আশুলিয়ায় ফের শ্রমিক-পুলিশ সংঘর্ষ, আহত শতাধিক

আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় গতকাল রবিবারও পোশাক শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশকে লাঠিপেটা, কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করতে হয়। সংঘর্ষে পুলিশসহ শতাধিক শ্রমিক ও পথচারী আহত হয়।
সকালের দিকে পরিবেশ সহিংস হয়ে ওঠায় শিল্পাঞ্চলের শতাধিক কারখানায় ছুটি ঘোষণা করা হয়। এরপর শ্রমিকরা সংঘবদ্ধ হয়ে সড়ক-মহাসড়কে অবস্থান নিলে পুলিশ তাদের হটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। শ্রমিকরা প্রতিহত করার চেষ্টা করলে দুই পক্ষে সংঘর্ষ বাধে।
এদিকে আশুলিয়ায় অগ্নিকাণ্ডের শিকার তাজরীন ফ্যাশনসের শ্রমিকদের বেতন পরিশোধের জন্য আজ সোমবার তালিকা করা হবে বলে জানিয়েছে রপ্তানিমুখী পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। গতকাল এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সংগঠনটি জানায়, তালিকা হয়ে গেলে আগামীকাল মঙ্গলবার শ্রম মন্ত্রণালয়ে একটি সভা হবে। পরে ওই সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বৃহস্পতিবার বেতন দেওয়া হবে। গত ১ ডিসেম্বর বেতন দেওয়ার কথা থাকলেও শ্রমিকরা সব পাওনা একসঙ্গে চাওয়ায় তা দেওয়া সম্ভব হয়নি বলে জানানো হয় বিজ্ঞপ্তিতে।
সহিংসতার প্রেক্ষাপট-১ : জানা গেছে, আগের দিন অন্যান্য কারখানার শ্রমিকদের হামলায় পি-কার্ড লেদার কারখানা নামের একটি প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গতকাল সকাল ৮টায় ওই প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকরা কারখানায় উপস্থিত হয়ে তাদের কর্মকর্তাদের কাছে আগের দিনের ঘটনার বিষয়টি উপস্থাপন করে। তারা এ সময় এও বলে, শনিবার তারা অন্যান্য কারখানার শ্র্রমিকদের ডাকে সাড়া দিয়ে আন্দোলনে নামলে হামলার ওই ঘটনা হয়তো ঘটত না। এরপর শ্রমিকরা রবিবারের জন্য কারখানাটি ছুটি দেওয়ার অনুরোধ জানালে কর্তৃপক্ষ তাতে রাজি হয়।
সূত্র মতে, পি-কার্ড লেদারের শ্রমিকরা ছুটি পেয়ে কারখানা থেকে বের হয়ে আসছে দেখে আশপাশের আরো কিছু কারখানার শ্রমিকরাও কাজ ছেড়ে রাস্তায় নেমে পড়ে। এরপর তারা একজোট হয়ে কাজ চলছে এমন সব কারখানা লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে আশপাশের ৩০-৪০টি কারখানা তাৎক্ষণিকভাবে ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়। এরপর সব শ্রমিক রাস্তায় নেমে এলে জিরাবো-বিশমাইল সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। শ্রমিকরা সংঘবদ্ধভাবে বিভিন্ন কারখানায় ইটপাটকেল ছুড়তে থাকলে এবং আব্দুল্লাহপুর-বাইপাইল মহাসড়কের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের বাধা দেয়। এরপর সংঘর্ষ বাধে এবং পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে লাঠিপেটা, টিয়ার শেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। সংঘর্ষে পুলিশসহ অর্ধশতাধিক শ্রমিক ও পথচারী আহত হয়। পরে শ্রমিকরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলে পুলিশ বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নেয়।
জানা গেছে, শনিবার কাঠগড়া এলাকাগামী বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের সঙ্গে অন্যান্য পোশাক কারখানার শ্রমিকরা যোগ দিলেও অংশ নেয়নি পি-কার্ডের শ্রমিকরা। ফলে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা ওই কারখানার গেটের সামনে বিভিন্ন বস্তু জড়ো করে আগুন লাগিয়ে দেয় এবং কারখানার ভেতরে গিয়ে কয়েকটি মোটরসাইকেল, গাড়িসহ কারখানায় ব্যাপক ভাঙচুর করে। পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
সহিংসতার প্রেক্ষাপট-২ : জামগড়া এলাকার কোরীয় মালিকানাধীন হিউন অ্যাপারেলস শ্রমিক আন্দোলনের ঘটনায় বন্ধ ছিল। আট দিন পর গতকাল কারখানাটি খুলে দেয় কর্তৃপক্ষ। শ্রমিকরা কাজ করতে এসে ফটকে দেখতে পায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অভিযোগে কর্তৃপক্ষ শতাধিক শ্রমিককে ছাঁটাই করে তাদের নামের তালিকা টাঙিয়ে রেখেছে। এ নিয়ে ক্ষোভের একপর্যায়ে দুপুর ১২টার দিকে শ্রমিকরা কারখানার বাইরে চলে যায় এবং আশপাশের কারখানাগুলোর শ্রমিকদের তাদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানায়। তারা আশপাশের সেতারা গ্রুপ, এম ডিজাইন লিমিটেড, রিয়ম কমপ্লেক্স, এনভয় গ্রুপ, শেড ফ্যাশনসহ বেশ কয়েকটি কারখানায় ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে এবং ভাঙচুর চালিয়ে শ্রমিকদের বের করে নিয়ে আসে। কোনো কারখানার শ্রমিকরা তাদের সঙ্গে যোগ দিতে না চাইলে তারা ওই সব কারখানায় ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে আশপাশের প্রায় অর্ধশত কারখানায় ছুটি ঘোষণা করা হয়।
বিভিন্ন সূত্র মতে, এসব বিক্ষুব্ধ শ্রমিক আব্দুল্লাহপুর-বাইপাইল মহাসড়কের জামগড়া, শিমুলতলা এলাকায় অবস্থান নেয়। তারা মহাসড়কে কয়েকটি গাড়িতে ভাঙচুর চালালে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করলে তাদের লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হয়। তখন পুলিশ লাঠিপেটা, টিয়ার শেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এরপর ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া চলতে থাকে। পরে জলকামান আনা হলে শ্রমিকরা পিছু হটে যায় এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। দুপুর সাড়ে ১২টার পর পুলিশ প্রহরায় ধীরে ধীরে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিত হতে থাকে। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও স্থানীয় বগাবাড়ী, ইউনিক, শিমুলতলা, জামগড়া, বেরন, সরকার মার্কেট, নরসিংহপুর, নিশ্চিন্তপুর, জিরাবো, পুকুরপাড়সহ পুরো শিল্পাঞ্চলে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করে।
আশুলিয়া শিল্প পুলিশের উপপরিচালক মোক্তার হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, সংঘর্ষ চলাকালে কয়েকজন পুলিশ সদস্য শ্রমিকদের ছোড়া ইটপাটকেলের আঘাতে আহত হয়েছেন। শিল্প এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ, শিল্প পুলিশ, আর্মড পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। র‌্যাব সদস্যের উপস্থিতি, জলকামান এবং পুলিশের টহল বৃদ্ধি করা হয়েছে।
বিজিএমইএর বিজ্ঞপ্তি : গত ২৮ নভেম্বর সিদ্ধান্ত হয়েছিল বিজিএমইএর উদ্যোগে ১ ডিসেম্বর শনিবার তাজরীন ফ্যাশনসের শ্রমিকদের নভেম্বর মাসের বেতন পরিশোধ করা হবে। সেই অনুযায়ী টঙ্গীর আইআরআই (ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিলেশনস ইনস্টিটিউট) প্রাঙ্গণে শ্রমিকদের বেতনের টাকা নিয়ে কারখানা কর্তৃপক্ষ, সরকার ও বিজিএমইএ নেতারা তৈরিও ছিলেন। কিন্তু শ্রমিকরা শ্রম আইনসংগত সব পাওনা একসঙ্গে নেওয়ার দাবিতে নভেম্বর মাসের বেতন গ্রহণ করেনি।
বিজিএমইএ বিজ্ঞপ্তিতে আরো জানায়, পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল শ্রমমন্ত্রীর সভাপতিত্বে এক বৈঠক হয়। বৈঠকে স্থানীয় সংসদ সদস্য, বিজিএমইএর সভাপতি, শ্রমসচিব, তাজরীন কারখানা কর্তৃপক্ষ, শ্রম অধিদপ্তর, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের প্রধান পরিদর্শক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার প্রতিনিধি এবং শ্রমিক নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

No comments

Powered by Blogger.