জড়িত রয়েছে। তার ধারণা আদায়কৃত মুক্তিপণের অর্ধেক পায় থাই পুলিশ।
কক্সবাজার শহরের কস্তুরাঘাটের মোক্তার আহমদ জানান, তিনিও অবৈধভাবে মালয়েশিয়া গিয়েছিলেন। কোনো সুবিধা না পওয়ায় সম্প্রতি ফেরত এসেছেন। নৌ পথে থাইল্যান্ডের নৌ ও কোস্টগার্ড বাহিনীর হাতে আটক হন অনেকে। যারা ধরা পড়েন তাদের ওপর চলে নির্যাতন। থাই কোস্টগার্ড হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ইঞ্জিনবিহীন নৌকায় বাংলাদেশীদের তুলে সমুদ্রে ভাসিয়ে দেয়। সাগরে ভেসে থাকার পর এসব লোকজনের ভাগ্যে মৃত্যু ছাড়া কিছুই জোটে না। কক্সবাজারের রামু উপজেলার পূর্বদ্বীপ ফতেখাঁরকূল গ্রামের মোহাম্মদ হোসেনের ছেলে আশরাফুল জামান নির্যাতনের বিবরণ দিয়ে জানান, আমি নিশ্চিত মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছি। ২০১১ সালের ১ সেপ্টেম্বর সাগর পথে মালয়েশিয়ায় গিয়ে অনেক নির্যাতিত হই এবং প্রায় আড়াই বছর কারাভোগের পর সম্প্রতি দেশে ফিরতে সক্ষম হই। তিনি জানান, ‘টেকনাফের কচুবনিয়ার সাব্বির দালালের মাধ্যমে সাগর পথে আমি মালয়েশিয়ায় যাত্রা করি। কচুবনিয়া ঘাট দিয়ে প্রথমে ছোট্ট একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে আমাকে সাগরের মধ্যে নিয়ে বড় একটি ট্রলারে তোলা হয়। সেই ট্রলারে কাটে ১৩ দিন। ১৩ দিন ঠিকমতো খাবার-দাবার তো দূরের কথা, ঠিকমতো পানিও পাইনি। ১৩ দিন পর ১০৫ জনকে নিয়ে ট্রলারটি যাত্রা করে। এগার দিন পর মালয়েশিয়া উপকূলে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়ি। তার মতে মালয়েশিয়ার বিভিন্ন কারাগারে অসংখ্য বাংলাদেশী মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন।
কক্সবাজার সদর মডেল থানার পরিদর্শক (ওসি) মাহফুজুর রহমান জানান, পাচারকারীরা এখন দেশজুড়ে তাদের নেটওয়ার্ক বিস্তার করেছেন। এখন কক্সবাজারে যারা ধরা পড়ছে তারা বিভিন্ন এলাকার মানুষ। ৩ সেপ্টেম্বর হবিগঞ্জের মাগুরা এলাকার নয়জনকে পাচারের জন্য কক্সবাজারে নিয়ে আসে মাগুরা এলাকার সাগর বিশ্বাস। ৪ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের এক হোটেল থেকে তাদের পুলিশ গ্রেফতার করে। টেকনাফ ৪২ বিজিবি অধিনায়ক লে. কর্নেল মো: আবুজার আল জাহিদ জানান, বর্তমানে মিয়ানমারের তিনটি কারাগারে ২৮১ জন, থাইল্যান্ডের দুইটি কারাগারে ৩১৬ জন বাংলাদেশী রয়েছেন।
টেকনাফ থানার পরিদর্শক (ওসি) মোক্তার হোসেন বলেন, গত আট মাসে পুলিশ, বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীর সদস্যরা শুধু টেকনাফ উপকূল থেকেই ৫৩৩ যাত্রীকে আটক করেন। এ ব্যাপারে চার শতাধিক দালালের বিরুদ্ধে টেকনাফ থানায় ১২২টি মামলা করা হয়েছে। এ দিকে মালয়েশিয়ায় মানব পাচার ঠেকাতে কক্সবাজার পুলিশ ও বিজিবি পৃথকভাবে জোর তৎপরতা শুরু করেছে। গত কয়েক দিনে পুলিশ শতাধিক যাত্রীকে আটক করেছে। এ ছাড়া বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলায় পৃথক দুইটি তল্লাশি ফাঁড়ি স্থাপন করেছে। কক্সবাজার পুলিশ সুপার শ্যামল কুমার নাথ বলেন, মানব পাচার ঠেকাতে পুলিশ কয়েক দিন ধরে বিশেষ অভিযান শুরু করেছে। বিশেষ করে গডফাদারদের ব্যাপারে অনুসন্ধান চালানো হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, উত্তরাঞ্চলের অভাবী অনেক মানুষ জেনেশুনেই অবৈধ পথে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য নৌকায় উঠছেন। এ ব্যাপারে লোকজনকে সচেতন করতে পুলিশ সভা-সমাবেশ করছে। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তোফায়েল আহম্মেদ বলেন, গত পাঁচ দিনে পুলিশ জেলার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ১১৬ জনকে আটক করেছে।

No comments

Powered by Blogger.