সব ক্ষমতাই এমপির! by আবদুল্লাহ আল মামুন

তৃণমূলে ত্রিমুখী দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছেন ক্ষমতাসীনরা। অধিকাংশ জেলায়ই প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে বর্তমান এমপিদের (জাতীয় সংসদ সদস্য) সঙ্গে সাবেক এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা পরিষদ প্রশাসকদের দ্বন্দ্ব। এ অবস্থায় দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছেন দলের নেতাকর্মীরা।
উন্নয়নমূলক কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়নে এমপিরা একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়েই মূলত এই দ্বন্দ্বের সূত্রপাত। এছাড়া টেন্ডার ভাগাভাগি, এলাকায় প্রভাব বিস্তার, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে লোক নিয়োগ, স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কমিটি গঠনসহ নানা ইস্যুতে নিজ দলের নেতাদের সঙ্গে ত্রিমুখী কোন্দলে জড়িয়ে পড়েছেন বর্তমান এমপিরা।
দলীয় কোন্দল এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, একে অন্যের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ জনসম্মুখে তুলে ধরতেও দ্বিধাবোধ করেন না তারা। কোনো কোনো স্থানে সরকারি অনুষ্ঠানে একজন উপস্থিত থাকলে, আরেকজন থাকেন অনুপস্থিত। দ্বন্দ্বের জেরে কোণঠাসা হয়ে নিজ কার্যালয়ে অফিস করাও বন্ধ করে দিয়েছেন কেউ কেউ। এমনকি ক্ষোভে-দুঃখে ত্যাগী নেতাদের অনেকেই দলীয় পদ ছেড়ে দিতেও কুণ্ঠাবোধ করছেন না।
ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের দ্বন্দ্বের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে স্থানীয় প্রশাসনসহ সরকারের অন্যান্য দফতরের ওপর। ব্যাহত হচ্ছে উন্নয়নমূলক কাজের স্বাভাবিক গতি। সেই সঙ্গে ঝুলে যাচ্ছে তৃণমূল পর্যায়ের আওয়ামী লীগের কাউন্সিলের আয়োজন তথা পূর্ণাঙ্গ কমিটির গঠন প্রক্রিয়া। সাংগঠনিক কার্যক্রমের দিকে নজর না দিয়ে প্রভাব-প্রতিপত্তি নিয়ে মহাব্যস্ত নেতাকর্মীরা। অর্থ আয়ের সন্ধানে নিজেদের মধ্যে শুরু করেছেন অসুস্থ প্রতিযোগিতা। দিন যতই যাচ্ছে, ততই বাড়ছে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের টানাপোড়েন। তাদের এই কোন্দল আর কিছুদিন অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে দলের ওপর পড়বে দীর্ঘমেয়াদি বিরূপ প্রভাব। যার ফায়দা লুটবে বিএনপি। ২০ দলীয় জোটের আন্দোলন মোকাবেলায় তৃণমূলে নেতাকর্মীরা তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে না বলেও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সাধারণ নেতাকর্মীরা।
যুগান্তরের বিভিন্ন ব্যুরো অফিস ও জেলা প্রতিনিধিদের অনুসন্ধান এবং আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে উল্লেখিত সব তথ্য। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ যুগান্তরকে বলেন, নেতৃত্বের প্রতিযোগিতার কারণেই দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই আমরা সব জেলা ও উপজেলার সম্মেলন সম্পন্ন করার লক্ষ্যেই কাজ করছি। এই সম্মেলনে নতুন নেতৃত্ব আসবে। আশা করছি এরপর সব দ্বন্দ্বের নিরসন হবে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমান ও সাবেক এমপি, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও জেলা প্রশাসকরা (অনির্বাচিত আওয়ামী লীগ নেতা) একে অন্যের বিরুদ্ধে কাদা ছোড়াছুড়িতে যতটা ব্যস্ত, তাদের ততটা ব্যস্ততা উন্নয়ন কাজে নেই। এমপিদের পাশাপাশি জেলা পরিষদের প্রশাসকদের বিরুদ্ধেও দুর্নীতি এবং অনিয়মের অভিযোগ উঠছে। উপজেলা চেয়ারম্যানরা বলছেন, তারা এমপিদের কাছে জিম্মি। তাদের ইশারায় সবকিছু চলে। আবার জেলা পরিষদের প্রশাসকরা তাদের পাত্তা দেন না। বর্তমান এমপিদের ত্রিমুখী দ্বন্দ্বের জেরে গুটিকয়েক স্থানে উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা পরিষদ প্রশাসকদের মধ্যেও কোন্দলের খবর পাওয়া গেছে।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর উপজেলা পরিষদ অধ্যাদেশ সংশোধন করে। এতে এমপিদের উপজেলা পরিষদের উপদেষ্টা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার বিধান যুক্ত করা হয়। অন্য একটি ধারায় উপজেলার যে কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনা এমপির সুপারিশ ছাড়া পরিষদ গ্রহণ করতে পারবে না বলে উল্লেখ করা হয়। এছাড়া মৃত জেলা পরিষদকে কার্যকর করতে উদ্যোগ নেয় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বিগত মহাজোট সরকার। এক্ষেত্রে নির্বাচিত প্রতিনিধির পরিবর্তে জেলা পরিষদে দলীয় নেতাদের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। অনির্বাচিত হওয়ায় অধিকাংশ প্রশাসক অন্য কোনো স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের তোয়াক্কা করে না। বিশেষ করে স্থানীয় সংসদ সদস্যদের নিয়ন্ত্রণ করার প্রবণতা সহ্য করতে পারছেন না তারা।
এ ব্যাপারে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গা যুগান্তরকে বলেন, এমপিদের উপজেলা পরিষদে উপদেষ্টা করার সিদ্ধান্তটি সরকারি। তারা (এমপি) কিছু ক্ষমতা বেশি ভোগ করছে এটা ঠিক। তবে উপজেলা চেয়ারম্যানরা অনেক সুবিধা পেয়ে আসছেন। তিনি দাবি করেন, এমপিদের সঙ্গে উপজেলা চেয়ারম্যানদের সে রকমভাবে দ্বন্দ্ব হচ্ছে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তের পরিপন্থী কাজ হলে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। তবে এসব আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।
জেলা পরিষদ প্রশাসকদের সঙ্গে এমপিদের দ্বন্দের বিষয়ে রাঙ্গা বলেন, জেলা পরিষদ প্রশাসকদের র‌্যাংক (পদমর্যাদা) এখনও দেয়া হয়নি। সেক্ষেত্রে কিছু সমস্যা হচ্ছে। তবে এমপিদের সঙ্গে দ্বন্দ্বের বিষয়ে তিনি অবহিত নন। যদি কোনো অভিযোগ আসে তাহলে বিষয়টা দেখবেন। উল্লেখ্য, উপজেলা পরিষদ ও জেলা পরিষদসহ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর সার্বিক কার্যক্রম দেখভালের কর্র্তৃপক্ষ হচ্ছে স্থানীয় সরকার, পল্পী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ উপজেলা পরিষদ অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান হারুনার রশিদ হাওলাদার যুগান্তরকে বলেন, জনপ্রতিনিধিদের ত্রিমুখী দ্বন্দ্বের বিষয়টি মানসিক। রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে এমনটা হচ্ছে। জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে টিমওয়ার্ক নেই। থাকলে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হতো না। এছাড়াও ডিসি ও ইউএনওরা দ্বন্দ্ব সৃষ্টিতে ইন্ধন জোগান বলে তিনি অভিযোগ করেন। হারুনার রশিদ হাওলাদারের মতে, জনপ্রতিনিধিরা যার যার ক্ষেত্র বা কাজের পরিধি মেনে চললে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হতো না।
ক্ষমতাসীন দলের বর্তমান এমপিদের ত্রিমুখী দ্বন্দ্বের ওপর যুগান্তরের বিভিন্ন ব্যুরো অফিস ও জেলা প্রতিনিধিদের পাঠানো অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের উল্লেখযোগ্য অংশ নিচে তুলে ধরা হল :
চাঁপাইনবাবগঞ্জ : জেলা পরিষদের প্রশাসক মঈনউদ্দিন মণ্ডলের সঙ্গে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ সদর আসনের সংসদ সদস্য আবদুল ওয়াদুদের সম্পর্ক স্বাভাবিক নয়। মঈন উদ্দিন মণ্ডল ও আবদুল ওয়াদুদ দলের রাজনীতিতে পৃথক দুটি গ্র“পের নেতৃত্ব দেন। এমনকি প্রশাসকের সঙ্গে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ এর সংসদ সদস্য গোলাম মোস্তফা বিশ্বাসের সম্পর্কও খারাপ। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনের এমপি গোলাম মোস্তফা বিশ্বাসের সঙ্গে নাচোল উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল কাদেরের সম্পর্ক বলতে গেলে দা-কুমড়া। সাবেক এমপি জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বর্তমান এমপি গোলাম মোস্তফা বিশ্বাসের সম্পর্ক খুবই খারাপ। বিগত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তারা একজন আরেকজনের প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। জেলা পরিষদ প্রশাসক মঈন উদ্দিন মণ্ডল বলেন, দ্বন্দ্ব বলতে সেই ধরনের কিছু প্রকাশ্যে নেই। তবে তাদের মধ্যে সমন্বয় নেই।
নাটোর : জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদ প্রশাসক অ্যাডভোকেট সাজেদুর রহমানের সঙ্গে স্থানীয় চার এমপির সম্পর্ক শীতল। নাটোর-২ (সদর) আসনের এমপি শফিকুল ইসলাম শিমুল ও সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শরিফুল ইসলাম রমজানের সম্পর্ক দা-কুমড়া। নাটোর-৪ (গুরুদাসপুর-বড়াইগ্রাম) আসনের এমপি আবদুল কুদ্দুসের সঙ্গে বড়াইগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল আলম একত্রে কোনো সরকারি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন না। একই অবস্থা লালপুর উপজেলা চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদের সঙ্গে স্থানীয় এমপি আবুল কালাম আজাদের।
টাঙ্গাইল : টাঙ্গাইল-২ (গোপালপুর-ভুয়াপুর) আসনের এমপি খন্দকার আসাদুজ্জামানের সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগের দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করেছে। ভুয়াপুর উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল হালিম অ্যাডভোকেট ও গোপালপুর উপজেলা চেয়ারম্যান ইউনুস ইসলাম তালুকদার ঠাণ্ডুর সঙ্গে টিআর, কাবিখা নিয়ে পরামর্শ না করে এমপি ইচ্ছেমতো প্রকল্প দিয়ে এসব বিতরণ করছেন।
কক্সবাজার : কক্সবাজার-৩ (সদর-রামু) আসনের সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমলের সঙ্গে জেলা পরিষদ প্রশাসক মোস্তাক আহমদ চৌধুরীর বিরোধ দীর্ঘদিনের। অবশ্য জেলা পরিষদ প্রশাসক মোস্তাক আহমদ চৌধুরী দাবি করেন, কারও সঙ্গে তার মতবিরোধ নেই। তবে কমল অভিযোগ করেন, সদরের এমপি হলেও জেলা পরিষদের কোনো উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে তাদের সঙ্গে সমন্বয় করা হয় না।
বরিশাল : বরিশালে নিজ দলের এমপিদের কাছে উপেক্ষিত ১০টি উপজেলায় নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সমর্থক চেয়ারম্যানরা। বরিশাল-১ (গৌরনদী-আগৈলঝাড়া) আসনের সংসদ সদস্য আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর প্রতিনিধিরা গৌরনদী উপজেলার সব কাজ করে থাকেন। উপজেলা চেয়ারম্যান মো. শাহ আলম খান প্রায় কোণঠাসা হয়ে আছেন। রাগে-দুঃখে উপজেলা পরিষদেও তিনি খুব একটা আসেন না। বাবুগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান এসএম খালেদ হোসেন স্বপন অভিযোগ করে বলেন, এমপি টিপু সুলতান (বরিশাল-৩, বাবুগঞ্জ-মুলাদী) তাকে উপেক্ষা করে টিআরের চাল নিজের লোকজনদের দিয়ে বিতরণ করিয়েছেন। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন সংসদ সদস্য শেখ মো. টিপু সুলতান।
পটুয়াখালী : পটুয়াখালী-৪ (কলাপাড়া-রাঙ্গাবালী) আসনে এমপি মাহাবুবুর রহমান তালুকদার। এ আসনের এমপির সঙ্গে কলাপাড়া উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোতালেব তালুকদারের সম্পর্ক খুবই খারাপ। মোতালেব তালুকদারের অভিযোগ মাহাবুবুর রহমান তার সঙ্গে কোনো সমন্বয় করেন না। তবে সাবেক প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান তালুকদার এমপি এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তিনি আলোচনা করেই কাজ করে আসছেন।
যশোর : জেলা পরিষদের উপদেষ্টা এমপিরা এককভাবে বরাদ্দ নিচ্ছে। এ নিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যানরা ক্ষুব্ধ। দু’বছর ধরে জেলা পরিষদের প্রকল্প এমপিদের ৭০ শতাংশ ও উপজেলা চেয়ারম্যানদের ৩০ শতাংশ হারে ভাগ করে দেয়া হচ্ছে।
খুলনা : জেলা পরিষদে এ পর্যন্ত গৃহীত প্রকল্পের এক-তৃতীয়াংশই দাকোপ ও বটিয়াঘাটায় বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। জেলা পরিষদ প্রশাসক হারুনুর রশীদের নির্বাচনী এলাকায় এ দুটি উপজেলা। জুন মাসে অনুষ্ঠিত সভায় উপজেলা চেয়ারম্যানরা এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। খুলনা জেলা পরিষদের প্রশাসক শেখ হারুনুর রশীদ বলেন, দাকোপ ও বটিয়াঘাটায় কাজ বেশি হলে ক্ষোভের কিছু নেই। এটা পুষিয়ে দেয়ার সুযোগ রয়েছে।
চুয়াডাঙ্গা : চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সংসদ সদস্য ও হুইপ সোলায়মান হক জোয়ার্দার ছেলুনের সঙ্গে চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের সংসদ সদস্য আলী আজগর টগরের মধ্যে তীব্র দ্বন্দ্ব রয়েছে। ১৫ আগস্ট শোক দিবসের মাসে চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের দামুড়হুদা-জীবননগর উপজেলার আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীরা হুইপ নির্বাচিত হওয়ায় চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সংসদ সদস্য সোলায়মান হক ছেলুনকে গণসংবর্ধনা দেয়। এতে টগরকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। ফলে তিনি অনুষ্ঠান বর্জন করেন। সংবর্ধনায় ছেলুন প্রতিপক্ষ টগরের ব্যাপক সমালোচনা করেন। পরে টগর তার নির্বাচনী এলাকায় শোক দিবসের এক জনসভায় হুইপ ছেলুনের তীব্র সমালোচনা করেন। অবশ্য টগর নিজের এলাকাতেই কোণঠাসা। তার বিরুদ্ধে সব সময়ই সোচ্চার জীবননগর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অমল বিশ্বাস।
কুষ্টিয়া : কুষ্টিয়ায় সরকারদলীয় এমপিদের সঙ্গে উপজেলা চেয়ারম্যান এবং জেলা পরিষদের প্রশাসকের দূরত্ব রয়েছে। জেলা পরিষদ প্রশাসক কুমারখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা জাহিদ হোসেন জাফর। অপেক্ষাকৃত জুনিয়র হওয়ায় স্থানীয় এমপিসহ জেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের কাছে তিনি অনেকটা উপেক্ষিত। জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটি এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষা কমিটির সভাতেও অনুপস্থিত থাকেন জাহিদ হোসেন জাফর। কুষ্টিয়া-৪ (কুমারখালী-খোকসা) আসনের এমপি আবদুর রউফের সঙ্গে কুমারখালী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান খানের সম্পর্ক খারাপ। দু’জনই একে অপরকে এড়িয়ে চলেন। সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করায় খোকসা উপজেলা চেয়ারম্যান সদর উদ্দীন খানের সঙ্গে এমপি আবদুর রউফের দূরত্ব রয়েছে। কুষ্টিয়া-২ আসনের এমপি তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। কিন্তু উপজেলা চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা কামরুল আরেফিন গোটা উপজেলা নিয়ন্ত্রণ করেন।
ঝিনাইদহ : ঝিনাইদহ জেলা পরিষদের প্রশাসক অ্যাডভোকেট আবদুল ওয়াহেদ জোয়ারদারের বিরুদ্ধে জুন মাসে টেন্ডার সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য তাহজীব আলম সিদ্দিকীর অনুসারীরা বিক্ষোভ করে। প্রশাসক দাবি করেন, দলীয় কতিপয় ব্যক্তি স্বতন্ত্র এমপির পক্ষ নিয়ে সেদিন অফিসের সামনে হইচই করেছিল। জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা উপসচিব এএসএম মৈনুর বলেন, প্রশাসকের ইচ্ছেমতো পরিষদ পরিচালিত হয় এ নিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যানদের মাঝে ক্ষোভ রয়েছে। সংসদ সদস্য নবী নেওয়াজ বলেন, জেলা পরিষদের মাসিক সভায় তাকে একদিনের জন্যও ডাকা হয়নি। হরিণাকুণ্ডু উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ অভিযোগ করেন, জেলা পরিষদে সরকারি অর্থ অপচয় করা হচ্ছে। জেলা পরিষদের প্রশাসক আবদুল ওয়াহেদ জোয়ারদার নিজেকে সৎমানুষ হিসেবে দাবি করে সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
ভোলা : বোরহানউদ্দিন উপজেলায় টিআরের চাল বিক্রি নিয়ে স্থানীয় এমপি আলী আজম মুকুল ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মহব্বত জান চৌধুরীর মধ্যে মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়েছে। চরফ্যাশন ও মনপুরা উপজেলায় প্রকল্প বাস্তবায়নের আগেই বরাদ্দের চাল বিক্রি করার অভিযোগ রয়েছে। জেলা উন্নয়ন কমিটির সভায় ৬শ’ টন চাল বিক্রির এ অভিযোগ উঠলে তদন্তের নির্দেশ দেয়া হয়। এক উপজেলা চেয়ারম্যান অনেকটাই ক্ষোভ প্রকাশ করে নিজেকে কাঠের পুতুলের সঙ্গে তুলনা করেন।
বর্তমান ও সাবেক এমপিদের টানাপোড়েন
চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনে বর্তমান ও সাবেক এমপির সম্পর্ক খুবই খারাপ। এখানে সাবেক এমপি জিয়াউর রহমান ও বর্তমান এমপি গোলাম মোস্তফা বিশ্বাসের দ্বন্দ্বের বিষয়টি প্রকাশ্য। তারা দু’জন একে অপরের সঙ্গে কথা বলেন না। তিন থানা নিয়ে গঠিত নির্বাচনী এলাকার প্রত্যেক থানায় দলের নেতাকর্মীরা দুই ভাগে বিভক্ত। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ভোলাহাট উপজেলায় এক নির্বাচনী সমাবেশ থেকে গোলাম মোস্তফা বিশ্বাসের সমর্থকরা জিয়াউর রহমানকে মঞ্চ থেকে নামিয়ে দেয়।
রাজশাহী-৩ আসনের এমপি আয়েন উদ্দিনের সঙ্গে সাবেক এমপি মেরাজ উদ্দিন মোল্লার সম্পর্ক খারাপ। তারা একে অপরের বিরুদ্ধে সব সময় সোচ্চার থাকেন। নাটোর-২ আসনের সাবেক এমপি আহাদ আলী সরকার আর বর্তমান এমপি শফিকুল ইসলাম শিমুল। আহাদ আলী সরকার প্রতিমন্ত্রী থাকার সময় শিমুল তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। সে বিরোধ এখনও বিদ্যমান।
সিরাজগঞ্জ-৫ আসনের এমপি গার্মেন্ট ব্যবসায়ী আবদুল মজিদ মণ্ডলের সঙ্গে এখানকার সাবেক এমপি, মন্ত্রী আবদুল লতিফ বিশ্বাসের বিরোধ চরম পর্যায়ে। বলা হয়, জনপ্রিয়তা না থাকা সত্ত্বেও শুধু টাকার জোরে বিএনপিবিহীন নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পান মজিদ মণ্ডল। তখন লতিফ বিশ্বাসের সমর্থকরা মনোনয়ন পরিবর্তনের জন্য অনশনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে। বর্তমানে সিরাজগঞ্জ জেলা পরিষদের প্রশাসক আবদুল লতিফ বিশ্বাস।
সিরাজগঞ্জ-৬ আসনের বর্তমান এমপির সঙ্গে দ্বন্দ্বের জের ধরে শাহজাদপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সাবেক সংসদ সদস্য চয়ন ইসলাম সম্প্রতি দলীয় পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। তিন পদত্যাগপত্রটি জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান এবং সাধারণ সম্পাদক কেএম হোসেন আলীর কাছে পৌঁছে দেন। চয়ন ইসলাম তার পদত্যাগপত্রে উল্লেখ করেছেন, প্রায় দুই বছর আগে শাহজাদপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলেও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সংসদ সদস্য হাসিবুর রহমান স্বপনের অসহযোগিতার কারণে আজ পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা সম্ভব হয়নি। এমপির স্বেচ্ছাচারিতা, স্বৈরাচারী কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেন তিনি।
ঝিনাইদহ-৩ আসনের সাবেক এমপি শফিকুল আজম খান চঞ্চল ও বর্তমান এমপি অ্যাডভোকেট নবী নেওয়াজের সম্পর্ক খুব খারাপ। তাদের দু’জনের বিরোধের বিষয় নেতাকর্মীরা সবাই জানেন। ঝিনাইদহ-৪ আসনের বর্তমান এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার ও সাবেক এমপি আবদুল মান্নানের বিরোধ চরম পর্যায়ে। কেউ কাউকে দেখতে পারেন না।
যশোর-৩-এর সাবেক এমপি খালেদুর রহমান টিটো ও বর্তমান এমপি কাজী নাবিল আহমেদ। এলাকার দলীয় নেতাকর্মীরা রাজনীতিতে নবীন নাবিলকে প্রয়োজনের সময় না পাওয়ায় টিটোর কাছে ছুটে যান। ঢাকায় বসবাসকারী নাবিলের ক্ষোভ এখানেই। এ নিয়েই টিটোর সঙ্গে তার রয়েছে এক ধরনের ঠাণ্ডা লড়াই।
ময়মনসিংহ-১০ (গফরগাঁও) আসনের সাবেক এমপি গিয়াস উদ্দিন আহমেদ আর বর্তমান এমপি ফাহমী গোলন্দাজ বাবেল। তাদের দ্বন্দ্ব এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতেই বাবেলের সমর্থকরা সাবেক এমপি গিয়াসের দিকে জুতা ছুড়ে মারে। ঢাকা-৭ আসনের এমপি হাজী মোহাম্মদ সেলিমের সঙ্গে সাবেক এমপি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনের সম্পর্ক সাপে-নেউলে। তারা একে অপরের সঙ্গে কথা বলেন না। নরসিংদী-৩ আসনের এমপি সিরাজুল ইসলাম মোল্লা ও সাবেক এমপি জহিরুল হক ভূঞা মোহনের বিরোধ চরম পর্যায়ে।
কুমিল্লা-৪ আসনের বর্তমান এমপি (স্বতন্ত্র) রাজী মোহাম্মদ ফখরুলের সঙ্গে সাবেক এবিএম গোলাম মোস্তফার সম্পর্ক খুবই খারাপ। রাজী আওয়ামী লীগ নেতা ফকরুল ইসলাম মুন্সীর ছেলে। আর গোলাম মোস্তফা জাপা ফেরত নেতা। ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্বেই মূলত দু’জন দুদিকে। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এ দু’জনের ওপর বিরক্ত। তারা দু’জনের কাউকেই আওয়ামী লীগের লোক মনে করে না।
ফরিদপুর-৪ মজিবুর রহমান চৌধুরী (নিক্সন চৌধুরী) স্বতন্ত্র নির্বাচন করে জয়ী হন।
বঙ্গবন্ধু পরিবারের এ সদস্য অনেকটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরউল্লাহকে পরাজিত করেন। এ আসনের সাবেক এমপি নিলুফার জাফরউল্লাহর স্বামী কাজী জাফরউল্লাহ। বর্তমানে এখানকার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা দ্বিধাবিভক্ত।
মাদারীপুর-৩ আসনের বর্তমান এমপি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আফম বাহাউদ্দীন নাছিমের সঙ্গে সাবেক এমপি সৈয়দ আবুল হোসেনের সম্পর্ক খারাপ। পদ্মা সেতু কেলেংকারিতে মন্ত্রিত্ব ও দলীয় পদ হারানোর পর দলের মনোনয়ন বঞ্চিত হন সৈয়দ আবুল হোসেন। তবে এমপি নির্বাচিত হলেও এখানকার মানুষের মন জয় করতে পারেননি নাছিম। ব্যাপক উন্নয়নের কারণে আবুল হোসেন এখনও জনপ্রিয়। দু’জনের সম্পর্ক খারাপের মূল কারণ এই জনপ্রিয়তা।

No comments

Powered by Blogger.