লেবাননে নির্যাতিতা শারমিনের আকুতি by রোকনুজ্জামান পিয়াস

শারমিন আক্তার। বাড়ি ঢাকার গেণ্ডারিয়ায়। জন্মের সময় মা হারিয়েছেন। ৪-৫ বছর পর বাবাও মারা যান। বিয়ের পর ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় স্বামীর সঙ্গেও। ভাগ্য বদলের আশায় পাড়ি দিয়েছিলেন লেবানন। এখন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন সেখানকার একটি হাসপাতালে। এপ্রিল মাস থেকে ওই হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন রয়েছেন তিনি। ইতিমধ্যে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তার চিকিৎসা বাবদ ১২ লক্ষাধিক টাকা ব্যয় করেছেন। আরও ৮ লাখ টাকার প্রয়োজন বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দিয়েছে। অতিরিক্ত ওই খরচ আর বহন করতে রাজি নয় কর্তৃপক্ষ। উপরন্তু দাবি করেছে আগের ১২ লাখ টাকা। গুরুতর অসুস্থ শারমিনকে পুলিশের কাছে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। লেবাননে নিয়ে যাওয়া নিপা নামের এক মহিলা তাকে ফেরত দেয়া বাবদ ৩ লাখ টাকা দাবি করেছিল এর আগেই। এদিকে শারমিনকে ফেরত পেতে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরছেন তার স্বজনরা। বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন করেও এখনও কোন কূলকিনারা পাননি তারা। একমাত্র বোন রাজিয়া সুলতানা এবং ভাই বাবু মিয়া ছাড়া আপন বলতে কেউ নেই ২৫ বছর বয়সী শারমিনের। বোনের স্বামী কিসমত এবং ভাই দু’জনই শ্রমিকের কাজ করেন আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামে। শারমিনের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে দয়াগঞ্জ এলাকার এনজিওকর্মী বাবুল নামে এক প্রতারক তার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে। এক পর্যায়ে বিয়েও করে তাকে। কিন্তু বিয়ের পর শারমিন জানতে পারেন বাবুলের বউ ও সন্তানসন্ততি রয়েছে। এ নিয়ে কথাকাটাকাটি হয় তাদের মধ্যে। বাবুলের হাতে নির্যাতিত হন শারমিন। শেষমেশ বিবাহ বিচ্ছেদ হয় তাদের। বাবুলের বাসায় যাতায়াতের সূত্র ধরেই পরিচয় হয় নিপা নামের এক মহিলার সঙ্গে। বিবাহ বিচ্ছেদ হলে নিপা নামের মেয়েটির সঙ্গে যোগাযোগ হয় শারমিনের। নিপা তখন লেবানন যাওয়ার প্রলোভন দেখায় তাকে। সেখানে গৃহকর্মীর কাজ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। সে মোতাবেক গত ৩০শে এপ্রিল বাংলাদেশী রিক্রুটিং এজেন্সি মেসার্স বাংলাদেশ এক্সপোর্ট করপোরেশন ও লেবাননী এজেন্সি ফ্রেন্ডস সাবেক্স ওয়াফিক সাবরা’র মাধ্যমে লেবাননে যান। সেখানে পৌঁছানোর পর লেবাননে বসবাসকারী নিপা নামের বাংলাদেশী ওই মহিলা তাকে কাজে দেন। কয়েকদিন কাজ করার পর তাকে আটকে রাখা হয়। তার ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়। অমানুষিক নির্যাতন সইতে না পেরে শারমিন ওই বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। পলায়নের সময় তিনি সে দেশের ফাইদা এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হন। এ সময় স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে ডা. মনজের আল হাজ্ব হাসপাতালে ভর্তি করেন। তিনি সেখানেই চিকিৎসাধীন রয়েছেন। শাহিদা নামে এক বাংলাদেশী ওই হাসপাতালে চাকরি করেন। তিনি ফোনে শারমিনের স্বজনদের জানিয়েছেন তাকে এতদিন হাসপাতালের মালিক নিজ খরচে চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন। কিন্তু এখন আর অতিরিক্ত খরচ বহন করতে তিনি রাজি নন। তাকে পুলিশের হাতে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলেও হাসপাতালে কর্মরত শাহিদা জানিয়েছেন। তিনি আরও জানিয়েছেন- গুরুতর আহত শারমিনের চিকিৎসা ও জীবন রক্ষা করা জরুরি। তার পায়ের হাড় ভেঙে গেছে। এদিকে শারমিন লেবাননে যাওয়ার পর কোন খোঁজখবর না পাওয়ায় নিপাকে ফোন করে পরিবারের লোকজন। ওই সময় শারমিনের পরিবারের কাছে তাকে দেশে ফেরত পাঠাতে ২ থেকে ৩ লাখ টাকা দাবি করেছিল নিপা। তবে হাসপাতালে ভর্তির পর থেকে নিপা আর ফোন ধরে না। এদিকে শারমিনকে ফেরত আনার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করতে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরছে তার পরিবার। গত ১৩ই আগস্ট এ ব্যাপারে বিএমইটি বরাবর আবেদন করে তারা। এরপর ২৪শে আগস্ট একই আবেদন করে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স বোর্ডে। আরেকটি আবেদন করেন ২৫শে আগস্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর। এছাড়া, গত ৭ই সেপ্টেম্বর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (কনস্যুলার অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার বরাবর আরও একটি আবেদন করে। এসব আবেদনের প্রেক্ষিতে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের পরিচালক (প্রশাসন ও উন্নয়ন) উপ-সচিব ড. জিয়াউদ্দিন লেবাননের বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব (শ্রম)কে এব্যাপারে বিস্তারিত খোঁজখবর নিতে এবং দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করেন। প্রথম সচিব সিকদার মোহাম্মদ আশরাফুর রহমান সরজমিন ওই হাসপাতালে গিয়ে একটি প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন। তাতে তিনি বলেছেন, শারমিনকে ভুল তথ্য দিয়ে লেবাননে আনা হয়েছে। তাকে অবৈধ কাজ করতে বলপ্রয়োগ করা হতো। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে তিনি পালিয়ে যান। তিনি আরও উল্লেখ করেন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে তার চিকিৎসা বাবদ ১৬ হাজার ডলার খরচ করেছেন। আরও ১০ হাজার ডলার খরচ হবে বলেও হাসপাতালের চিকিৎসকরা তাকে জানিয়েছেন। তিনি আরও উল্লেখ করেন আগের টাকাও দাবি করেছে কর্তৃপক্ষ। এছাড়া, গুরুতর অসুস্থ শারমিনের বর্তমান চিকিৎসা সেবাও বন্ধ রয়েছে। বর্তমানে তাকে ফেরত আনতে সর্ব মোট ২৬ হাজার ডলার প্রয়োজন। এর মূল্যমান প্রায় ২০ লক্ষাধিক টাকা। শারমিনের দুলাভাই কিসমত জানিয়েছেন মন্ত্রণালয় সর্বসাকুল্যে ৩ লাখ টাকা দিতে পারবে বলে জানিয়েছে। বাকি টাকা কিভাবে যোগাড় হবে তা তারা জানেন না। এদিকে ওই টাকা যোগাড় না করতে পারলে শারমিনকেও ফেরত আনা যাচ্ছে না। কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না দিশাহারা পরিবারটি।

No comments

Powered by Blogger.