অটোরিকশা চলে চালকের ইচ্ছায় by সামছুর রহমান

যে শহরের গণপরিবহনব্যবস্থা যত ভালো ও সুশৃঙ্খল, সে শহর তত বেশি নাগরিকবান্ধব, বাসযোগ্য। সে বিচারে রাজধানী ঢাকার অবস্থা কী? গণপরিবহনের ওপর নির্ভর করে ঢাকায় যাতায়াত যে কী যন্ত্রণার, তা কেবল ভুক্তভোগীরা বলতে পারেন। ঢাকার গণপরিবহন নিয়ে আয়োজনে আজ থাকছে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় যাত্রীদের ভোগান্তি
শাহবাগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সামনে ক্রাচে ভর দিয়ে থাকা ষাটোর্ধ্ব রুহুল আমিন বারবার হাতের ইশারায় সিএনজিচালিত অটোরিকশা থামাচ্ছিলেন। উদ্দেশ্য, সানারপাড়ে বাসায় ফিরবেন। কিন্তু আধা ঘণ্টায়ও অটোরিকশা পাননি। বেশির ভাগ চালকই যেতে চাননি। দু-একজন যেতে রাজি হলেও ভাড়া চেয়েছেন ৩৫০ টাকা। অথচ বাসা থেকে এই হাসপাতাল পর্যন্ত অটোরিকশাতেই এসেছেন ২৫০ টাকায়। ভাঙা পায়ের জন্য চিকিৎসক দেখিয়ে ফেরার সময় পড়তে হলো বিড়ম্বনায়। সেখানে তাঁর মতো ভোগান্তিতে পড়া আরও কয়েকজনকে দেখা গেল অটোরিকশা পেতে গলদঘর্ম হয়ে ছোটাছুটি করতে। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলের চিত্র এটি।
রাজধানীজুড়েই চলছে অটোরিকশার এই নৈরাজ্য, ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায়। গন্তব্যে যাওয়া না-যাওয়া নির্ভর করে চালকদের ইচ্ছায়। অর্থাৎ এই যানের চালকদের কাছে যাত্রীরা এখন পুরো জিম্মি। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে, সানারপাড় থেকে শাহবাগের দূরত্ব ১৪ দশমিক ৭ কিলোমিটার। সরকার-নির্ধারিত ভাড়ায় চললে এই পথের ভাড়া হবে ১২৩ টাকা। যানজট ধরলে তা ১৫০ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। অটোরিকশা না পেয়ে আক্ষেপ করে রুহুল আমিন বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ বাবা। ডাক্তারের কাছে যাতায়াতেই এতো টাকা লাগলে ওষুধ কিনমু কেমনে?’
গতকাল সকাল নয়টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত টেকনিক্যাল মোড়, কল্যাণপুর, মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, ফার্মগেট ও শাহবাগ এলাকায় অবস্থান করে রাজধানীর অন্যতম গণপরিবহন অটোরিকশায় যাত্রী ভোগান্তির চিত্র দেখা যায়। এ সময় অনেক যাত্রী এবং ৫০ জন অটোরিকশাচালকের সঙ্গে কথাও হয়। চালকেরা সবাই জানান, তাঁরা মিটারে নয়, চুক্তিতে চলেন এবং যাত্রীদের ইচ্ছায় নয়, তাঁদের ইচ্ছায় যাত্রী বহন করেন। অথচ এই বাহনের নীতিমালা অনুযায়ী, এটি মিটারে ওঠা ভাড়ায় যাত্রীর ইচ্ছায় গন্তব্যে যেতে বাধ্য। এখন অবস্থা উল্টো।
সকাল সাড়ে নয়টায় টেকনিক্যাল মোড়ের কাছে এশিয়া হলের সামনে ২৫-৩০টি অটোরিকশা দাঁড়ানো ছিল। সেখানে এবং তার উল্টো পাশে দূরপাল্লার বাস এসে যাত্রা শেষ করে। ফলে সব সময়ই সেখানে যাত্রী মেলে। অথচ আধা ঘণ্টায় দেখা গেল, যাত্রী নিয়ে দু-তিনটি অটোরিকশা ওই স্থান ছেড়েছে।

>>সিএনজিচালিত অটোরিকশার এই চালকের শরীরী ভাষা আর রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীদের মুখাবয়বই বলে দিচ্ছে, রাস্তায় নেমে মানুষ কী দুঃসহ অবস্থায় পড়ে। গতকাল বিকেলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অসুস্থ দাদাকে নিয়ে বের হয়ে চরম বিড়ম্বনায় পড়েন এই তরুণী। মিটারেও যাবেন না এই চালক। ভাড়াও হাঁকছেন ইচ্ছেমতো l ছবি: সাহাদাত পারভেজ
পরিবারের সদস্য এবং ব্যাগ নিয়ে ঢাকায় আসা যাত্রীরা অপেক্ষায়। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, অটোরিকশাচালকেরা বেকায়দায় পেয়ে গলাকাটা ভাড়া চাইছেন। নগরের সব বাস টার্মিনাল, রেলস্টেশন ও সদরঘাটে এ চিত্র নিত্যদিনের।
ঝিনাইদহ থেকে একটি বাসে টেকনিক্যালে নেমে এমন বেকায়দায় পড়েন হাবিবুর রহমান। তিনি বললেন, গন্তব্যের কথা বললে অনেক চালক কথাই বলছেন না। যে দু-একজন কথা বলছেন, তাঁরা মিটারে যেতে বললে হাসেন, পাগল ভাবেন। বাসাবো যেতে ৪৫০ টাকা চাইছেন।
অথচ অটোরিকশার জন্য সরকার প্রথম দুই কিলোমিটারের ভাড়া ঠিক করে দিয়েছে ২৫ টাকা। পরবর্তী প্রতি কিলোমিটারের জন্য সাত টাকা ৭৪ পয়সা। প্রতি মিনিট যাত্রাবিরতি এক টাকা ৪০ পয়সা।
‘প্রাইভেট’ লেখা অটোরিকশাও ভাড়ায় চলছে। নির্ধারিত সবুজ রঙের অটোরিকশার বেশির ভাগেরই মিটার আছে। তবে এর বেশির ভাগই বিকল। যেগুলো সচল, সেগুলোও কাজে লাগে না। কারণ, যাত্রী বহন করা হয় চুক্তিতে। তবে অটোরিকশায় ওঠার পর চালকের আবদার শুনতে হয়, ‘ভাই, ট্রাফিক ধরলে বইলেন মিটারে যাইতাছি।’ বাধ্য হয়ে অনেক যাত্রীকে এমন ডাহা মিথ্যাও বলতে হয়।
বেলা একটায় মিরপুর ১০ নম্বরে দেখা গেল এক অটোরিকশাচালক ও যাত্রীর মধ্যে তুমুল বিতণ্ডা। সূত্রপাত ভাড়া হাঁকা নিয়ে। চালক মতিঝিলের ভাড়া চাইলেন ২৫০ টাকা। তাঁর যুক্তি, ‘জ্যাম ঠেইল্যা যাইতে লাগব দেড়-দুই ঘণ্টা। মিটারে গেলে উঠতো ১৮০-২০০ টাকা। ৫০ টাকা বেশি না নিলে ক্যামনে চলবো।’ ফলে যাত্রীকে যেতে হলো অন্য অটোরিকশার আশায়।
ধানমন্ডিতে সিটি কলেজের সামনে অনেকক্ষণ অটোরিকশার অপেক্ষায় ছিলেন ব্যবসায়ী ইকবাল আহমেদ। যাবেন বারিধারা ডিওএইচএসে। অটোরিকশা দাঁড় করালেও সবার জবাব—যাবেন না। এক চালক রাজি হলেও ভাড়া চাইলেন ৪০০ টাকা। ইকবাল বলেন, ‘চালকেরা আগে জানতে চাইত, মিটারে যাবেন, নাকি ভাড়ায়? কিন্তু এখন যেতেই চায় না। ভাড়া চাইছে ইচ্ছামতো। আসলে পাবলিকের দুর্ভোগ দেখার কেউ নাই।’

>>দূরত্ব অনুযায়ী ভাড়া নির্ধারণের জন্য সিএনজিচালিত অটোরিকশায় স্বয়ংক্রিয় মিটার রয়েছে। তবে কোনো চালকই মিটারে যেতে চান না। গতকাল বিকেলে শাহবাগে পদচারী সেতুর নিচে অটোরিকশার অপেক্ষায় দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন এই নারী। কেউ যেতে রাজি হচ্ছিলেন না। একজন যেতে রাজি হলেও ভাড়া চাইলেন ৩০০ টাকা। ভাড়া শুনে ভিরমি খাওয়ার দশা তাঁর! l ছবি: প্রথম আলো
বিকেল সাড়ে চারটার দিকে শাহবাগে বিএসএমএমইউর সামনে গিয়ে দেখা যায়, অসংখ্য যাত্রীর সঙ্গে অনেকে রোগী নিয়ে অটোরিকশার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। রোগীদের রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন। কেউ কেউ ১৫-২০টি অটোরিকশা দাঁড় করিয়েও গন্তব্যে যেতে রাজি করাতে পারছিলেন না। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষায় ক্লান্ত রোগীদের অনেকে রাস্তাতেই বসে পড়েন।
মাকে চিকিৎসক দেখাতে শান্তিনগর থেকে এসেছিলেন মমিন ভূঁইয়া। তিনি বললেন, ‘এভাবে যাত্রীদের জিম্মি করে বাড়তি ভাড়া আদায় করাটা বড় অন্যায়।’
অবশ্য মিটারে না চলে বেশি ভাড়া নেওয়ার পেছনে যুক্তি অটোরিকশাচালকেরাও দেখালেন। তাঁদের কয়েকজন বললেন, মালিকেরা সরকার নির্ধারিত জমার চেয়ে অনেক বেশি জমা নেন, যানজটে গন্তব্যে পৌঁছাতেই সময় বেশি লাগে, ট্রাফিক সার্জেন্ট ধরলেই টাকা দিতে হয় এবং মিটারে চালিয়ে তাঁদের তেমন আয় থাকে না। টেকনিক্যাল মোড়ে অটোরিকশাচালক আবু জাফর বলেন, ‘আইন তো খালি মুখে মুখে, কেউ মানে না। মালিক, পুলিশ সবাই যদি আইন মানতো, তাইলে আমগো তো মিটারে নিতে সমস্যা ছিল না।’
চালকদের এ অজুহাতের কারণ যা-ই হোক, সরকার অটোরিকশার চালকদের দৌরাত্ম্য বন্ধে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়নি। মালিক-শ্রমিকদের দাবি মেনে উল্টো চালুর পর চার দফা অটোরিকশার ভাড়া ও জমা বৃদ্ধি করেছে সরকার।
ঢাকায় অটোরিকশা রয়েছে প্রায় ১২ হাজার। নতুন পাঁচ হাজার অটোরিকশা নামানোর জন্য ২০০৮ সাল থেকে প্রক্রিয়া চালাচ্ছে বিআরটিএ। কিন্তু মালিক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়নের মধ্যে পাল্টাপাল্টি মামলার কারণে তা আর নামেনি।

No comments

Powered by Blogger.