মহাসড়কে একের পর এক ডাকাতি- হাইওয়ে পুলিশ প্রশ্নবিদ্ধ by গোলাম মর্তুজা

মহাসড়কের নিরাপত্তা দিতে পারছে না হাইওয়ে পুলিশ। পরিবহনব্যবসা-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, চাঁদা তোলা ছাড়া হাইওয়ে পুলিশের তেমন কোনো তৎপরতা চোখে পড়ে না। মহাসড়কে ডাকাতি-ছিনতাই ঘটনার প্রতিকারও মেলে না। তবে হাইওয়ে পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) আছাদুজ্জামান মিয়া মনে করেন, পর্যাপ্ত জনবল ও যানবাহনের অভাব এবং মামলা গ্রহণ ও তদন্তের এখতিয়ার না থাকায় হাইওয়ে পুলিশের সুফল সাধারণ মানুষ পাচ্ছে না। ৮০ শতাংশ কাজের ক্ষেত্রে হাইওয়ে পুলিশকে জেলা পুলিশের সহায়তা নিতে হয়। গত রোববার ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে সোহাগ পরিবহনের একটি বাসে ডাকাতির বীভৎসতা নিয়ে প্রথম আলোতে সরেজমিন প্রতিবেদন ছাপা হয়। এ ঘটনায়ও হাইওয়ে পুলিশের কোনো ভূমিকা ছিল না।

>>বনপাড়া–হাটিকুমরুল মহাসড়কের নাটোর অংশে স্পিডগান দিয়ে যানবাহনের গতি পরিমাপ করছে হাইওয়ে পুলিশ। গতকাল তোলা ছবি l প্রথম আলো
বাসমালিকেরা জানান, গত সাত দিনে শুধু ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের ফরিদপুর ও রাজবাড়ী অংশে ছয়টি ডাকাতি হয়েছে। বাস-ট্রাক মালিক সমিতির একজন নেতা গতকাল বলেন, গতকাল সমিতির নেতারা হাইওয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করে এসব বিষয়ে অভিযোগ করার আগ পর্যন্ত ওই কর্মকর্তারা কিছুই জানতেন না। পরিবহন-সংশ্লিষ্ট সব পক্ষই হাইওয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ করেছেন। তাঁরা বলছেন, মহাসড়কে চাঁদা নেওয়ার সময়ই কেবল হাইওয়ে পুলিশের দেখা মেলে। মহাসড়কগুলোতে তাদের ন্যূনতম নিয়ন্ত্রণ নেই।
মহাসড়কে মধ্যরাতে বিভীষিকা
সর্বশেষ গতকাল সন্ধ্যায় হাইওয়ে পুলিশের হয়রানির প্রতিবাদে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক আটকে রাখেন মাগুরার পরিবহনশ্রমিকেরা। তাঁদের অভিযোগ, চাঁদা না পেয়ে হাইওয়ে পুলিশ একটি পাটকাঠিবোঝাই ট্রাকের চালককে মারধর করেছে। বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও সোহাগ পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক তালুকদার গতকাল বলেন, ‘আপনারা (প্রথম আলো) একটা ঘটনার ওপর সরেজমিন প্রতিবেদন করে দেখিয়েছেন, ডাকাতির ঘটনাগুলো কী ভয়াবহ! গত সাত দিনে ওই পথে এ রকম ছয়টি ডাকাতি হয়েছে, যার খবর কেউ জানে না। সাত দিনে শুধু সোহাগ পরিবহনেরই দুটি বাসে ডাকাতি হয়েছে। ফরিদপুর ও রাজবাড়ী এলাকায় প্রায় প্রতি রাতেই ডাকাতি হচ্ছে। আমি জানি না, পুলিশ আসলে কী করছে!’
ফারুক তালুকদার বলেন, রোববার রাতে ওই আলোচিত বাস ডাকাতির পরে সোমবার একই পথের মধুখালী থানা এলাকায় আবারও গাছ ফেলে গাড়ি আটকানোর চেষ্টা করেছিল ডাকাতেরা। তবে কয়েকটি গাড়ি ওই গাছের ওপর দিয়েই চলে যেতে সক্ষম হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই এই এলাকা ডাকাতিপ্রবণ। ডাকাতির পর দু-চারজন ধরা পড়ে। কিছুদিন পর জামিনে বের হয়ে আবার ডাকাতি শুরু করে।
মধুখালীর ডাকাতির বিষয়ে হাইওয়ে পুলিশের ডিআইজি বলেন, প্রথম আলোর প্রতিবেদনেই উল্লেখ রয়েছে যে রোববারের ডাকাতির ঘটনাস্থল মধুখালী থানা থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে। থানার সঙ্গে সমন্বয় করে ওই এলাকার ৫৪ কিলোমিটার মহাসড়কে টহল দেয় হাইওয়ে পুলিশ। কিন্তু রোববার ডাকাতির ঘটনাটি ঘটেছে মধুখালী থানার টহল এলাকায়।
সোহাগ পরিবহনের একজন কর্মকর্তা বলেন, মধুখালীতে ডাকাতির পরদিন ফরিদপুরের পুলিশ সুপারের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ করেন। পুলিশ সুপার বলেন, ওটা তাঁদের নয়, হাইওয়ে পুলিশের বিষয়। আর হাইওয়ে পুলিশ বলছে, ঘটনাটি মধুখালী থানা থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে। তাই দায়ভার থানার।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সুপার জামিল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, এ রকম কোনো কথা সোহাগ পরিহনের কোনো কর্মকর্তাকে তিনি বলেননি। ওই ডাকাতির জন্য তিনি হাইওয়ে পুলিশকে দায়ী করে বলেন, হাইওয়েতে (মহাসড়ক) ঘটে যাওয়া ঘটনার দায় হাইওয়ে পুলিশ এড়াতে পারে না। তবে হাইওয়ে পুলিশের সঙ্গে কোনো সমন্বয়হীনতা নেই বলে দাবি করেন তিনি।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বলেন, থানা পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ, ট্রাফিক পুলিশ, ডিবি পুলিশ মহাসড়কে প্রায়ই চেকপোস্ট বসায়। তল্লাশির নামে হয়রানি করে। পরিবহনশ্রমিকেরা বলছেন ঢাকার চারটি প্রবেশমুখে চেকপোস্ট বসাতে। আর প্রতিটি গাড়ি তল্লাশির পর একটা স্লিপ দিতে, যাতে পরে কোথাও সেটি দেখিয়ে সময় বাঁচানো যায়।
মহাসড়কের নিরাপত্তা নিয়ে অসন্তুষ্ট এই শ্রমিকনেতা বলেন, হাইওয়ে পুলিশ একেবারেই কম। নির্দিষ্ট এলাকায় তারা থাকে। এর বাইরে ডাকাতির ঘটনাগুলো ঘটে। আর ডাকাতির পরে শ্রমিকেরা, বিশেষ করে ট্রাকচালক ও সহকারীরা পুলিশের কাছে অভিযোগ করে না। অনেক ক্ষেত্রেই ডাকাতির সময় ট্রাকচালক ও সহকারীকে মেরে ফেলে ডাকাতেরা। আর ডাকাতির পরে তাঁরা বেঁচে থাকলে পুলিশের হাত থেকে নিস্তার পায় না। তারা জড়িত থাকুক বা না থাকুক, পুলিশ আগে তাঁদের গ্রেপ্তার করে হয়রানি করে।
নেই আর নেই: হাইওয়ে পুলিশের ব্যর্থতার জন্য নয় বছর ধরেই লোকবল, যন্ত্রপাতি আর ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার দোহাই দিয়ে যাচ্ছেন এর কর্মকর্তারা। গতকাল হাইওয়ে পুলিশের ডিআইজির কাছে গেলে তিনিও একই সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরেন। ডিআইজি বলেন, সারা দেশে ১০ হাজার কিলোমিটার মহাসড়ক পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব হাইওয়ে পুলিশের। এ জন্য মোট লোকবল দুই হাজার। অভিযানে ব্যবহারের জন্য গাড়ি আছে মাত্র ৭২টি। আবার হাইওয়ে পুলিশের মামলা গ্রহণ ও তদন্তের এখতিয়ারও নেই। মহাসড়কের বাইরে হাইওয়ে পুলিশের গ্রেপ্তার করারও এখতিয়ার নেই। মহাসড়কের পাশের গ্রাম থেকে আসামি ধরতে হলেও জেলা পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করতে হয়। এ কারণে অনেক ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর হাইওয়ে পুলিশ আসামিদের গ্রেপ্তারে উদ্যোগ নিতে পারে না।
তবে ডিআইজির দাবি, হাইওয়ে পুলিশের তৎপরতার কারণে মহাসড়কে ডাকাতি নেই বললেই চলে। মহাসড়কে যানজটও অনেকে কমেছে, ঈদের সময় যানজট সহনীয় হয়েছে। তবে অতি সম্প্রতি ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে কয়েকটি ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনাগুলোকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে হাইওয়ে পুলিশ। সংশ্লিষ্ট জেলা পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ শুরু হয়ে গেছে।
চাঁদাবাজির অভিযোগ প্রসঙ্গে ডিআইজি বলেন, ‘হাইওয়েতে চাঁদাবাজি হয় না, আমি তা বলব না। তবে এটা নিয়ন্ত্রিত। চাঁদাবাজি বন্ধ করতে গত কোরবানি ঈদের সময় পশুবাহী ট্রাক থামানো পর্যন্ত নিষেধ করে দেওয়া হয়েছিল। ঈদের সময় সুনির্দিষ্ট তথ্য ছাড়া ঢালাও তল্লাশিও নিষেধ ছিল।’

No comments

Powered by Blogger.