গহন গহীন-পোশাকশিল্পে অনভিপ্রেত ঘটনা বন্ধ হোক by ফখরুজ্জামান চৌধুরী

মৃত্যুর কাফেলা দীর্ঘায়িত করার প্রতিযোগিতায় যেন অবতীর্ণ হয়েছে স্বদেশ আমার। মৃত্যু আসে এমন অকল্পনীয় দুর্ঘটনার রূপ ধরে, যার সম্পর্কে ঘটে যাওয়ার আগ পর্যন্ত থাকে না কারো ধারণা, দূরবর্তী কল্পনায়ও। জীবনচক্রে জন্ম যেমন চিরন্তন সত্য, মৃত্যু তার চেয়েও অধিক চিরন্তন।
পোশাকশিল্পে বলা যায় এক ধরনের বিস্ফোরণ ঘটেছে বাংলাদেশে। এ খাতে উদ্যোক্তারা এগিয়ে এসেছেন কিছু অনুকূল পরিবেশের কারণে। সবচেয়ে বড় সুবিধা যা মালিকরা ভোগ করেছেন তা হলো, সস্তা শ্রমবাজারে অঢেল শ্রমশক্তির সরবরাহ, যার বেশির ভাগই নারী শ্রমিক এবং একসময়ে শিশু শ্রমিক।
যে অবলা নারী একদা গৃহকোণ থেকে বের হতে ইতস্তত করত, যার প্রথম অবলম্বন ছিল পিত্রালয় এবং সর্বশেষ শ্বশুরালয়, তাকে দেখা গেল শহরের রাজপথ ধরে টিফিনের পোঁটলা হাতে কাকডাকা ভোরে কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে হেঁটে চলতে। সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি তাঁদের কাছে উপেক্ষিত ছিল না বলেই দলবদ্ধ হয়ে তাঁরা চলাচল করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। ইভ টিজিং বর্তমানে ভয়াবহ রূপ নিলেও সত্তর-আশির দশকে একদম অশ্রুতপূর্ব ছিল না।
পোশাকশিল্পের বিকাশ দ্রুত ঘটতে লাগল। বিদেশি মুদ্রার ঝন্ঝনানিতে প্রলুব্ধ উদ্যোক্তারা বাজারের ব্যাপ্তি, প্রসার ও গভীরতার কথা বিবেচনা করতে ভুলে গেলেন। একদা একই দৃশ্য দেখা গেছে চিংড়ি রপ্তানির ক্ষেত্রে। গড্ডলিকা প্রবাহের বোধ করি এর চেয়ে সুন্দর উদাহরণ আর হয় না। বিদেশি ক্রেতারা পোশাকের বায়না পাঠান। দেশের শিল্প-কারখানায় ফরমায়েশ মতো তৈরি পোশাক যথাসময়ে গ্রাহকের কাছে পৌঁছে যাবে, এটাই প্রত্যাশিত। কমপ্লায়েন্স করতে গিয়ে ফ্যাক্টরিগুলো নানা রকম ফন্দিফিকিরের আশ্রয় নেয়। ওভারটাইম তো আছেই। কর্মচারীরা যাতে কাজে ফাঁকি দিতে না পারে সে জন্য গেট থাকে তালাবদ্ধ।
যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত পোশাক রিটেইল আউটলেট 'গ্যাপ'। তারা বাংলাদেশ থেকে পোশাকের সরবরাহ নিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। ওকলাহোমা থেকে ডালাসে যাওয়ার পথে মাঝামাঝি অবস্থানে গেইনসভিলের চমৎকার নৈসর্গিক পরিবেশে বিশাল এক রিটেইল আউটলেট গ্যাপের তৈরি পোশাকের। ভালো ডিসকাউন্টে এখানে উন্নতমানের পোশাক পাওয়া যায় বলে ডালাসে আসা-যাওয়ার পথে বেশ কয়েকবার এই আউটলেটে নামা হয়েছে। উদ্দেশ্য পছন্দসই পোশাক পেলে কেনা এবং তাদের পরিচ্ছন্ন টয়লেট ফ্যাসিলিটি ব্যবহার করা!
আমাদের গ্রুপটিকে দেখলে আউটলেট ম্যানেজার মহিলা মুখে প্রসন্ন হাসি ঝুলিয়ে এগিয়ে আসতেন। নানা রকম আলাপ হতো, যদি তিনি কম ব্যস্ত থাকতেন। দু-এক সময় তাঁর মুখে অভিযোগ শুনেছি। বাংলাদেশে তাঁদের পোশাক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান নাকি শ্রমিকদের স্বার্থের প্রতি উদাসীন। যুক্তরাষ্ট্র শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যাপারে যে কতটা কঠোর, ম্যানেজার মহিলার বিশ্বাস, বাংলাদেশে তাঁদের পোশাক সরবরাহকারীরা সে ব্যাপারে সচেতন আছেন পুরোপুরি। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে মানবতাবিরোধী নানা রকম তৎপরতায় লিপ্ত থাকে বটে। তবে যেসব দেশে তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িত থাকে, সেসব দেশে মানবতার বিষয়ে তার উদ্বেগ কখনো মাত্রাতিরিক্ত মনে হয়।
বাংলাদেশে পোশাকশিল্পে শিশুশ্রমের বিষয়ে প্রথম তোলপাড় শুরু করেন আইওয়া অঙ্গরাজ্যের ডেমোক্র্যাট দলের সিনেটর টম হারকিন (জন্ম : নভেম্বর ১৯, ১৯৩৯)। মূলত আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে কোকোয়া, কোকো বাগানে শিশুশ্রম নিয়োগের বিরুদ্ধে সোচ্চার সিনেটর হারকিন একসময়ে (২০০০ সালে) বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে শিশুশ্রম নিয়োগের বিরুদ্ধে ভীষণ প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। তাঁর প্রণীত 'দ্য ট্রেড ডেভেলপমেন্ট অ্যাক্ট অব ২০০০'-এ শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য ধারা সংযোজিত হয়। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে শিশু যে মা-বাবার অর্থনৈতিক সহায়ক শক্তি তা হারকিনের কল্পনার বাইরে ছিল। তাঁর বক্তব্য, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশাধিকার পেতে হলে যুক্তরাষ্ট্রের আইন মেনেই তা করতে হবে।
বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে গত কয়েক বছর বেশ কিছু অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটে গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে যে ঘটনাটি যুক্তরাষ্ট্রে বহুল আলোচনার জন্ম দেয় তা হলো শ্রমিকনেতা আমিনুল ইসলামের হত্যাকাণ্ড। যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী অনলাইন পত্রিকাগুলোতে প্রতিনিয়ত আমিনুলের হত্যাকাণ্ড নিয়ে সরকার তথা পোশাকশিল্পের মালিকদের বিরুদ্ধে অভিযোগের অঙ্গুলি নির্দেশিত হয়েছে।
পোশাকশিল্পের মালিক সমিতি একটি শক্তিশালী নির্বাচিত প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানটিকে কেন যেন কোনো দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে প্রো-অ্যাকটিভের বদলে রি-অ্যাকটিভ মনে হয়। কিছু হলেই তারা দেশি-বিদেশি মহলের ষড়যন্ত্রের প্রতি ইঙ্গিত করে। কারখানায় আগুন লাগার পর নির্গমন পথে তালা লাগানোর কাজটি নিশ্চয়ই কারখানা কর্তৃপক্ষের। নিষ্ক্রমণপথের অপ্রতুলতা কিংবা কারখানার আদর্শ কর্মপরিবেশের অনুপস্থিতি নিশ্চয়ই কোনো ষড়যন্ত্রকারী মহলের কাজ নয়। দিনের পর দিন অপরিকল্পিতভাবে গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে। শুধু রাজধানীতে এক হিসাবে এক হাজারের বেশি পোশাক কারখানা গড়ে ওঠার সুযোগ হলো কী করে?
ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় অগি্নকাণ্ডের ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনা ব্যাপক হতে বাধ্য। এক হিসাবে গত ছয় বছরে পোশাকশিল্পে নানা ধরনের দুর্ঘটনায় তিন শর মতো শ্রমিকের প্রাণহানি ঘটেছে। এর মধ্যে রয়েছে বিল্ডিং ধসে পড়া আর আগুন লাগার মতো ঘটনা।
সাম্প্রতিক অগি্নকাণ্ডের ঘটনাটির জের এত সহজে মিটবে বলে মনে হয় না। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় খুচরা পোশাক বিক্রেতা (রিটেইল আউটলেট) ওয়ালমার্ট এরই মধ্যে প্রত্যাশিতভাবে পোশাক সরবরাহের চুক্তি বাতিল করেছে তাদের সরবরাহকারীর সঙ্গে। কাজটিকে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান অমানবিক আখ্যা দিয়েছে। স্মরণ রাখা দরকার, যুক্তরাষ্ট্রের বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান তাদের গ্রাহকদের কাছে দায়বদ্ধ। বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের বর্তমান অবস্থার কারণে প্রাগুক্ত গেইনসভিল গ্যাপ রিটেইল আউটলেটটি বন্ধ করে দেওয়ার কথাও নাকি ভাবছে।
পোশাকশিল্পের এ দুর্ঘটনার সঙ্গী হয়ে এলো চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটের ফ্লাইওভারের দুর্ঘটনা। গার্ডার ভেঙে মারা গেল নিরীহ কিছু মানুষ। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা সিডিএর এই প্রকল্পে এ নিয়ে তিনবার দুর্ঘটনা ঘটল। এখন নগরবাসীর কাছে এই ফ্লাইওভার মরণফাঁদের আরেক রূপ। নগরবাসীর সোচ্চার দাবি, অবিলম্বে এই ফ্লাইওভার ভেঙে ফেলতে হবে। ফ্লাইওভার, যা যুক্তরাষ্ট্রে টার্ন পাইক নামে পরিচিত, যোগাযোগব্যবস্থায় এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন। সিডিএর ফ্লাইওভার দেখলাম এর ব্যত্যয়।
সিডিএর বর্তমান চেয়ারম্যান রাজনৈতিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত। তিনি একজন সাধারণ ব্যবসায়ী, প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক। এখন তাঁর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার তাঁরই দলের রাজনৈতিক অভিভাবক, সাবেক নগরপিতা। স্বীকার করেন, রাজনীতিতে এমন ভুল ব্যক্তি নির্বাচিত হতেই পারে।
সবই হতে পারে, সবই হয়। কিন্তু বেঘোরে হারিয়ে যাওয়া প্রাণগুলো আর ফিরে আসে না। অনেকের লাশ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায় না।
বর্তমান সময়ে পৌনঃপুনিক হারে দুর্ঘটনার মিছিলে বিমূঢ়চিত্তে শেকসপিয়ারের বিখ্যাত নাটক 'হ্যামলেট'-এর একটি সংলাপ বারবার মনে পড়ছে :
মার্সেলিয়াসের সেই বিখ্যাত উক্তি : সামথিং ইজ রটেন ইন দ্য স্টেট অব ডেনমার্ক- ডেনমার্ক রাজ্যে অশুভ কিছু একটা ঘটছে!

লেখক : কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক

No comments

Powered by Blogger.