বিজয়ের মাসে বিজয়ের ব্যাটে জয় by উৎপল শুভ্র

সারা বিশ্ব দিন উদ্যাপন করে। বাংলাদেশ তো তা করেই, সঙ্গে মাসও। এই দেশে ফেব্রুয়ারি মানেই অমর একুশের মাস, মার্চ শুরু স্বাধীনতার গান গেয়ে, ডিসেম্বরের প্রথম দিন থেকেই পূর্ব দিগন্তে রক্তলাল সূর্যের আভা। খুলনার গ্যালারিতে কাল এক দর্শকের তুলে ধরা প্ল্যাকার্ডটা আবারও তা মনে করিয়ে দিল।
তাতে উৎকীর্ণ ছোট্ট একটা দাবি—বিজয়ের মাসে বিজয় চাই।
সেই বিজয় এল। এমন সাড়ম্বরে, এমন মহাসমারোহে যে তা বিস্ময়ে বিমূঢ় করে দেওয়ার মতো। ‘অনায়াসে’ শব্দটা কি আরও বেশি সুপ্রযোজ্য হতো! সংযুক্ত আরব আমিরাত, স্কটল্যান্ড, হংকং, কেনিয়া কত পুঁচকে দলের সঙ্গেই না খেলেছে বাংলাদেশ। কী আশ্চর্য, কী আশ্চর্য, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জয়টা এদের কারও বিপক্ষে নয়। সেটি কি না প্রবল পরাক্রান্ত এই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে!
সেই জয়ের ব্যবধান ১৬০ রান! কালকের ম্যাচটা দেখেননি, এমন মানুষ হয়তো বাংলাদেশে খুঁজে পাওয়া যাবে। কিন্তু বাংলাদেশ কী কাণ্ড করে ফেলেছে, এটাও জানেন না, এমন কেউ বোধ হয় এই ব-দ্বীপে নেই। যদি থেকে থাকেন, অবিশ্বাসে চোখ কচলে তিনি ভাববেন, ঠিক পড়লাম তো! বাংলাদেশ কি সত্যিই ১৬০ রানে জিতেছে!
২৬৪তম ওয়ানডেতে এটি বাংলাদেশের ৭৪তম জয়। আগের ৭৩টিতে রানের হিসাবে সবচেয়ে বড় জয় ছিল স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে, ১৪৬ রানে। বড় দল আলাদা করে নিলে ১৬০ রানের ব্যবধান নিয়ে এই উচ্ছ্বাসটা বুঝতে আরও সুবিধা হবে। ২০০৭ বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৬৭ রানের সেই জয় এখন কত পেছনে! কাজে আসবে আরেকটা পরিসংখ্যানও। বাংলাদেশের খেলা ওয়ানডের প্রায় এক-পঞ্চমাংশে (৫৩টি) তো ১৬০-এর কম রানে ইনিংসই শেষ হয়ে গেছে।
বিজয়ের মাসে বিজয় এল। কাকতালীয়ই বলতে হবে, সেই বিজয় এল বিজয়ের ব্যাটে চড়েই। নাম এনামুল হক। পাসপোর্ট করার সময় কে যেন ইংরেজি নামে ‘ই’-এর বদলে ‘এ’ দিয়ে ফেলেছিল। সেই থেকে নাম নিয়ে বিভ্রান্তি। গত এক বছরে সেঞ্চুরির পর সেঞ্চুরি করেছেন আর বেড়েছে সেই বিভ্রান্তিটা—আনামুল না এনামুল? ‘আনামুল’টাই চালু হয়ে গিয়েছিল। সুযোগ পেলেই সাংবাদিকদের অনুরোধ করেছেন, ‘ভাই, আমার নাম এনামুল। আনামুল লেখা হলে বড় কষ্ট পাই।’
বিজয় নামটা কে রেখেছিল? এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে নির্বিকার মুখে জবাব দিলেন, ‘আমি নিজেই।’ আসলেই কি তাই? নাকি যেটা শোনা গেল, সেটাই সত্যি—বিজয় দিবসে জন্ম বলে বিকেএসপিতে তাঁর এক শিক্ষিকাই দিয়েছেন ওই নাম! নামের ইতিহাস যা-ই হোক, সেই নামের সার্থকতা এর চেয়ে ভালোভাবে আর প্রমাণ করতে পারতেন না। বিজয়ের ওয়ানডে ক্যারিয়ার শুরু হলো টানা দুই বিজয়ে। দুই দিন আগে অভিষেকে ৪১ রান করে ছিলেন সহযোগীর ভূমিকায়। কাল দ্বিতীয় ম্যাচেই সেঞ্চুরি করে তিনিই বিজয়ের নায়ক।
নায়ক ঠিক আছে, কিন্তু পার্শ্বনায়কের অভাব নেই। সেখানে মুশফিকুর রহিম আছেন, আবদুর রাজ্জাক আছেন, আছেন সোহাগ গাজীও। ২১ রানে ২ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর মুশফিকুরই তো ভয়-তাড়ানিয়া ১৭৪ রানের জুটিতে এনামুলের সঙ্গী। তৃতীয় উইকেটে এটি বাংলাদেশের নতুন রেকর্ড, যেকোনো উইকেটেই সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডটা হলো না মাত্র ১ রানের জন্য (চতুর্থ জুটিতে ১৭৫, হাবিবুল বাশার ও রাজিন সালেহ, বিপক্ষ কেনিয়া, ফতুল্লা, ২০০৬)।
এনামুল-মুশফিকের জুটিটি শুরু হলো ‘গেল, গেল’ রবের মধ্যে। ওই ২ উইকেটের প্রথমটি যে তামিম ইকবালের। তামিম নেই মানেই তো বড় স্কোর গড়ার আশা শেষ! কিন্তু এই সিরিজে যে বাংলাদেশ নির্দিষ্ট কারও ওপর নির্ভরতার দিন শেষ করে ‘দল’ হয়ে ওঠার প্রতিজ্ঞা করেছে। সাকিবকে নিয়ে হাহাকার ঘুচিয়ে দিয়েছিল প্রথম ম্যাচের জয়। আর কালকের জয়ের পর তামিম হাসতে হাসতে বললেন, ‘আমার সঙ্গে কী কথা বলবেন? শুধু তো দুটি ক্যাচই নিয়েছি!’
সাকিব-তামিম নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসাটা যে কত বড় ব্যাপার, সেটি বুঝতে একটা পরিসংখ্যানের সাহায্য নিতে পারেন। ২০০৬ সালের আগস্টে সাকিবের অভিষেকের পর বাংলাদেশ ২৪তম বারের মতো কাল আড়াই শ বা এর বেশি করল। সাকিব বা তামিম কারও ব্যাট থেকে বড় অবদান (৩০ রানের কম) ছাড়া তা হলো মাত্র তৃতীয়বারের মতো।
এনামুলের ১৪৫ বলে ১২০ ও মুশফিকের ৮৭ বলে ৭৯ রানের পরও ২৯২ একসময় অগম্যই মনে হচ্ছিল। সেটি সম্ভব হলো খুদে মমিনুলের অভিষেক ইনিংসে ২৯ বলে ৩১ আর মাশরাফির ৬ বলে ১৮ রানের ঝড়ে। শেষ ওভারে স্যামুয়েলসকে বিশাল দুটি ছক্কা মারলেন মাশরাফি, সে ওভারে এল ১৯ রান। শেষ ৩ ওভারে ৫২ ব্যাটিং পাওয়ার প্লেতে মাত্র ২০ রান আসার দুঃখ রূপসা নদীতে ছুড়ে ফেলল।
২৯২ অনেক রান, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সংগ্রহও। তার পরও গেইল-স্যামুয়েলস-পোলার্ডদের বিপক্ষে এই রান করেও নিশ্চিন্ত থাকা কঠিন। অথচ ওয়েস্ট ইন্ডিজের অর্ধেকটা যেতে না-যেতেই উল্টো জয়ের ব্যবধানটাই শুধু আলোচনার বিষয় হয়ে গেল। গেইলকে ফিরিয়ে পথের বড় কাঁটাটা উপড়েছেন মাশরাফি। তবে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে তুর্কি নাচ নাচিয়ে ছাড়ল সেই স্পিনই।
ওয়ানডে সিরিজ শুরুর আগের দিন স্পিনারদের জন্য আতঙ্ক হয়ে আসা বৃত্তের বাইরে মাত্র চার ফিল্ডার রাখার নিয়ম নিয়ে তুমুল আলোচনা। স্পিন কোচ সাকলায়েন মুশতাক তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বলেছিলেন, মাথায় বুদ্ধি আর বুকে সাহস থাকলে এটা কোনো সমস্যাই নয়। বাংলাদেশের স্পিনারদের এ দুটি বস্তু ভালোই আছে বলেও দাবি করেছিলেন। সেটির প্রমাণ তো পাওয়াই গেল।
সোহাগ গাজী ও রাজ্জাকের ৩টি করে উইকেট। উইকেট পেলেন নাঈম ও মাহমুদউল্লাহও। চার স্পিনার মিলে ২৪.১ ওভারে ৯৫ রানে ৮ উইকেট। আবুল হাসান যে মাত্র একটা ওভার করেই চোট পেয়ে বেরিয়ে গেছেন, সেটি আর কারও মনেই থাকল না।
সোহাগের বলে কাভারে তামিম নারাইনের ক্যাচটা নিতেই শুরু হয়ে গেল মাঠে বাংলাদেশের বিজয়োৎসব। অদৃশ্য হয়ে মানজারুল ইসলাম রানাও কি ছিলেন তাঁদের সঙ্গে? মুশফিকুরদের উল্লাসের ছবিটার ঠিক পেছনেই মানজারুল ইসলাম রানা স্ট্যান্ড। রানার মায়ের চাওয়া পূরণ করে গত পরশু রাতেই একটা গ্যালারিতে উঠেছে ওই সাইনবোর্ড।
অদৃশ্যলোক থেকে রানা হয়তো বলছিলেন, ‘বন্ধুরা, ২-০ করে দিলাম। যাও, এবার ঢাকা গিয়ে সিরিজটা জেতো।’
বাংলাদেশ: ৫০ ওভারে ২৯২/৬
ওয়েস্ট ইন্ডিজ: ৩১.১ ওভারে ১৩২
ফল: বাংলাদেশ ১৬০ রানে জয়ী

No comments

Powered by Blogger.