উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব- মধুরেণ সমাপয়েৎ by আশীষ-উর রহমান ও হারুন আল রশীদ

সবার মনের মণিকোঠায় এমন একটি গভীর প্রত্যাশা থাকে যে শেষটি হবে সুন্দর। তা যেমন ব্যক্তিগতভাবে নিজের জীবনের বেলায়, তেমনি নিজের সব কাজ, সব আয়োজনের ক্ষেত্রেও। সে কারণেই বোধ হয় এমন কথা প্রচলিত—সব ভালো, যার শেষ ভালো।
বেঙ্গল আইটিসি-এসআরএ উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের ক্ষেত্রেও এ ঘটনা ঘটল। যাকে বলে ‘মধুরেণ সমাপয়েৎ’। গতকাল রোববার বেঙ্গল ফাউন্ডেশন ও ভারতের আইটিসি-এসআরএ আয়োজিত চার দিনের উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের ঘটল মধুর সমাপ্তি। দর্শক-শ্রোতার মনে রেখে গেল সুরের রেশ এবং তবলা, মৃদঙ্গম আর পাখোয়াজের তাল—ছন্দের স্পন্দন আর স্মৃতির পাতায় ভাস্বর হয়ে থাকার মতো এক অনুপম অভিজ্ঞতা।
আর্মি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত উৎসবের সার্বিক সহযোগিতায় ছিল প্রথম আলো। এ ছাড়া সহযোগিতা করেছে দ্য ডেইলি স্টার ও মাছরাঙা টেলিভিশন। গতকালের উৎসব উৎসর্গ করা হয় ওস্তাদ আলী আকবর খাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে। আর পুরো উৎসব উৎসর্গ করা হয় ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁকে শ্রদ্ধা নিবেদন করে।
‘রাতিয়া হামারি’ বন্দিশে মারুবেহাগ রাগে খেয়াল গেয়ে শ্রোতাদের সুরের ভুবনে নিয়ে যান শিল্পী ব্রজেশ্বর মুখোপাধ্যায়। সঙ্গে ছিল ইন্দ্রনীল ভাদুড়ীর ‘ধা ধিন ধিন ধা, না তিন তিন তা’ তবলায় তিনতালের লহরা। পরের বন্দিশটি ছিল ‘পিয়া বিন তরপত’। এরপর বাংলাদেশের শিল্পী আলিফ লায়লা সেতারে পরিবেশন করেন রাগ দেশ। বিলম্বিত একতাল ও দ্রুত তিনতালে বাধা তাঁর বন্দিশটি ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর সৃষ্টি। শিল্পীকে তবলায় সহযোগিতা করেন ওস্তাদ আকরাম খাঁ।
এরপর শুরু হয় সমাপনী অনুষ্ঠান। প্রধান অতিথি জাতীয় সংসদের উপনেতা সাজেদা চৌধুরী বলেন, নতুন প্রজন্মের শ্রোতা তৈরির জন্য এ ধরনের আসর নিয়মিত করা প্রয়োজন।
উচ্চাঙ্গসংগীতের এই উৎসব বাংলা গানের সুদিন ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবে—বললেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ। ভবিষ্যতে এ ধরনের আয়োজনে প্রয়োজনীয় সরকারি সহায়তা দেওয়ার কথাও তিনি উল্লেখ করেন।
প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের মানুষ যে গুণ-মানে অনেক উঁচু পর্যায়ে এগিয়ে চলেছে, এই উৎসবের দর্শক সাড়া তা প্রমাণ করেছে। এই উৎসব বন্ধুপ্রতিম দুই দেশের সেতুবন্ধকে আরও জোরদার করবে—বললেন মাছরাঙা টেলিভিশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী। আইটিসি-এসআরএর নির্বাহী পরিচালক রবি মাথুর তাঁর বক্তব্যে এই উৎসবে অভূতপূর্ব সাড়া দেওয়ার জন্য দর্শককে ধন্যবাদ জানান।
বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের ভবিষ্যতেও এ ধরনের উৎসব আয়োজন করা হবে বলে আশা প্রকাশ করেন।
সমাপনী আলোচনার পর কর্ণাটিক খেয়াল পরিবেশনের মধ্যদিয়ে অধিবেশনের দ্বিতীয় পর্ব শুরু করেন বিদুষী পদ্মশ্রী অরুণা সাইরাম। তিনি শুরু করেছিলেন মালকোশ রাগ দিয়ে। বাদ্যযন্ত্রেও ছিল ভিন্নতা। আদি তালে মৃদঙ্গম এবং ঘটম ও বেহালার বাদন পুরো পরিবেশনাকে উপভোগ্য করে তোলে। খেয়ালের পর ‘জাগো তুমি জাগো অভয়ও শক্তি’ বাংলা ভক্তিগীতি গেয়ে শ্রোতাদের তাক লাগিয়ে দেন।
বলার অপেক্ষা রাখে না, রাত ১২টার আগে পদ্মশ্রী বিদুষী আলারমেল ভাল্লীর ভরতনাট্যম ছিল অনবদ্য একটি পরিবেশনা। ‘পৃথিবীর সৌরভ’ নামে তাঁর প্রথম নাচটি ছিল প্রকৃতির সৌন্দর্য নিয়ে। ‘বর্ণম’ নাচটি সংগীতের সঙ্গে ভরতনাট্যমের মুদ্রার সমন্বয়ে একটি সৃজনশীল পরিবেশনা। ‘জাভেলি’ নাচটি প্রেমিকের কাছে প্রতারিত ও উপেক্ষিত এক নারীর অন্তর্বেদনার আখ্যান। শিল্পীকে সহযোগিতা করেন কণ্ঠে নন্দিনী শর্মা, মৃদঙ্গমে শক্তিভেল, বেহালায় ভিত্তাল রামামূর্তি ও নাটুয়াঙ্গমে বাসু দেবন।
ভাল্লীর পরিবেশনার আগে বাংলাদেশের শিল্পী মূর্তজা কবীর বাঁশি বাজিয়ে শোনান। নাচের মাঝখানে ভাল্লী বলেন, ‘রাতের পর রাত ধরে এত বিপুলসংখ্যক দর্শক-শ্রোতা উচ্চাঙ্গসংগীতের আসর উপভোগ করছেন, এতে আমি শুধু মুগ্ধ নই, বিস্মিত। এত সুশৃঙ্খল অনুষ্ঠান ব্যবস্থাপনায় আমি সবাইকে আমার হূদয়ের উষ্ণ অভিনন্দন জানাই। এমন একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পেরে আমি খুবই আনন্দিত।’
রাত ১২টার দিকে মঞ্চে আসেন বেনারস ঘরানার দুই সহোদর খেয়ালিয়া পণ্ডিত রাজন মিশ্র ও সাজন মিশ্র। পৌনে একটায় এ প্রতিবেদন লেখার সময় তাঁরা আশাবড়ী থাটে নায়কি কানাড়া রাগে খেয়াল পরিবেশন করছিলেন। অনুষ্ঠানের পরের দুই শিল্পী হচ্ছেন পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া ও পণ্ডিত উলহাস কাশালকর।

No comments

Powered by Blogger.